শ্যামলী পুজার বাড়িতে এসে বললো, “এভাবে তো আর চলা যাচ্ছে না! কিছু আমাদের সবাইকে মিলে করতে হবে! নয়তো সংসারের এই অশান্তি কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না!”
কিছুক্ষন আগেই পাড়ার তিনটি বাড়িতে কাপড় কেচে, এঁটো বাসন ধুয়ে বাড়িতে ফিরে ভাত রান্না উনুনে বসিয়ে লাউএর ডগা বটিতে কাটছিল পুজা। কাজ করতে করতেই জিজ্ঞাসা করলো, “কেন, আবার কি হলো!”
“আরে এ তো নিত্য দিনের সমস্যা। প্রতিদিনই রাতে মুন্নির বাবা মদ খেয়ে এসে মারধর অশান্তি করছে! কাল রাতে আমাকে এমনভাবে মেরেছে, যে পিঠে কালশিটের দাগ পড়ে গিয়েছে! এই দ্যাখো!” বলে শ্যামলী পিঠের কাপড় সরিয়ে দেখালো পুজাকে। পুজা দেখলো, সত্যি শ্যামলীর পিঠে বড় বড় মারের দাগ! সে কি বলবে! তাঁর সংসারেও তো একই অশান্তি!
শ্যামলীর অবস্থা দেখে উনুন থেকে আধসেদ্ধ ভাতের হাড়ি নামিয়ে পুজা উঠে দাঁড়িয়ে শ্যমলীকে বললো, “চলো তো, গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বারের কাছে! এভাবে আমরা সত্যি আর পারছি না! একটা বিহিত না করলেই নয়! আমার সংসারেও একই অবস্থা। আমার স্বামী তো কাজকর্ম কিছুই করছে না। উল্টে সাংসারের জোয়াল টানতে আমার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে! বদলে আমার কপলেও প্রতিরাতে মারধর জুটছে!”
শ্যমলীও উঠে দাঁড়িয়ে পুজার সঙ্গে রাস্তায় নেমে এলো। পুজা শ্যামলীকে বলে, “চলো তো, বিট্টুর মা’কেও সঙ্গে নিয়ে যাই! ওঁরও তো একই সমস্যা!”
“শুধু কি বিট্টুর মা নাকি! পাড়ার প্রতিটা বাড়িতেই স্বামীরা মদ খেয়ে এসে বৌদের পেটাচ্ছে! সংসারে কোন খরচ দিচ্ছে না! এরকম প্রতি বাড়িতেই তুমি পাবে!” শ্যামলী জবাব দেয়।
পুজা আর শ্যামলী কয়েকটা বাড়িতে ঘুরতেই মহিলাদের দলটা ভারী হয়ে উঠলো। সবার একই বক্তব্য। গ্রামের শেষের দিকে পুকুরের ধারে গজিয়ে উঠেছে চুল্লুর ঠেক। সেখানেই স্বামীরা সারা দিনের রোজগার করা পয়সায় চুল্লু খেয়ে সংসারে এসে অশান্তি করছে।
গ্রাম পঞ্চায়েতের মেম্বার একদল মহিলার অভিযোগ শুনে থানায় খবর দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু বিট্টুর মা বেঁকে বসলো! সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “থানা পুলিশে নালিশ জানিয়ে কিছু হবে না! গত মাসে আমি থানায় বিট্টুর বাবার নামে কমপ্লেন করতে গিয়েছিলাম। পুলিশ তো গ্রামে আসেই নি। উলটে আমার কপালে রোজ রাতে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে!”
বিট্টুদের পাশের বাড়ির সঞ্জয়ের মা বললো, “আমরা জানি কোথায় চুল্লু তৈরি করে ব্যাটারা। আর পুলিশ সে খবর জানে না! আসলে সব মিলেমিশে এক হয়ে আছে! যা করার আমাদেরই করতে হবে!”
পঞ্চায়েত মেম্বার সব শুনে বললেন, “কিন্তু আইন কি নিজেদের হাতে নেওয়া ঠিক হবে! যা করবে, ভেবে চিন্তে করাই ভালো!”
মহিলারা মদ্যপ স্বামীদের অত্যাচারে এতটাই ক্ষেপে উঠেছে, মেম্বারের বাড়ির সামনের গাছ তলায় বসে নিজেরাই ঠিক করে নেয়, চুল্লুর ঠেকই ভেঙ্গে দিতে হবে! তবেই বন্ধ হবে স্বামীদের এই অত্যাচার। পরে যদি ফের চুল্লুর ঠেক গজিয়ে ওঠে, সেখানে যাতে খদ্দের না যেতে পারে, সেজন্য রাস্তায় পাহারা দেবে মহিলারা। রাতের অন্ধকারে যদি কেউ চুল্লুর ঠেকে যাওয়ার চেষ্টা করে, দরকারে রাত পাহারাও দেবে তাঁরা।
সবার হাতে উঠে এলো লাঠি, বটি, দাঁও। একজোটে মহিলারা গ্রামের পিছনের পুকুরের দিকের চুল্লুর ঠেক ভাঙ্গতে রওনা হলো।
তাঁদের নিজেদের সংসারটা তো বাঁচাতে হবে!!