কুড়

গল্প–কুড়

মো.রাফসান

গায়ে পৌষের শীত লাগতে শুরু করেছে। জবুথবু সন্ধ্যা। বড্ড বাতাসের তোড়পার চারিদিকে। কাছারি ঘর থেকে যখন মোখলেছ ফিরছিল তখন সন্ধ্যার কালিমা মাখা প্রায় শেষের দিকে। বেশ অন্ধকারই হয়ে গেছে। কর্তাবাবুকে হিসেব বুঝিয়ে দিতে দিতেই যা দেরীটা হলো। কুসুম বলেছিল সন্ধ্যাের আগে আগে ঘরে ফিরতে। মেয়েটা নয় মাসে পরেছে। ওই দিন রাতে ডেকে বলল-“ঘরে জলদি জলদি ফিরবার চেষ্টা কইর। আন্ধার হইলেই আমার কেমন ভয় ভয় করে”।মোখলেছ একগাল হেঁসে বলেছিল-” আন্ধারে আবার ভয় কি? এই গাও গেরামে শহরের মতো কি আর মেলা আলো পায়বা যে রাইতে দিনের মতো মনে হইব। এইডা হইল গিয়া অজ পারা গা। এই খানে আন্ধারই শ্রেয়।”

“আমি এত কিছু বুঝি না। কর্তাবাবুরে বলব যে একটু সক্কাল সক্কাল তোমারে ছাইড়া দিবার লাই।”

মোখলেছ কথাটা কর্তাবাবুকে বলছে ও। তা প্রত্যেকদিন তো আর সন্ধ্যার আগে বের হওয়া যায় না। হাতে মেলা কাজ কাম থাকে। হিসাব মিলানো, কাছারি ঘর গুছগাছ আরো হরেক রকমের।

যখন বড় পুকুরটাকে পার হতে যাবে দেখে এই সাঁঝে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ও কে যেন গোসল করছে। পানির শব্দ শুনা যাচ্ছে। সে একটু এগিয়ে দেখে মতিন মোল্লার মেঝো ছেলে কুদ্দুস গা ডুবিয়ে গোসল করছে। সে কিছু না বলে সোজা বাড়ি মুখো হাঁটা শুরু করল।

এ গ্রামের সবচেয়ে বড় পুকুর এটি। তাছাড়া এ পুকুরের আলাদা একটা নাম আছে। মানুষের মুখে এ পুকুরের নাম কুড়। পাশের তিন চার গায়ে এই নামে বেশ প্রসিন্ধ এ পুকুর। কিভাবে যে এই পুকুরের এমন অদ্ভুত নামের চাউর হলো তা আজও মোখলেছের কাছে একটা বিরাট ধাঁধা। এর ঠিক ইতিহাস কারোর ই জানা নেই। তাছাড়া এ পুকুর নিয়ে নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে লোক মুখে। মেলা বৎসর আগে থেকে নাকি এই পুকুরে কোনো গো মাংস ধুয়া যেত না। কেউ ধুলেই নাকি পুকুরের চারদিকের পারের ভাঙ্গন আরম্ভ হতো। যদিও পুকুরের পানিতে তেমন ঢেউয়ের আদিপত্য নেই। হালফিল অবশ্য মানুষ আর এত কিছু মানে না। যারা মানত তারা তো সেই কবে মাটিতে মিশে গেছে।

যত টুকু পারা যায় মোখলেছ জোর কদমে হাঁটার চেষ্ঠা করছে। শরীরে তেমন শক্তি অবশিষ্ট নেই। সেই ভোরে দু মুঠো পান্তা ভাত মুখে দিয়ে বেরিয়েছিল। দুপুরে যদিও কাছারি ঘরে খেয়ে ছিল। তবে এখন যেন নিজেকে বেশ পরিশ্রান্ত লাগছে। হাঁটতে ও দম বেরিয়ে যাচ্ছে। সে আকাশ পানে একবার চোখ মেলে তাকাল। চাঁদের ক্ষীণ ক্ষয়া আলোতে তার পথ চলা বেশ সহজ হচ্ছে। যদিও চাঁদের আলোটা কেমন অনুজ্জ্বল। এটি হয়তো শীতেরই আগমনির প্রভাব মনে মনে ভাবল সে। প্রকৃতির উজ্জ্বল রুপ আস্তে আস্তে শীত গ্রাস করে নিচ্ছে।

বাড়ি পৌঁছে দেখল কুসুম একটা কুপি জ্বালিয়ে দরজা হাঁ করে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে বাহিরে।

“তা এতক্ষনে তোমার আসার সময় হইছে। পই পই করে কইয়ে দিলাম বেলা থাকতে ফিরবা একটু। সন্ধ্যা উওরাইয়া নিশি রাইত হইবার চলল এহন ফিরলা।” কথা টুকু বলে কুসুম মুখ গুমরা করে ঘরের ভিতর আঁড়ালে চলে গেল। মোখলেছ আর কিছু বলল না। মাইয়া লোক একখান আজব চিজ। বুঝাইলেও বুঝ মানব না। তাই সে আর যেচে জবাব দিহি করতে গেল না। হয়তো মেয়েটা সারা সন্ধ্যা ধরে ভয়ের মধ্যে ছিল। ওদের ঘরটা খানিকটা আলগা জায়গায়। কাছে পিঠে দু চার ঘর যদিও আছে তবে সন্ধ্যার পর চতুর্দিকে এক ধরনের অলৌকিক নিস্তব্ধতা ঝেঁকে বসে।

মধ্য রাত থেকে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। আশপাশ থেকে বাতাসের ফুস ফুস শব্দে কেমন বিধ্বস্ত নগরীর মতো রুপ নিয়েছে বিষ্ঞুপুর গ্রাম। তারই সাথে এক নাগারে মুষলধারে বৃষ্টি টিনের চালে আছড়ে পড়ছে। অসময়ের বৃষ্টি। মোখলেছ একবার ঘর থেকে বেরিয়ে বাহিরের পরিস্থিতি চাক্ষুষ করে আবার ভিতরে চলে গেল। কুসুম জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে চৌকির এক কিনারে।

“তোমার মুখ খান এমন শুকনা কেরে কও দেখি? এমন খুকির মতো ভয় পায়লে চলবে কও?” কথা খানি বলে কুসুমকে কাছে টেনে নিল মোখলেস। কুসুম ও যেন ঘর ছাড়া পাখির ছানার মতো মোখলেসের খোলা বুকে নিজেকে সেঁটে দিল।

“কি কইব কও। দেহের ভিতর আরেকটা প্রাণের জন্ম হইছে। ভয় হয় আমার লাইগা যদি ওর কিছু বিপদ আপদ হইয়া যায়। “

” কিছু হইব না। আল্লাহর ওপরে ভরসা রাইখ। উনার জিনিস উনিই বাঁচাইব। মানুষ আমরা এর একখান মাইধ্যম মাত্র। উনিই এই প্রাণের সৃষ্টি করছে আর উনিই তো এরে বাঁচাই রাখব সক্কল আপদ থাইক্কা। মেলা পেরেশানি করন লাগব না।”

মোখলেছের এমন নির্ভরশীল কথা শুনে কুসুম একটু যেন সাহস পেল ধুকপুক করা বুকে। নিজের হাত দিয়ে পেটে একবাব ছুঁয়ে দেখল। প্রাণটা যেন একটাবার নড়ে উঠল?হয়তো মোখলেসের কথার সম্মতি জানিয়েছে একবার নড়েচড়ে;কুসুম মনে মনে ভাবল। ওই দিকে বাইরের সু সু শব্দ প্রবল হচ্ছে। প্রকৃতির শান্ত শিষ্ট রুপ খোলস ঝরে বেরিয়ে আসছে দুর্বার তেজে।সমানে মেঘের গর্জন আরো প্রকট হচ্ছে। আজ আকাশ যেন তার সমস্ত দুঃখ ঝেরে ফেলবে চোখের জলে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত