স্বপ্ন

দোতলা বাড়িতে আমরা দুজন মাত্র মানুষ, আমি আর মা। ক’দিন হলো একজন গেস্ট এসেছেন আমাদের বাড়িতে। গেস্ট রুমে থাকছেন।

“তুমি ওঘরে যাবে না। তুমি যা করছো ঠিক করছো না। এটা আমি একেবারেই মানতে পারছি না।”
মা এ কথা গুলো বলতেই আমি থেমে যাই। মা বরাবরই অল্পভাষী মানুষ। আমি মায়ের পেছনে ঘুরে ঘুরে তাকে মিথ্যে বোঝাতে থাকি “তুমি যা ভাবছো আসলে সেরকম কিছু না মা।আমি আসলে কিছুই ভাবিনি, কথা বলতে ভালো লাগে আরতো কিছু না।” মা মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না উনি বললেন, “আমি বুঝি আমাকে বোঝাতে এসো না এসব।”
সকালের এই আলাপচারিতার পর থেকে মন ছুটে গেলেও; সে ঘরের দিকে এক পা-ও বাড়াইনি আমি
বিকেল পর্যন্ত।

আজ বিকেলটাও কেমন যেনো, মনে হচ্ছে হুট করে মিলিয়ে যাচ্ছে। বিকেলে থেকে সন্ধ্যা এই সময়টুকু কোনো কাজ করা আমার একেবারে পছন্দ নয়। এটা আমার একান্ত নিজের সময়। আজ হঠাৎ মা বললেন আমাকে বাইরে যেতে হবে। কোথায় যেনো কি কি পাঠাবেন। পাড়ার পরিচিত অটোওয়ালা মিজানকে খবর দেয়া হয়েছে এবং তাকে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আমাকে শুধু জিনিস পত্রের সাথে যেতে হবে। এটুকু শুনেই, মায়ের ওপর একরাশ অভিমান নিয়ে আর কোনোকিছুই জানতে চাইলাম না। ভাবছিলাম কাপড়টা পাল্টে নেবো, এর মধ্যেই মা ডাকতে শুরু করলেন; মিজান নিচে অপেক্ষা করছে আর সন্ধ্যে হয়ে আসছে দ্রুত বের হতে হবে।আমি যা পরে ছিলাম তাই পরেই নেমে গেলাম। নিচে নেমে দেখি অটো জুড়ে আছে বেশ কিছু চট দিয়ে মোড়ানো বক্স শুধু আমার বসার জায়গা টুকু বাদ রাখা হয়েছে। আমি অটোতে উঠে বসার সাথে সাথে মিজান পিছনে ফিরে একগাল হেসে বলল “আপা আপনার কিচ্ছু করা লাগবে না, খালাম্মা আমাকে সব বুঝায়ে দিছেন। আপনি খালি সাথে যাবেন। কোনো অসুবিধা হবে না। “আমার চেহারায় হয়তো আমার মনের অবস্থা প্রকাশ পাচ্ছিলো; কি জানি! বিকেল হারিয়ে অন্ধকার হচ্ছে আমি তার মাঝে ডুবে আছি। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার পায়ে স্যান্ডেল নেই তাড়াহুড়ো করে নামার সময় ভুলে গেছি। একটু অস্বস্তি হলো। আমি ভাবলাম আমাকে তো কোথাও নামতে হবে না মিজানই সব করবে অতএব স্যান্ডেল নিয়ে আপাতত চিন্তা না করলেও চলবে। আমি আবার একটু অন্য ভাবনায় ডুবলাম। ভাবলাম ‘তাকে বললেও হতো; সে যদি আসতো তবে কিছুটা সময় আমাদের হতেই পারতো।এতো জিনিষের মাঝে হয়তো খুব কাছ ঘেষে বসা হতোনা আমাদের, তাতে কি; এই ঠাসা জিনিষপত্রের দুই প্রান্তেই না হয় দুজন থাকতাম তাওতো থাকতাম।’ এসব ভাবতে ভাবতেই মফস্বলের রাস্তা ছেড়ে চলে এলাম একটু গ্রামের রাস্তায় এবড়ো খেবড়ো দু ধারে ফাঁকা ফাঁকা কিছু তাল গাছ। পথটা আমার চেনা। আমার মায়ের মামাতো খালতো এবং নিজেরো দু একজন ভাই বোনের বাড়ি এদিকে। তখন ধারনা করলাম মা হয়তো উনাদের ওখানেই কিছু পাঠাচ্ছেন। এই গ্রামের পথ, তাল গাছ, ঘন সন্ধ্যা এসব দেখতে দেখতে মন যে কখন ভালো হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি।মায়ের ওপর অভিমান নেই, স্যান্ডেল ছাড়া চলে আসার অস্বস্তি নেই, কিচ্ছু না। মফস্বলের এই অটোগুলোর একটা সুবিধা হলো দুদিকে কোনো দরজা থাকেনা পুরোটা খোলা, আমার খুব ভালো লাগে। আমার ইচ্ছে করছিলো ঐ খোলা জায়গাটা দিয়ে মাথা বের করে চোখ বন্ধ করে গ্রামের সন্ধ্যার গন্ধটা নিতে।একটু নড়া চড়া করতেই মিজান বলে উঠলো “আপা একটু শক্ত হয়ে বসেন রাস্তাতো ভালো না; আর একটু জনমানবহীন; ঘরবাড়িও নাই বেশি।” আমি যখন সন্ধ্যার গন্ধ নিয়ে মত্ত বিপত্তিটা ঘটলো ঠিক তখনি, হঠাৎ দেখলাম প্রকান্ড এক আকাশসম কালো ষাঁড় বাঁধা কারো বাড়ির পাশে, সে রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে দাড়িয়ে আছে। আমাদের অটোর আলোতে মনে হলো ক্ষেপে গিয়ে অটোর দিকে খুব জোরে তেড়ে আসতে লাগলো। আমিতো ভয়ে মিজান কে বলছি “মিজান অটো ঘোরান সামনে যেয়েন না” মিজান বলতে লাগলো ” আপা কিছু করতে পারবে না দড়ি দিয়ে বাধা আছে” একথা বলতে না বলতেই দড়ি ছিঁড়ে ধেয়ে আসতে লাগলো। মিজান তখন পড়িমড়ি করে অটো ঘুরিয়ে পাশের ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে অটো চালাতে থাকলো আর বললো”লাইট এর জন্য ক্ষেপছে মনে হয়।” আমি ভয়ে হিম হয়ে পিছন ফিরে দেখলাম ষাঁড়টি আগুন চোখ নিয়ে দৌড়ে আসছে, যেনো পেলেই দুমড়ে মুচড়ে ফেলবে আমাদের।হঠাৎ অন্ধকারের মাঝ থেকে এক লোক এসে দড়ি ধরে ফেললো এবং খুব কসরত করে তাকে থামিয়েও ফেললো কিছুটা। মিজান অটো থামালো।আমরা আস্বস্ত হলাম লোকটিই ষাঁড়টির মালিক আমাদের ভয়ও কিছুটা প্রশমিত হলো। লোকটি ভিষন ভারি এবং চাপা কন্ঠে বলতে থাকলো”কি হইছে তর,এমন করোস কেন?”তোরে না কইছি এমন করলে রাখমু না তরে,বেইচা দিমু।”আর আমদের বললো “আপনারা যান এইখান থিকা।”
ষাঁড়টি গো গো করছিলো তখনো। আমার কেনো যেনো মনে হলো ষাঁড়টি লোকটির সাথে কথা বলছে আর তা স্পষ্ট মানুষের ভাষায় কিন্তু মিজানের অটোর শব্দে কথাগুলো আমি বুঝতে পারিনি।মিজান হয়তো বুঝেছিলো কিছু, সে দ্রুত অটো চালাতে লাগলো। আমাকে বললো”আপা আজ আর যাওয়ার দরকার নাই, খালাম্মারে বলবো অন্য কোনদিন আমি যায়ে দিয়ে আসবো সবকিছু।আজ বাড়ি চলেন।” আমি তখনও ঐ দুজনের কথপোকথনের কথা ভাবছি; ভাবছি ষাঁড়টি কি কথা বললো যদি বুঝতে পারতাম।মিজান হঠাৎ আবার বলে উঠলো “এইসব মানুষ গুলা খুব ভালো না আপা তন্ত্রমন্ত্র যানে কিছু, ভেলকি বাজি দেখায় মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা হাতায়া নেবার ধান্দা আর কিছুনা।” আমি মিজানের কথা শুনে চুপ করে থাকি। সারাটা পথ আর কোনো কথা হয়না আমাদের। আমি গভীর এক ভাবনা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।
বাড়িতে পৌঁছে দেখি বিরাট হৈচৈ। বেশ কিছু ডালা কুলো, তাতে সাজানো কাপড়চোপড়, ফুলের গহনা কাচের চুড়ি আরও মেলা কিছু।বেশকিছু আত্মীয় স্বজনেরা ঘোরাফেরা করছে ঘরময়। আমি মায়ের সামনে যেতেই দেখি মা ভীষণ সুন্দর হালকা আসমান রংয়ের শাড়ি আর খুব মিষ্টি গোলাপি রং এর ফুল তোলা ব্লাউজ হাতে নিয়ে বসে আছেন। আমি কাছে যেতেই খুব নির্দয়ভাবে ওগুলো আমার হাতে দিয়ে বললেন “এগুলো পরো।” আমি বুঝতে পারছিলাম; আবার না-ও; তারপরও আমি বললাম ” কেনো?” কে একজন বললো আজ রাতে তোমার বিয়ে। এটা আদৌ কেউ বললো, না-কি আমার মন বুঝলো আমি জানিনা। আমি কি করবো আমি বুঝতে পারছি না, আমি ঘোরের মধ্যে মনে মনে অস্থির হয়ে ভাবছি এক্ষুনি তাকে জানতে হবে। আমি আমার ফোন খুঁজতে লাগলাম তন্নতন্ন করে, কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা…..।

#অনুগল্প – স্বপ্ন
____তাসমিন
১৪ মে ২০২২

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত