সোহান যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, তখন তার বয়স বারো। এই বয়সের একটি ছেলে যা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তার কোনটাই সোহানের মধ্যে ছিলো না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, বা টিভি দেখা–কোনটাই না। শুনতে অবাক লাগবে, সোহান প্রতিদিন সকালে সোয়া কিলোমিটারের মতো হাটে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নয়, পত্রিকা পড়তে! সোহানদের পরিবার স্বচ্ছল ছিলো। তারপরেও প্রতিদিন একটা পত্রিকা কেনার চাইতে সোয়া কিলোমিটার হাটা তার জন্যে অনেক সহজ কাজ।
.
যে দোকানে সোহান প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার জন্য যেত, সেই দোকানের মালিকের নাম মহসীন মিয়া, সোহান ডাকে মহসীন আঙ্কেল। তিনি একদিন গর্বের সাথে সোহানকে বলছেন, “বুঝলে সোহান, আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, যারা প্রতিদিনই নতুন কিছু জানতে চায় তারাই পত্রিকা পড়তে পছন্দ করে।”
বলা বাহুল্য, মহসীন আঙ্কেলও পত্রিকা পড়তে পছন্দ করতেন।
.
সকালের অনেকটা সময় সোহান দোকানের সামনে রাখা কাঠের চেয়ারটি দখল করে পত্রিকা পড়া শেষ করে। তাতে অবশ্য মহসীন আঙ্কেল কখনও রাগ করতেন না। সোহানের মনে হতো, মহসীন আঙ্কেল তাকে কিছুটা স্নেহ করেন। কারণ অনেকবার সোহান দেখেছে, পত্রিকা পড়া অবস্থায়ও তাকে দেখে মহসীন আঙ্কেল হাসিমুখে পত্রিকা দিয়ে দিয়েছে।
.
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। সোহানের অন্য বন্ধুরা আড্ডা, টিভি দেখা আর কম্পিউটার গেমস্ নিয়ে ব্যস্ত। আর, সোহান একটি কাঠের চেয়ারের উপর বসে পত্রিকা হাতে নিয়ে দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিচ্ছে!
.
দুই.
পনের বছর পরের কথা। সোহান এখন একটা প্রিন্টিং প্রেস চালায়। মাস্টার্স পাশ করার পর সে ব্যবসায় মন দিয়েছে; চাকরি খোঁজার জন্য কখনও অন্যের প্রতিষ্ঠানের দিকে পা বাড়ায়নি। এমনকি মহসীন আঙ্কেলের দোকানের দিকেও আর যাওয়া হয়নি।
.
নভেম্বর মাসে যখন শীত পরতে শুরু করে, তখন বিকেলের পর লোকজনের ভিড় বেশী থাকে না। তেমনি এক বিকেলে বারো-তেরো বছর বয়সি একটি ছেলে তার প্রেসে এসে সামনে রাখা কাঠের চেয়ারটায় সন্তর্পণে বসলো। জিজ্ঞেস করলো, “আঙ্কেল, পেপারটা একটু পড়ি?”
.
সোহান পত্রিকাটি ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিল।
সোহান অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো এই ছেলেটিও তার মতো পত্রিকা পড়ার সময় মাথা ঝুকে রাখে।
.
ছেলেটি একমনে পড়ছে। মাঝখানে একবার সে তার চশমার কাঁচ মুছলো। কি আশ্চর্য, মহসীন আঙ্কেলের দোকানে পত্রিকা পড়ার সময় সোহানও ঘন ঘন চশমার কাঁচ পরিস্কার করতো!