এক লোক—যার নাম মারকাজুল, বয়স—তিরানব্বই, বেশ কবছর ধরে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন।
বহুদিন ধরে তিনি আছেন। পৃথিবীর প্রতি তাঁর মোহ অবশিষ্ট নেই। এখন যেতে পারলেই বেঁচে যান।
নিজ হাতে কফিন ও কাফনের কাপড় কিনে রেখেছেন। নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, পারিবারিক কবরস্থানে—ঠিক তার বাবার পাশে নিজের কবরের জায়গাটিও।
সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি ন্যায্যভাবে ভাগ করে দিয়েছেন। ৫ লক্ষ টাকা রেখেছেন ব্যাংক এ্যাকাউন্টে— তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সংক্রান্ত র্যয়ের জন্য।
মারকাজুল সাহেব সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কিন্তু তার মৃত্যু হচ্ছে না। বরঞ্চ দিনে দিনে তিনি শক্ত- সামর্থবান হয়ে উঠছেন। এই যেমন, গেল শীতে পাড়া-প্রতিবেশিদের মতো তিনি নিজেও ধারণা করেছিলেন, এবার বুঝি তাঁর জার্নি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু না। তিনি দিব্যি রয়ে গেছেন। এবং শীতের পরে বসন্তের আগমনে তাঁর দেহ-মনে নতুন করে চনমনে ভাব ফিরে এসেছে।
কখনো কখনো মনের অজান্তে তিনি গুনগুন করে গান গেয়ে উঠছেন।
কিন্তু যার মৃত্যুর জন্য পুরো এলাকাবাসী প্রস্তুত তিনি যদি গান গেযে ওঠেন সেটা অনেকের জন্য হাসির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাই তিনি গানের কণ্ঠস্বর মিইয়ে দিচ্ছেন। যে গান বাতাসে দোলা দিত সে গান তিনি সংবরণ করে নিচ্ছেন।
ফুল দেখলে পুলকবোধ করছেন। শিহরনবোধ করছেন নীল আকাশে রোদের চলাচল দেখে। বিকেলে জারুল গাছের ফাঁকে গঙ্গাফড়িঙের ওড়াউড়ি দেখে তার মন চনমনে হয়ে উঠছে।
এসব কারণে মারকাজুল সাহেব ভেতরে ভেতের বিব্রত।
এর মধ্যে, তিনি একদিন হাঁটতে বেরিয়ে পড়লেন;— যদিও বাইরে বেরুনো একরকম বাদ দিয়েই দিয়েছিলেন তিনি। তারপরও গেলেন।
একটি দৃশ্য দেখে তিনি থমকে উঠলেন।
মাঠে বেঁধে রাখা একটি গরু কাঁদছে। গরুটির পিঠের উপর চুপচাপ বসে আছে একটি ফিঙে।
জীবনে বহুবার এ দৃশ্য দেখেছেন তিনি। কিন্তু সেদিন তাঁর কাছে ব্যাপারটি অন্যরকম মনে হল। তিনি ভাবতে লাগলেন, গরুর বেদনায় ফিঙেটি নিঃশেব্দে বসে আছে নাকি ফিঙের কষ্টে গরুটি কাঁদছে?
সেদিন বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পরেই মারকাজুল সাহেবের মৃত্যু ঘটে।