স্বপ্ন

চোখ খুলে দেখি ভর দুপুর। মধ্যগগণে সূর্য। ধীরে উঠে বসলাম। চারপাশে তাকালাম। এ কোথায় চলে এলাম! যদ্দুর মনে পরে, কাল রাত্তিরে বোধ করি বধ্য মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই। ধীরে সুস্থে উঠে বসলাম। আমি গ্রামাঞ্চলে চলে এসেছি। কি করে এলাম? মনে নেই। কিছুটা দূরে একটা মুদীর দোকান দেখা যাচ্ছে। আস্তে ধীরে উঠে পা বাড়ালাম। শরীরে রাজ্যের জ্বরতা। মুদীর দোকানে দু’একজন লোক বেঞ্চিতে বসে আছে। দোকানীকে জিজ্ঞ্যেশ  করলামঃ ‘ভাই এটা কোন জায়গা?’ দোকানী মৃদু হাসল। বাকিরাও আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। উত্তর পেলাম না। খানিকটা দূরে কয়েকটা আধপাঁকা ঘর দেখা যাচ্ছে। নিম্নবিত্ত মানুষের পাঁকা ঘর। সেই দিকে পা বাড়ালাম। মাথাটা ধরে আছে।

পথে একজন মুসুল্লীর সাথে দেখা হলো। সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আমাকে এগিয়ে দিলেন। কাগজের ভাঁজ খুললাম। হাসপাতালের স্লিপের মতো দেখতে। কয়েক জায়গায় ছিঁড়েও গেছে। খুবই পুরনো, ঘামে ভেজা, দেখে মনে হলো। স্লিপে কি লেখা আছে পড়ার চেষ্টা করলাম। প্রৌঢ় একহারা শুভ্রশস্রু সৌম্য মানুষটির দিকে তাকালাম। তিনি হাসছেন। স্লিপ পড়ার চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট লেখা। নামের জায়গায় আমার নাম লেখা আছে। এমন লেখা কেন! মনে ভয় জমছে। প্রৌঢ় লোকটির দিকে তাকালাম। অস্থির বোধ করছি। স্লিপের বাকি লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে না। একেবারে ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। লোকটি আমার কাঁধ ছুঁয়ে মৃদুভাবে মাথা নাড়লেন। ধীরে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। স্লিপটির দিকে অপলক চেয়ে আছি। আমি কি মারা গেছি? এটা কি আমার ডেথ সার্টিফিকেট? অনেক কাল কি পেরিয়ে গেছে এরই মধ্যে? মনে ভয় জাগছে। মুখ দিয়ে কি মদের গন্ধ বেরুচ্ছে এখনও? প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি কি তা বুঝতে পেরেছেন? তিনি কি বিরক্ত হয়েছেন? আমি কি মারা গেছি, মাতাল হয়ে? কেউ দেখছি কোন কথা বলছে না! এখানে কি কেউ কথা বলে না?

মন শক্ত করে প্লাস্টার ছাড়া ঘরগুলোর দিকে পা বাড়ালাম। পৌঁছে দেখি জীবন এখানে স্বাভাবিক। অপরিচিতি মুখগুলো যে যার কাজে ব্যস্ত। কেউবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। যেন অতি পরিচিত। আমি তাদের চিনি না। কোত্থেকে ছোট একটি ছেলে এসে আমার হাত ধরলো। হাত ধরে টানলো। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। এই লোকালয়ে কেউ কি কথা বলে না? মৃত্যুর পর এখানেই কি পুনর্বাসন হয়?

ছেলেটি আমাকে একটি ঘরে নিয়ে আসলো। দু’জন মহিলা আমাকে দেখে হাসছেন। যেন আমার আগমনের অপেক্ষায়ই ছিলেন। আমি খাটে বসলাম। ছেলেটি দৌড়ে পালিয়ে গেলো। একজন মাঝবয়শী লোক খুব দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। কি একটা খুঁজলেন, সেটা হাতে নিলেন। হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করলেন। আমাকে দেখে হাসলেন। তার চোখে মমতা খেলা করছিল। তিনি বেড়িয়ে গেলেন। পাশের ঘর থেকে একটি মেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো এসে ঘরে ঢুকলো এরপর। দ্রুত পদে এসে থমকে দাঁড়ালো। আমাকে দেখলো। শান্ত হয়ে আমাকে দেখল এরপর। খুব পরিচিত মনে হলো তাকে। এ কে? কোথায় দেখেছি তাকে? কেউ কথা বলছে না কেন? এই অঞ্চলে কি কেউ কথা বলে না একেবারেই?

বিকট শব্দে বাইরে গাড়ীর হর্ন বেঁজে উঠল। বড় কোন গাড়ী এসে পাশের রাস্তায় থামল মনে হয়। সবাই দৌড়ে বাইরের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েটি আমাকে একবার দেখলো, তারপর সেও পা বাড়াল বাইরে। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। বাইরে এসে দেখি ঝকঝকে তকতকে আনকোরা নতুন একটা বাস এসে থেমেছে রাস্তায়। বাসের কাছে বেশ জটলা। আমাকে অবাক করে দিয়ে বাসের ভেতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাওয়া মানুষের লাশ। পরম যত্নে তাদের বের করে আনা হচ্ছে। দেখলাম কারও মধ্যে কোন ভাবাবেগ নেই। যেন পোড়া মানুষগুলোর এখানেই আসার কথা ছিলো। এখানেই কি তাদের পুনর্বাসন হবে? অপঘাতে মৃত্যুর পর সবাই এখানেই কি চলে আসে?

পাশে ফিরে দেখলাম মেয়েটি দ্রুত পায়ে ঘরগুলোর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। আমিও দ্রুত পা বাড়ালাম। ঘরগুলোর কাছে এসে দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে সে ছাঁদে উঠলো। আমি সিঁড়ির তোয়াক্কা না করে বের হয়ে থাকা ইটগুলো বেয়ে ছাঁদে উঠলাম। এভাবেই বরং তাড়াতাড়ি হলো। ছাঁদে এসে দেখি মেয়েটি ছাঁদের কোনে উপুর হয়ে শুয়ে নীচে মানুষের জটলা দেখছে। একে একে বেড়িয়ে আসছে পোড়া মানুষের লাশ। কতজন মারা গেছে তাহলে? দাঙ্গায় গোটা বাসে কি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো কেউ? মেয়েটির পাশে এসে বসলাম। ছলছলে চোখে মেয়েটি আমাকে দেখছে। এতো চেনা লাগছে কেন তাকে! কোথায় দেখেছি? মেয়েটি উঠে বসলো। শান্ত চোখে আমাকে দেখলো। তারপর চোখ নামালো মেয়েটি। চোখ দুটি বোধ হয় ছলছল করছে এখনও। আমি তার চিবুক ছুঁয়ে তার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলাম। সে আমাকে দেখছে। তার চোখ দুটো আমাকে দেখে নিচ্ছে গভীর মমতায়। এতো পরিচিত মনে হচ্ছে কেন তাকে? এতো পরিচিত! মুখ নীচু করে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। ঘন চুম্বনে আবধ্য হলাম দু’জন। তাকে দেখলাম গভীর মমতায়। তার দু’চোখ বেয়ে ধীরে জল গড়িয়ে পড়ছে। তাকে চিনতে পারছিনা কেন আমি? এত পরিচিত লাগছে, তবুও! তবে কি সে……আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তার চোখ দু’টি এখনও করুনাধারায় প্লাবিত।

 ৩০/০১/২০১৫

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত