পিয়ারি বেগম
আমার একটি গল্পের নায়িকার নাম ছিল অমৃতা। অমৃতা একটি ছেলেকে ভালবাসত। দুজনের বিয়ে হবারও কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই অমৃতা কর্কটরোগে মারা যায়। ছেলেটি পরে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে। চেতনে অবচেতনে ছেলেটি তার স্ত্রীকে অমৃতা, মিত্রা নামে সম্বোধন করত। গল্পের ক্লাইমেক্স সেখান থেকে শুরু।
আজ কয়েকদিন ধরে আমাকে অমৃতা সিন্ড্রোমে পেয়ে বসেছে।
মিত্রা, তোমাকে দিব্য দেখতে পাচ্ছি আবার। আবার কত আঁধার দুহাতে সরিয়ে দিয়ে তুমি হেঁটে হেঁটে ফিরে এসেছ আমার এই জীবনে।
মনে আছে সেই কত বছর আগের কথা?
আমরা যখন নবাব বাড়ির গেটের পাশে দিয়ে হেঁটে যেতাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে। তখন অন্দরমহল থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ কানে আসত। ভিতরে যে কে পায়েল পরে নাচত!! আমরা তা দেখতে পাইনি কখনও। কিন্তু, তুমি উঁকি দিয়ে দেখতে চাইতে, কোন্ সে নর্তকী?
পিয়ারি বেগম।
জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে হরিমতি বাঈজীর কাছে রক্ষিতা হয়ে থাকত পিয়ারি। প্রতিদিনের অভ্যাস মত সকালে ভৈরবী রাগে গান গাইত ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে জিন্দা বাহার গলি কানায় কানায় ভরে উঠত। আরও একটি গান পায়েলের ঝুমুর শব্দের সাথে শোনা যেত —
‘প্রভু মোর অবগুন চিতনা ধর
সমদরশি হ্যায় নাম তোমার
এক লহো পুজামে রহত হ্যায়
এক রহো ঘর ব্যাধক পরো
পরলোক মন দ্বিধা নাহি হ্যায়
দুই কাঞ্চন করো।’
মিত্রা, আবারও ইচ্ছা করে অস্তরাগের কোনও বিকালে তোমাকে নিয়ে বসি ওয়াইজঘাটের অদুরে সেই শান বাঁধানো ঘাটে। যে ঘাটে অনেক বছর আগে কত হেমন্ত বিকালে কমলা রঙের রোদ মেখে নবাব বাড়ি থেকে এসে বসত পিয়ারি বেগম। পিয়ারির মুখটি ছিল অবিকল ছবির মত, থুতুনিটি ঈষৎ তীক্ষ, ঠোঁট দুটি যেন কোয়ারিতে রাখা করবী। তার নাকের প্রতিটি নিঃশ্বাস বুড়িগঙ্গার মলয় বাতাসে মিলিয়ে যেত। ওর শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়ান। এমনই মসৃন তার ত্বক। পাকা পাতি লেবুর গায়ে হাল্কা গোলাপী রঙের পোচে যে রঙের মিশ্রন হয় ঠিক তেমনই ছিল তার গায়ের রঙ। তার নীল কালো চোখ দুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে থাকত।
তুমি কী আমার সেই রূপ ঝলসিত একজন পিয়ারি বেগম?
না মিত্রা, তুমি পিয়ারি বেগম নও। তুমি অমৃতা। যাকে আমি ফিরে পেয়েছি পূর্ব জীবন থেকে এই পর জীবনে। স্বপ্নের কোন্ ইন্দ্রলোক থেকে তুমি ফিরে এসেছ। তোমার চোখের আলোয় যে দ্যুতি ছড়ায়, তা আমাকে পথ দেখায় নতুন জীবনের।
আর কোনও কর্কট তোমাকে দংশন করতে পারবে না। কত পথ চলতে বাকী। কত ফাল্গুনপূর্ণিমায় আমরা চলে যাব চন্দ্রঅভিসারে। কী সব পাগল করা স্বপ্ন দেখি দুচোখ ভরে। তুমি বলো, আর কী কোনও জেসমিন আমাদের মাঝে আসবার দুঃসাহস কী রাখে?
এই যে আমার পরাবাস্তব কথা বার্তা সবই কী মূল্যহীন? কোনও অর্থ কী নেই এই প্রেমের? না গো, অর্থ আছে।’ মোর ভাবনারে একি হাওয়া লাগল দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।’;আর কোনও কথা নয় মিত্রা। এখন তুমি —
‘আমার তনু তনুতে বাঁধনহারা
হৃদয় ঢালে অধরা-ধরা,
তোমার চরণে হোক তা সারা,
পূজার পুণ্য কাজে।
তোমার বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ
সংগীতে বিরাজে।’