কিছুক্ষণ আগে,বাজারে যাচ্ছিলো জহুর মৃধা। বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে যেই মাত্র হাঁটা ধরবে বলে মনস্থির করে ফেলেছে- ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে দুইটা অল্পবয়সী ছোকরার ডাকে দাড়ায় জহুর মৃধা। মেজাজটা ছড়ছড় করে চরমে ওঠে তার। ছোকরা দুটির বয়স বড়জোর পনেরো-ষোল হবে। কিন্তু তাকে কিনা নাম ধরে ডাক দিল!
কেডায় ডাকলো আমারে? বিরক্তি চেপে জিজ্ঞেস করে মৃধা।
একজন অপরজনকে দেখিয়ে বলল, আমি না তিনি।
আবার রাগ ওঠে মৃধার। দাঁত খিচিয়ে বলে, তুমি কি তারে আপনি কইরা ডাকো?
জি। উনি আমার অনেক, অনেক বড়। অন্তত দেড়শ বছর। নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয় আগের ছোকরাটাই।
মেজাজ আর সামলাতে পারে না জহুর মৃধা। বেয়াদ্দবের হাড্ডি। ইয়ার দোস্তরে আপনি কইরা ডাকো আর বাপের বয়সী মানুষরে নাম ধইরা ডাকো!
ভুল বুইঝো না মৃধা। ও ঠিকই কইছে। এবার এতক্ষণে নীরব ছোকরা মুখ খুলেছে। কণ্ঠস্বর শুনে মৃধা বুঝতে পারে এই ছোকরাই তাকে নাম ধরে ডাক দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।
এই তোরা দুইজনের বাড়ি কই? কার ঘরের তোরা? বাপের নাম ক দেহি। আশেপাশে লাঠি খুঁজে মৃধা।
আমার নাম কাজেম মৃধা। কী চেনা চেনা লাগে?
বিব্রতবোধ করে জহুর মৃধা। এই দুষ্টু ছেলে-ছোকরারা তার দাদার নাম শিখে এসে দুষ্টুমি করছে নির্ঘাত।
আচ্ছা, আর তোমার নাম?
আমি রাহুল মৃধা। প্রথমটা বলে।
আচ্ছা, ওই কাজেম মৃধা জানি আমার দাদা। কিন্তু তুমি কেডায়? এবার হেঁকে উঠে মৃধা।
আমি তোমার নাতি গো, নাতি। বলে হাসতে থাকে ওই ছোকরা।
এবার নিশ্চিত হল সে এই গরমে তার শরীর খারাপ হয়েছে নিশ্চয়ই নইলে এই দুই ছোকরা কোন মতলব নিয়ে এসেছে এখানে। জহুর মৃধা বিয়ে করেছে বছরচারেক হল। এখন মাত্র তার সংসারে একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। নাতি আসবে কোত্থেকে?
