হাওরের বুকে বৃষ্টি আর ঢেউয়ের যুগলবন্দী

দুলাল মাহমুদ

সাঁতার না জানা কারও কাছে সমুদ্র যা, সুইমিংপুলও তাই। যতই হাওর-নদী-সমুদ্রর প্রতি আকষর্ণ থাকুক না কেন, থই থই পানি দেখলে বুক না কেঁপে পারে না। তারপরও যদি হাওর-নদী-সমুদ্রবিলাসী হতে ইচ্ছে হয়, তাকে কী বলা যায়? আমার ঠিক জানা নেই। প্রশ্ন করতে পারেন, পানির দেশের মানুষ হয়েও কেন সাঁতার জানি না? এর সদুত্তরও আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। চারপাশ যখন বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত, তখন কিনা হাওর দেখতে যাওয়ার বাসনা? তাও সাঁতার না জেনে।

কথায় আছে না, উঠল বাই তো কটক যাই। পথঘাটের দিকনির্দেশনা জানা না থাকায় বিভিন্ন পথ ঘুরে পৌঁছে যাই কিশোরগঞ্জের বালিখোলা। ট্রলারে চড়ে মিঠামইন যাওয়ার পথে ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা হয়। কখনো রোদ। কখনো বৃষ্টি। বয়ে যায় ঝিরি ঝিরি বাতাসও। ঘট ঘট শব্দে পানি কেটে কেটে ট্রলার সামনে এগিয়ে যেতে থাকলে অপেক্ষা করতে থাকে মহাবিস্ময়। মনে হলো ভুল করে সমুদ্রে চলে এসেছি। এলাম তো নিকলী-মিঠামইন হাওরে। সমুদ্র এলো কোথা থেকে? যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। কোনো কূলকিনারা নেই।

তবে সমুদ্রের মাঝখানে তো বাড়িঘর, বিদ্যুতের খুঁটি, গাছগাছালি থাকার কথা নয়। তাতে খটকা লাগে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, শুষ্ক মৌসুমে পুরো এলাকাটাই ফসলের জমি আর কিছু কিছু স্থায়ী বিল বা খাল থাকে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে বর্ষাকালে ধানের জমি ও খালবিল রূপান্তরিত হয়ে সাগরে রূপ নেয়। দুই বিপরীতধর্মী দৃশ্য একবার কল্পনা করুন তো। তারমানে ইহাকেই হাওর বলে?

বিস্তৃত এলাকাজুড়ে যার অবাধ বিস্তার। কখনো কখনো হাঙরের মতো মনে হয়েছে। যেন আমাদের গিলে খাওয়ার জন্য দাঁতমুখ খিচিয়ে আছে। ধনু আর ঘোড়াউত্রা নদীকে রীতিমতো হজম করে নিয়েছে। কোন অংশ নদী আর কোন অংশ হাওর, একদম ঝানু না হলে বোঝার উপায় নেই। সব যেন একাকার হয়ে গেছে। তবে কোথাও কোথাও ব্যবধানটা স্পষ্ঠ হয়ে আছে। শত হলেও নদীর তো একটা আভিজাত্য আছে। সে তো অন্য কারো সঙ্গে বিলীন হয়ে যেতে পারে না।

হাওরে স্রোতের টানে ভেসে গেলে কিংবা কোথাও ধাক্কা খেয়ে ট্রলার ডুবে গেলে চলে যেতে হবে দিকশূন্যপুর। পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ এই হাওরের কোথাও কোনো সতর্কতা ঝুলানো নেই। নেই পথনির্দেশ। বিপদ থেকে উদ্ধার করার ব্যবস্থাও নেই। ট্রলার চালকদের ওপর ছেড়ে দিতে হয় সব কিছু। ঘটনাক্রমে তেল ফুরিয়ে গেলও গন্তব্য হয়ে যাবে অনির্দিষ্ট। রোমাঞ্চকর অভিযানে এসে উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলে মাটি হয়ে যেতে পারে সব আনন্দ। কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিবেশে না চাইলেও কেন যেন তা এসে যায়।

