রাগ — যেই অনুভূতি এডওয়ার্ড স্কিপ স্কিপার্টন জীবনে সব থেকে বেশি অনুভব করেছেন। আসলে তার স্বভাবটাই এমন। শৈশব থেকেই তিনি বদমেজাজি ছিলেন। এখন তার বয়স হয়েছে। তবুও ধীরবুদ্ধির নির্বোধ শ্রেণীর মানুষ দেখলে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন।
পেশাগত জীবনে তার কাজ ছিলো বিভিন্ন কোম্পানিকে ব্যবস্থাপনা নিয়ে উপদেশ দেওয়া। কেউ ভুলভাল কাজ করলে তিনি ‘লাউড এন্ড ক্লিয়ার’ ভাষায় তাদের সংশোধন করে দিতেন। এতে ভালো কাজ হতো। পরিচালকরা তার কথা কোনদিন অমান্য করেনি।
বর্তমানে স্কিপার্টনের বয়স বায়ান্ন বছর। দুই বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দীর্ঘ দিনের সঙ্গিনী সম্ভবত তার বদমেজাজকে আর সামলাতে পারেননি। বিচ্ছেদের পরে বিয়ে করেছেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শান্ত শিষ্ট অধ্যাপককে। তবে স্কিপ উকিলের মারপ্যাঁচে ঠিকই মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। তখন স্কিপার্টন দম্পতির মেয়ে — ম্যাগির বয়স ১৫ বছর।
বিবাহ বিচ্ছেদের কয়েক মাসের ভিতরেই তার হার্ট এট্যাক হয়। যদিও ছ’ মাসের ভিতর আবার সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ডাক্তারের চাঁচাছোলা বক্তব্য — “হয় সিগারেট আর মদ ছাঁড়ো, না হয় মরো। আরো ভালো হয় যদি ব্যবসাটাও ছেড়ে দাও। টাকা পয়সা যথেষ্ট করেছো। এখন জমিজমা কিনে গ্রামে গিয়ে আরাম করো।”
স্কিপার্টন তার কথা মেনে নিলেন।
কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করে ম্যাইনে একটা ফার্মহাউজ পাওয়া গেলো। বেশ আরামদায়ক। সামনে চাষের জমির বুক চিরে একটি ছোট নদী বয়ে গেছে। নদীর নাম কোল্ড স্ট্রিম। ফার্ম হাউজের নাম ‘কোল্ড স্ট্রিম হাইটস’। জমিতে কাজের জন্য স্থানীয় একজনকে জোগাড় করা হলো। নাম এন্ডি হামবার্ট।
ম্যাগিকে নিউ ইয়র্কের পাবলিক স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেবল ছুটিছাটায় সে বাড়িতে আসে। স্কিপ মদ, সিগারেট — দুটোই ছেড়ে দিলেন। একসাথেই ছেড়েছেন। কোন কিছু নিয়ে একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেটা তৎক্ষণাৎ করে ফেলাই তার স্বভাব।
তিনি এখন চাষাবাদেও সময় দেন। এন্ডিকে নিয়ে ক্ষেতে ভুট্টার চাষ শুরু করেছেন। দুটো ভেড়া এবং শূকর পালন করছেন। শূকরটা ইতোমধ্যে বারোটা বাচ্চা দিয়েছে।
এত সব কিছুর ভিতরে কেবল একটি ব্যাপারই তাকে বিরক্ত করতে লাগলো। তার প্রতিবেশী — পিটার ফ্রসবাই। স্কিপের পাশের জমিটাই পিটার ফ্রসবাই এর। একই সাথে সে নদীর পাড়ের জমির মালিক। নদীতে মাছ ধরার একচ্ছত্র ইজারাও তার।
স্কিপের মাছ ধরার শখ আছে। তাছাড়া বাড়ি থেকে নদীর যে অংশটা দেখা যায় অন্তত সেটুকু কিনে নেওয়ার জন্য তিনি উৎসুক হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি যখন মাছ ধরার ইজারা নেওয়ার প্রস্তাব পাঠালেন। তাকে জানালো হলো ফ্রসবাই এই প্রস্তাবে আগ্রহী নন। স্কিপ তাতে হাল ছাড়লেন না। পরের সপ্তাহে ফ্রসবাইকে ফোন করে নিজের বাড়িতে দাওয়াত দিলেন।
পিটার ফ্রসবাই তার নতুন ক্যাডিলাকে চড়ে আসলেন। ড্রাইভিং সিটে অল্পবয়সী এক যুবক। পিটার নিজেই তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যুবকটি তার ছেলে। ছেলেটির নামও পিটার।
‘ফ্রসবাইরা কখনো জমি বেচে না।’ তিনি বললেন, ‘ আমরা তিনশ বছর ধরে এই একই জমির মালিক। এই নদীতে সারা জীবন আমরাই মাছ ধরেছি। আমি বুঝতে পারছি না। আপনি এত আগ্রহী কেন?’
‘সামনের গ্রীষ্মে আমার মাছ ধরার ইচ্ছা আছে।’ স্কিপ বললেন, ‘তাছাড়া আমার ধারণা আপনিও জানেন যে আপনাকে ঠকানো হচ্ছে না। দুইশ মিটার জায়গায় মাছ ধরতে দেওয়ার জন্য আপনাকে বিশ হাজার ডলার দিচ্ছি। এত ভালো অফার আপনার সারা জীবনে আর কখনো পাবেন না।’
‘আমি আমার সারা জীবন নিয়ে চিন্তিত নই।’ ফ্রসবাই মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার একটি ছেলে আছে।’
ছেলেটি বেশ সুদর্শন। কালো চুল, শক্ত কাঁধ। বাপের থেকে লম্বা। এতক্ষণ বুকের উপর হাত বেঁধে বসে ছিলো। দেখে বোঝা যাচ্ছে বাপের অনমনীয় স্বভাব তার ভিতরেও আছে। তবুও চলে যাওয়ার আগে হেসে বলল, ‘আপনার বাড়িটা খুব সুন্দর সাজিয়েছেন, মিস্টার স্কিপার্টন।’ স্কিপ মনে মনে আত্মতুষ্টি অনুভব করলেন। বসার ঘরে সবচেয়ে মানানসই ফার্নিচার কেনার জন্য তিনি বেশ পরিশ্রম করেছেন।
ফ্রসবাই বললেন, ‘আপনি দেখছি পুরাতন আমলের জিনিসপত্র পছন্দ করেন। আপনার ক্ষেতে যে কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে — আমাদের এ দিকে এই জিনিস আর দেখা যায় না।’
‘কিছু ভুট্টা চাষের চেষ্টা করছি।’, স্কিপ বললেন, ‘ভুট্টার ক্ষেতের জন্য কাকতাড়ুয়ার দরকার আছে।’
যুবক পিটারের নজর পড়লো টেবিলের উপর রাখা ম্যাগির ছবির উপর।
‘মেয়েটি সুশ্রী।’
স্কিপ জবাব দিলেন না।
মিটিং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলো। স্কিপের মত মানুষ ব্যর্থতায় অভ্যস্ত নন। তিনি ফ্রসবাইয়ের শীতল ধূসর চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকে আরো একটি প্রস্তাব দিচ্ছি — আমি সারা জীবনের জন্য নদীটা ভাড়া নিতে চাই। আমি মারা গেলে এই নদী আপনার অথবা আপনার ছেলের হবে। ভাড়া হিসেবে বছরে পাঁচ হাজার ডলার দেবো।’
‘আমার তা মনে হয় না, মিস্টার স্কিপার্টন। ড্রিংক্সের জন্য ধন্যবাদ। বিদায়।’
ক্যাডিলাকটা দূরে চলে যাচ্ছে। ‘একটা গর্দভ’, স্কিপ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে এন্ডিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন। তার মুখে সুক্ষ্ম হাসির রেখা। ‘লাইফ ইজ আ গেম। এই খেলায় কখনো হারবে, কখনো জিতবে।’
♠♠
তখন মে মাসের শুরু। ভুট্টা গাছগুলো মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠছে। স্কিপ আর এন্ডি মিলে কিছু লাঠি দিয়ে একটা কাকতাড়ুয়া বানিয়েছে। তার গায়ে একটা পুরানো ওভার কোট আর মাথায় স্কিপের একটা পুরানো টুপি।
সপ্তাহান্তে ভুট্টা গাছগুলো আরো বড় হতে শুরু করলো। এর মধ্যে স্কিপ ফ্রসবাইদের বিরক্ত করার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করছিলেন। যেন বাধ্য হয়ে তারা নদীর কিছু অংশ বিক্রি করে দিতে রাজি হয়।
কিন্তু গরমের ছুটিতে ম্যাগি বাড়িতে আসার পর তিনি ওসব ব্যাপার ভুলেই গেলেন। ম্যাগিকে আনতে নিজে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্ক থেকে গাড়ি চালিয়ে ম্যাইনে নিয়ে এসেছেন। প্রথম দর্শনে তার মনে হলো মেয়েটা লম্বা হয়ে গেছে। আগের থেকে সুন্দরও হয়েছে।
‘বাড়িতে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’ স্কিপ বললেন।
‘ওহ! একটা ঘোড়া?’
‘না। ঘোড়া না। অন্য কিছু।’ স্কিপ আসলে ভুলেই গেছিলেন মেয়েটা ঘোড়ায় চড়া শিখছে।
সারপ্রাইজটা হলো একটা লাল রঙের টয়োটা। স্কিপের অন্তত এটা মনে ছিলো যে স্কুলে ওদের ড্রাইভিং শেখানো হয়েছে।
ম্যাগি প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে বাপের গলা জড়িয়ে ধরলো,
‘তুমি এত্ত ভালো কেন! তোমার শরীরটাও অনেক সুস্থ দেখাচ্ছে।’
পরদিন সকালে দুজনে নতুন গাড়িতে ঘুরে বেড়ালো। বিকালে ম্যাগি নদীতে মাছ ধরতে যেতে চাইলে স্কিপ তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললেন।
‘আচ্ছা, দরকার নেই তাহলে। করার মতো আরো অনেক কিছু আছে।’ ম্যাগি নিজের মত সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। কখনো বই পড়ে, কখনো বাইরে হাঁটাহাঁটি করে। কখনো বাড়িতেই এটা সেটা কাজ করে।
এক সন্ধ্যায় স্কিপ অবাক হয়ে দেখলেন ম্যাগি তিনটা মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ম্যাগি কি তার নিষেধ সত্বেও নদীতে গিয়েছিলো!
‘ওগুলো কোথায় পেয়েছো?’
‘একটি ছেলের সাথে দেখা হয়েছিলো। ওদিকে থাকে। আমরা দুজনেই পেট্রল কিনছিলাম। তখন সে নিজের পরিচয় দিলো। বললো আমাদের বাড়িতে আমার ছবি দেখেছে। তারপর দুজনে কফি খেলাম… ‘
‘ফ্রসবাইদের ছেলেটি?’
‘হ্যাঁ। খুব ভালো ছেলে। মনে হয় বাপটাই কেবল সুবিধার না। ও বিকালে একসাথে মাছ ধরার জন্য বলল। তাই গিয়েছিলাম।’
‘ঈশ্বরের দোহাই! আমি চাই না — দয়া করে শোনো ম্যাগি — আমি চাই না তুমি ফ্রসবাইদের সাথে মেশো।’ স্কিপ উঁচু স্বরে বললেন।
ম্যাগি অবাক হয়ে বাপের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মুখে কিছু বললো না।
পরদিন সে জুতা কেনার জন্য গ্রামে যাচ্ছে এই অজুহাতে তিনঘন্টা বাইরে কাটিয়ে এলো। স্কিপ খুব কষ্ট করে কোনো প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন।
এরপর শনিবার। ম্যাগি জানালো, কাছের শহরে এক নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সে সেখানে যাবে।
‘তোমার সাথে কে যাচ্ছে আন্দাজ করতে পারছি।’ স্কিপের গলায় ক্রোধের আভাস।
‘কথা দিলাম আমি একা যাবো। মেয়েদের নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আজকাল আর ছেলেদের দরকার হয় না।’
সেই মুহূর্তে স্কিপ একটি বিষয় বুঝতে পারলেন। তিনি কোনভাবেই ম্যাগিকে বাইরে যাওয়া থেকে ফেরাতে পারবেন না। এবং ঐ নচ্ছাড় ফ্রসবাই ছেলেটি অবধারিতভাবে ঐ অনুষ্ঠানে থাকবে। এবং এরপর ঠিক কি ঘটতে যাচ্ছে তাও তিনি পরিষ্কার জানেন। তার একমাত্র কন্যা পিটার ফ্রসবাইয়ের প্রেমে পড়বে!
ঐ দিন ম্যাগি গভীর রাতে বাড়ি ফিরলো। ততক্ষণে স্কিপ খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন। পরদিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে মেয়েটিকে খুব প্রাণবন্ত এবং উৎফুল্ল দেখালো।
‘ঐ ফ্রসবাই ছেলেটি নিশ্চয়ই ওখানে ছিলো?’
‘বাবা, আমি বুঝতে পারছি না তুমি ওকে এত অপছন্দ করো কেন?’
‘কারণ আমি চাই না তুমি একটা অশিক্ষিত গ্রাম্য ছেলের প্রেমে পড়ো। আমি তোমাকে ভালো স্কুলে পড়িয়েছি।’
‘পিট হার্ভার্ডে তিন বছর পড়েছে।’ ম্যাগি দাঁড়িয়ে পড়লো, ‘আমার বয়স এখন আঠারো। আমি কার সাথে মিশবো কি মিশবো না সেটা তুমি ঠিক করে দিতে পারো না।’
স্কিপ চিৎকার করতে লাগলেন, ‘ওরা আমাদের সমকক্ষ নয়।’ ম্যাগি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পরবর্তী এক সপ্তাহ স্কিপ খুব দুঃসহ অবস্থায় কাটালেন। তিনি যখন ব্যবসায়ী ছিলেন — মানুষের ঘাড়ে চাপ দিয়ে কিভাবে নিজের ইচ্ছা মতো কাজ আদায় করে নেওয়া যায় সেটা খুব ভালো করে জানতেন। কিন্তু নিজের মেয়ের বেলায় রীতিমত দিশেহারা অবস্থায় পড়ে গেলেন।
***
ঐ সপ্তাহের শনিবারের সন্ধ্যা। ম্যাগি জানালো উইলমার নামের এক ছেলের বাড়িতে পার্টি আছে। সে সেখানে যাচ্ছে। কিন্তু পরদিন রবিবার সকালেও ম্যাগি বাড়ি ফিরলো না। শেষে স্কিপ নিজেই উইলমারদের ফোন করলেন।
ফোনের ওপাসে একটি পুরুষ কন্ঠ। সে বললো ম্যাগি ঐদিন তাড়াতাড়ি পার্টি থেকে চলে গেছে।
‘সে কি একা বেড়িয়েছে?’
‘নাহ। পিট ফ্রসবাই সঙ্গে ছিলো। ম্যাগির গাড়ি আমার এখানে পড়ে আছে।’
স্কিপের শরীরে রক্ত ছলকে উঠলো। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে ফ্রসবাইদের বাড়িতে ফোন করলেন। ফোনের ওপাশে বুড়ো ফ্রসবাই।
সে জানালো ম্যাগি তার বাড়িতে নেই। তার ছেলে এই মুহূর্তে বাইরে আছে।
‘তার মানে কি? আপনার ছেলে কি রাতে ফিরে এসে তারপর বাইরে গেছে?’
‘মি. স্কিপার্টন। আমার ছেলে তার নিজের মতো চলে। তার নিজের একটা ঘর, একটা গাড়ি আছে — নিজস্ব একটা জীবন আছে। আমি কখনো আমার ছেলেকে…’
স্কিপার্টন সশব্দে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।
ম্যাগি ঐদিন সন্ধ্যাতেও বাড়ি ফিরলো না। এমনকি সোমবার সকালেও না। মঙ্গলবার বোস্টন থেকে একটি চিঠি এসে পৌছালো।
[si]
‘…বাবা তুমি হয়তো ভাবছো আমি ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা সব ভেবে চিন্তে একাজ করেছি। আমি সত্যিই আর স্কুলে ফিরে যেতে চাই না। দয়া করে আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না। আগামী সপ্তাহে তোমার সাথে কথা হবে। আমার নতুন লাল গাড়িটাকে খুব মিস করছি।’
ভালোবাসা নিরন্তর,
ম্যাগি
[/si]
বোস্টনে ম্যাগি স্কিপার্টন এবং পিটার ফ্রসবাই জুনিয়র বিয়ে করেছে।
পরের দুদিন — স্কিপ বাড়ির বাইরে বের হলেন না। প্রায় কিছুই মুখে তুললেন না। প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকলেন। এন্ডি মালিককে নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। এরপর থেকে সে যখনই গ্রামে খাবার কিনতে যায়। মালিককে একরকম জোর করে সাথে নিয়ে যায়।
যখন এন্ডি বাজার করে। স্কিপ শূণ্য দৃষ্টি নিয়ে গাড়িতে চুপচাপ বসে থাকেন। হঠাৎ একদিন রাস্তার উপরে তার দৃষ্টি আটকে গেল। কেউ একজন এদিকে হেঁটে আসছে। বুড়ো ফ্রসবাই! স্কিপ মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন দুজনের যেন চোখাচুখি না হয়।
কিন্তু নাহ! ফ্রসবাই ঠিকই তাকে লক্ষ্য করলো। তবে হাটার গতির কোন পরিবর্তন হলো না। স্কিপকে দেখে থামলেনও না। কেবল ঐ হাসি! ঠোঁটে ঝুলানো সেই গা জ্বালানো অপ্রিয়দর্শন হাসিটা!
স্কিপ এক ধরণের উপলব্ধিতে পৌছালেন। ফ্রসবাইকে তিনি কি ভয়ঙ্করভাবে ঘৃণা করেন! তার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু টগবগ করে ফুঁটতে লাগলো। অবশেষে তিনি আবার স্বরূপে ফিরলেন। সেই আগের স্কিপার্টন। ফ্রসবাইকে শাস্তি পেতে হবে! অবশ্যই পেতে হবে!
♠♠
ঐদিন সন্ধ্যায় স্কিপ এন্ডির হাতে তিনশো ডলার ধরিয়ে দিলেন। তাকে এই সপ্তাহের ছুটিটা বাইরে কোথাও ঘুরে আসতে বললেন। এন্ডি শনিবার সন্ধ্যায় চলে গেল। ঠিক তারপরেই স্কিপ ফ্রসবাইকে ফোন করলেন, ‘আমার মনে হয় এইবার আমাদের বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো উচিত।’
ফ্রসবাই বেশ বিস্মিত হলেন। তবে রাজিও হলেন। রবিবার সকালে তিনি আসবেন বলে কথা দিলেন।
রবিবার ঠিক এগারোটায় তিনি একা তার ক্যাডিলাক গাড়ি চালিয়ে এলেন।
স্কিপকে খুব দ্রুত কাজ করতে হলো। প্রথমে তার ভারি বন্দুকটা নিয়ে তৈরি হয়ে থাকলেন। ফ্রসবাই মূল দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে বন্দুকের বাট দিয়ে মাথায় এক প্রচন্ড আঘাত করলেন। এরপর — আরো… আরো কয়েকটা। যতক্ষণ পর্যন্ত না ফ্রসবাইয়ের দেহটা নিথর হয়ে গেলো।
স্কিপ ফ্রসবাইয়ের পরনের কাপড় খুলে ফেলে নিজের পুরাতন কিছু কাপড় পড়ালেন। আগের কাপড়গুলো ফায়ার প্লেসে পুড়িয়ে ফেললেন। তার আংটি এবং ঘড়ি ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখলেন।
ফ্রসবাইয়ের এক হাত নিজের কাঁধে নিয়ে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসলেন। এরপর ভুট্টার ক্ষেতের ভিতর দিয়ে কাকতাড়ুয়াটার কাছে নিয়ে এলেন। ক্ষেতের ফসল আগেই কাটা হয়ে গেছিলো। তিনি পুরাতন কাকতাড়ুয়াটা নামিয়ে সেটার শরীর থেকে পুরাতন ওভারকোট আর হ্যাট নিয়ে ফ্রসবাইকে পরালেন। এক টুকরো কাপড় দিয়ে তার মুখ ঢেকে দিলেন।
এরপর জিনিসটা যথাস্থানে দাঁড় করানো হলো। নতুন তৈরি করা কাকতাড়ুয়াটা দেখতে অনেকটা আগেরটার মতই। স্কিপ যখন বাড়িতে ফিরে যাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকবার পেছন ফিরে নতুন বানানো কাকতাড়ুয়া দেখে নিলেন। বাহ! তার হাতের কাজ বেশ ভালো হয়েছে। নিজেকেই নিজের প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছে।
ঘড়ি আর আংটির ব্যাপারটা — ও দুটো বাগানের একটা বড় গাছের নীচে পুতে ফেললেন। বাকী থাকে ক্যাডিলাক গাড়িটা। দুপুর শোয়া বারোটার মত বাজে। ওটার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। গাড়িটা চালিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসলেন। অবশ্যই চলে আসার আগে ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে দিলেন। আশেপাশে কোন চাক্ষুস স্বাক্ষী নেই সেটাও নিশ্চিত হয়ে নিলেন।
বাড়িতে পৌছানোর পরপরই ফোন বেজে উঠলো। একজন মহিলা ফোন করেছেন। সম্ভবত ফ্রসবাইদের পরিচারিকা। স্কিপ ধারণা করলেন। ভদ্রমহিলা ফ্রসবাইয়ের খোঁজ করছেন। স্কিপ তাকে জানালেন ফ্রসবাই তার এখান থেকে বারোটায় বের হয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন বলে যাননি।
এই কথা তিনি সন্ধ্যায় তদন্তে আসা পুলিশকে বললেন। এমনকি ম্যাগি যখন বোস্টন থেকে ফোন করলো — তখনো। ফ্রসবাইকে নিয়ে মিথ্যা বলাটা তার কাছে তেমন কঠিন কাজ বলে মনে হলো না।
এন্ডি ফিরে এলো সোমবার সকালে। পথিমধ্যে সে সব কিছু শুনেছে। এটাও শুনেছে ফ্রসবাইয়ের গাড়িটা জঙ্গলে উদ্ধার হয়েছে। সে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলো না।
পরের সপ্তাহে — দিনের অনেকটা সময় স্কিপ দোতলায় নিজের ঘরে জানালার সামনে বসে কাটালেন। এখান থেকে কাকতাড়ুয়াটাকে দেখতে পাওয়া যায়। ওটাকে প্রতিবার দেখার সময় তার শরীরে একটা সুখানুভূতি অনুভব করেন। বসে বসে তিনি ফ্রসবাইয়ের কথা ভাবেন — ‘হারামজাদা, এই বার তুই রোদে শুকায়ে শুটকি হ।’
মৃদু হাওয়ায় কাকতাড়ুয়াটা অল্প অল্প দুলতে থাকে।
দশদিন পর পুলিশ আবার স্কিপের বাড়িতে এলো। সাথে একজন গোয়েন্দা। তারা পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। বন্দুক দুটো দেখলো। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলো না।
ঐদিন সন্ধ্যায় ম্যাগি তাকে দেখতে এলো। সে পিটকে নিয়ে ফ্রসবাইদের বাড়িতে উঠেছে। স্কিপের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো মেয়েটা আজ বিবাহিত।
‘পিট খুবই চিন্তিত। মানসিকভাবেও বিপর্যন্ত।’ ম্যাগি বললো, ‘মি. ফ্রসবাই যখন এসেছিলেন তখন কি তাকে অসুখী মনে হয়েছিলো?’
স্কিপ উচু গলায় হাসতে লাগলেন, ‘একদমই না! তোমাদের বিয়ে নিয়ে খুব আনন্দে ছিলেন। তুমি কি ফ্রসবাইদের বাড়িতে থাকছো?’
‘হ্যাঁ। আমার কিছু জিনিসপত্র নিতে এসেছি।’
ম্যাগির নিস্পৃহতা আর মন খারাপ দেখে স্কিপের মনটাও বিষাদে পূর্ণ হলো।
♠♠
‘আমি জানি কাকতাড়ুয়ার জায়গায় কি আছে।’ হঠাৎ একদিন এন্ডি বলে বসলো।
‘তাই না কি? তো কি করবে এখন?’ স্কিপ বললো।
‘কিছু না। কিছু না।’ এন্ডি হাসিমুখে জবাব দিলো।
‘তোমাকে কিছু টাকা দিলে কেমন হয়? মনে করো উপহার দিচ্ছি — নিজেকে শান্ত রাখার জন্য। কি বলো?’
‘না স্যার।’ এন্ডি আস্তে আস্তে বললো, ‘আপনি যা ভাবছেন আমি সেরকম মানুষ নই।’
স্কিপ কিছুটা দমে গেলেন। তিনি সারা জীবন সেই সব মানুষকে দেখে অভ্যস্ত । অর্থের প্রতি যাদের মনোভাব — চাই, আরো চাই। কিন্তু এন্ডি সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সে একজন ভালো মানুষ।
গাছের শুকনো পাতারা ঝরে পড়ছে। শীতের আগমনী টের পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় বাচ্চারা খুব হৈ হুল্লোড় করে হ্যালোয়িন সন্ধ্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লোকজন বিশেষ পোশাক পড়েছে। বিশেষ রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। খোলা জায়গায় বড় বড় অগ্নিকুন্ড ঘিরে মানুষ নেচে গেয়ে উল্লাস করছে। ঐ সন্ধ্যাতে কেবল স্কিপের বাড়িটাই জনশূণ্য। ফ্রসবাইদের বাড়িতে পার্টি চলছে — এত দূর থেকেও নাচ গানের সুর তার কানে ভেসে আসছে। তিনি কল্পনায় মেয়েকে দেখতে পেলেন। সে নাচছে, আনন্দ করছে। জীবনে প্রথমবারের মত নিঃসঙ্গতা তাকে পেয়ে বসলো। তিনি প্রবল তৃষ্ণা অনুভব করলেন। কিন্তু মদ ছাড়ার প্রতিজ্ঞা
ভাঙবেন না সিদ্ধান্ত নিলেন।
মাঠের ভিতর দিয়ে চলমান এক টুকরো আলো স্কিপের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কি ঘটছে দেখার জন্য তিনি বাইরে তাকালেন। এক সারি মানবমূর্তিকে দেখা গেল একটা লন্ঠণ হাতে মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একই সাথে ভয় এবং ক্রোধের মিলিত স্রোত স্কিপের সারা শরীরে বয়ে গেল। এরা তার জমির উপরে কি করে! এদের কোন অধিকার নেই এখানে আসার! ছায়ামূর্তির আকার আকৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা বাচ্চা কাচ্চাদের দল।
তিনি ছুটতে ছুটতে দোতলা থেকে বাইরে চলে আসলেন।
‘এই তোরা কি করছিস?’ স্কিপ চিৎকার করতে লাগলেন। ‘ভাগ বলছি আমার জমি থেকে।’
বাচ্চাদের দলটার কাছে তার চিৎকার পৌছালো না। তারা একসাথে গলা মিলিয়ে গান গাইছে,
‘চলো সবাই আগুন জ্বালাই কাকতাড়ুয়াতে…’
‘আমার জমি থেকে চলে যা।’ স্কিপ হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাঁটুতে ব্যাথা পেলেন। এই বার বাচ্চারা তাকে শুনতে পেয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন। কিন্তু দলটা থামবে না। তিনি যাওয়ার আগেই ওরা আসল জায়গায় পৌছে যাবে। তিনি তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেলেন। তারা পৌছে গেছে!
এরপর আরো কয়েকটি চিৎকার শোনা গেল। আনন্দমিশ্রিত ভয়ের চিৎকার। হয়তো বাচ্চারা শরীরটা ছুঁয়ে দেখছে।
স্কিপ ঘরে ফিরে এলেন। পরিস্থিতি পুলিশের মামলার থেকেও খারাপ। প্রতিটা বাচ্চা তাদের বাবা মাকে বলবে তারা কি খুঁজে পেয়েছে। এটাই শেষ সীমানা — স্কিপ বুঝতে পারলেন। জীবনে বহু মানুষকে এখানে পৌছাতে দেখেছেন। বহু মানুষকে জানেন যারা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলো।
স্কিপ নির্দ্বিধায় বন্দুকটা তুলে নিলেন। নলের শেষ প্রান্ত মুখ স্পর্শ করলো। ট্রিগারের আঙ্গুল চেপে বসলো। বাচ্চাগুলো যখন মাঠ দিয়ে ছুটে আসছে ততক্ষণে স্কিপ ধরা ছোঁয়ার বাইরে পৌছে গেছেন।
গ্যারেজের উপর নিজের ঘর থেকেই এন্ডি গুলির শব্দ শুনতে পেলো। বাচ্চাদের দৌড়ে মাঠ পার হতে দেখলো। এর আগে মালিকের চিৎকারও শুনতে পেয়েছিলো। পুরো ঘটনাটি বুঝতে তার কোন অসুবিধা হলো না।
এন্ডি ধীরে সুস্থে মূল বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। তাকে এখন পুলিশকে ফোন করতে হবে। সে একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। কাকতাড়ুয়ার লাশ সম্পর্কে সে কি কিছু জানতো! সে তো ঐ সপ্তাহে বাড়িতেই ছিলো না। জানবে কি করে!
অনূদিত গল্প: একজন রাগী মানুষ
মূলগল্প: স্লোলি স্লোলি ইন দ্যা উইন্ড (১৯৭৯)
লেখক: প্যাট্রিসিয়া হাইস্মিথ