চারপাশে একবার তাকায় সে। প্রচন্ড রোদ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। অবশ্য এই কড়া রোদে কেই-বা আর বের হয় এই ভর দুপুরবেলা।
দুই ছোকরা তাকে টেনে নিয়ে যায় একটা নারকেল গাছের নিচে। জায়গাটা খুব বেশি দূরে না। রাস্তা থেকে উল্টোদিকে। এদিকটায় মানুষজন খুব একটা আসে না। জহুর মৃধা ওখানে গিয়ে কেমন জানি একটা মেশিন দেখতে পায়। তারা তাকে ধরে ওই মেশিনের মাঝে একটা সীটে বসিয়ে দেয়। তারপর একটা লাল বোতামে চাপ দিয়ে ধরে রাখে। কেমন একটা ঝাকি লাগে জহুর মৃধার। তারপর অবাক কান্ড।
গো গো করে মেশিনটা চলতে থাকে আর মৃধার মনে হয় ধীরে ধীরে সে যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে আর পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে কাজেম মৃধা নামের ছেলেটা। আর একি কাণ্ড! সেই ছেলেটা আস্তে আস্তে বড় হতে হতে বুড়ো হতে থাকে এবং তাকে আশ্চর্য করে তার দাদা কাজেম মৃধায় রুপান্তর ঘটে।
জহুর মৃধা নিজে কিশোর বয়সী হয়ে গেলে রাহুল না রুহুলকে খুঁজতে থাকে। কাজেম মৃধা বুঝতে পেরে বলল, জহুর, ওরে এখন দেখতে পাবি না। এখন আমরা পাকিস্তান আমলে আছি। ওর এখনো জন্মই হয়নি- বলেই আরেকটা নীল লিভার চেপে মেশিনটা চালু করে কাজেম মৃধা।
এবার আবার উল্টো ঘটনা ঘটে তবে এবার সে বড় হতে থাকে কিন্তু কাজেম মৃধা ছোট না হয়ে বুড়ো থেকে বুড়ো হতে থাকে। আস্তে আস্তে কাজেম অদৃশ্য হয় আবির্ভাব ঘটে রাহুলের।
এইসব কী হইতাছে ইয়া মাবুদ! জহুর মৃধা চিৎকার করে উঠে।
দাদা, ভয় পেয়ো না। এটা হল টাইম মেশিন।
টাইম মেশিন আবার কিতা?
ওইটা বোঝার দরকার নেই। শুধু জেনে রেখ এটা দিয়ে মানুষ তার অতীত কিংবা ভবিষ্যতে যেতে পারে।
আচ্ছা তাই যদি হয়, দেখচান আমার মরণ কোনদিন হইব?
এটা খুব ভালো প্রশ্ন। আগে টাইম মেশিনে শুধু তারিখে সার্চ দিয়ে নির্দিষ্ট দিন-তারিখে যাওয়া যেত। এখন টাইম-ট্রাভেলাররা ইচ্ছে করলে কোন ব্যক্তির জন্ম-মৃত্যু দিনেও হাজির হওয়া যায়। কিন্তু যেহেতু বায়োলজিক্যালি এখনো আমার জন্ম হয়নি আর তোমারও মৃত্যু হয়নি। ওইখানে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
বুঝলাম, এইসব বাদ দে, আমারে বাড়ি পৌঁছাইয়া দে। আমারে এই গাড়ি থিকা নামাইয়া দে।
আরে নেমেই তো যাবা, তোমাকে চমকে দেব বলেইতো ওয়েলস সাহেব থেকে টাইম মেশিনটা ধার নিলাম। অবশ্য প্রথমে দিতে চাননি। বললেন, পুরনো টাইম মেশিন। কখন আবার বিগড়ে যায়। তার নায়কও একবার সুদূর অতীতে আটকে গিয়েছিল।
ওয়াল সাব আবার কেডা?
ওফ, তুমি চিনবে না। এইচ জি ওয়েলস। তিনিই এর মালিক। ওমা একি! এটা যে থামছে না! এই লিভারটা আলগা হয়ে গেল! রাহুলের কণ্ঠে উদ্বেগ।
জহুর মৃধা বুঝতে পারছে না এটা কোন সময়! বাংলাদেশ আমল, নাকি ভবিষ্যতের কোনো সময়!
______
মাছ কুটে অনেকক্ষণ বসে ছিল জহুর মৃধার বউ। স্বামী গেল বাজারে তরকারি আনবে বলে। যদিও রাহেলা বলেছিল ভর দুপুরে বাজারে যাওয়ার দরকার নাই। বিকেলে গেলেই চলবে। কিন্তু মানুষটা শুনলো না। জল-জ্যান্ত মানুষটা কোথায় যে হারিয়ে গেল কেউ কিছু বলতে পারল না। তাও আজ প্রায় পঁচিশ বছর। অথচ আজ কত আনন্দের দিন। ছেলের ঘরে নাতি হয়েছে একেবারে চান্দের মতন। আকিকা করে নাতির নাম রেখেছে ছেলে।
নামটাও বেশ- রাহুল মৃধা।