হঠাৎ আকাশ মেঘলা হলে উঠলে নিমিষেই যাবতীয় সাহস ফিকে হয়ে যায়। ভাবগতিক বেশি ভালো মনে হয় না। এখন যদি পাগলা হাওয়ায় খেপে উঠে হাওর, তাহলে তো দলাইমলাই করে ছাড়বে। সে অভিজ্ঞতা যতই রোমাঞ্চকর হোক, তেমন ইচ্ছে অন্তত আমার নেই। বোধকরি আমার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে মেঘের দল কেমন রোমান্টিক হয়ে ওঠে। মেঘেরা যখন রোমান্টিক হয়ে উঠে, তখন কি যে আবেগময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঝমঝমিয়ে নামতে থাকে বৃষ্টি। আহ্, কি যে মাধুর্য ছড়িয়ে দেয়। হাওরের বিশাল প্রান্তরজুড়ে বৃষ্টি আর ছোট ছোট ঢেউয়ের যুগলবন্দীতে অসাধারণ লাগে। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সুখের শিহরন। এই বৃষ্টি না এলে হাওরকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারতাম না।

নিকলী হাওরের ঘোড়াদিয়ায় ধনু-ঘোড়াউত্রা নদীর সংগমস্থলের কাছাকাছি গিয়ে দেখি, ট্রলার থেকে লোকজন ঝাপ দিচ্ছে। ঘটনা কী? এভাবে দল বেঁধে আত্মঘাতী হওয়ার মানে কী? নাকি কোনো মানত করতে এসেছেন। কাছে গিয়ে দেখি, সে ধরনের কিছু নয়। এটা হলো বৃক্ষস্মান। অর্থাৎ গাছে ঝুলে ঝুলে গোসল। জায়গাটায় তীব্র স্রোত। সাঁতার না জেনে সেখানে নামার প্রশ্নই আসে না। সাঁতার জানার পরও নিয়ন্ত্রণ রাখা খুবই কঠিন। এ কারণে গাছকে কেন্দ্র করে গোসল করা হয়। মানুষের শখের তো শেষ নেই। এটাও এক রকম শখ বৈকি। বর্ষাকালে খালের নিদিষ্ট একটি স্থানে বাঁশ পুতে তাতে গাছের ডালপালা ফেলে রাখা হয়। অনেক দিন পর জাল দিয়ে ঘেরাও করা হলে অনেক রকম মাছ ধরা পড়ে। অনেকে যখন বৃক্ষস্মান করছিলেন, আমার মনে কেন যেন সেই মাছ ধরার দৃশ্য ভেসে ওঠে।

মিঠামইন গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারতে সারতে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। আহারও প্রত্যাশিত মানের হয়নি। ভেবেছিলাম, হাওরের তরতাজা মাছের স্বাদ নেবো। কিন্তু সে রকম ব্যবস্থাই নেই। আসলে এখনো গড়ে উঠেনি পর্যটনী মেজাজ। যাহোক, সেখান থেকে চুক্তিভিত্তিতে হিউম্যান হলার গাড়িতে করে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কে যাই। হাওরের বুকে ভেসে থাকা সড়কটি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। দুই পাশে মনোরম দৃশ্যাবলী। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য গেল বাংলা নববর্ষে ১৪ কিলোমিটার রাস্তা সাজানো হয়েছে আল্পনায় আল্পনায়।

হাওর, সড়ক ও আল্পনার সম্মিলনে ফুটে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যপট। এমন দৃশ্যপট পেয়ে হুটোপুটি লেগে আছে। কেউ কেউ রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে থাকেন। কত রকম ভঙ্গিতে যে ছবি তোলা হতে থাকে, তার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। বিকেল সন্ধ্যার দিকে গড়ালে নিরাপত্তার কারণে সেখানে থাকতে দেওয়া হয় না। আমাদেরও ফেরার তাড়া ছিল। ট্রলারে ফেরার সময় সূর্য যখন ডুবে যেতে থাকে, তখন হাওরের বুকে মন কেমন করা এক একটি জলছবি ফুটে উঠতে থাকে। অলোকসুন্দর সেই সৌন্দর্যের কোনো ব্যাখ্যা হয়। ব্যাখ্যাতীত সেই সৌন্দর্য কেবল হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। অবিস্মরণীয় সেই অনুভব নিয়ে নির্জন পথ দিয়ে ফেরার সময় মনের চোখে একে একে ভেসে উঠতে থাকে দৃশ্যগুলো।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত