টাকার শোক তিনি ভুলতে পারছেন না। তিনি টাকার শোকে ভেঙ্গে পড়েছেন। তিনি পুত্র হারিয়েছেন। কন্যা হারিয়েছেন। ঘর-সংসার সব হারিয়েছেন। কিন্তু সব শোক ছাপিয়ে টাকার শোক তাকে কাবু করে ফেলেছে। তিনি মাঝে মধ্যেই ককিয়ে ওঠেন, “হায়!”
তার এ হেন শোক আরও ঘনীভূত হয় কিছুকাল আগে। তারিখটি তার এখনও মনে আছে। শফিক সাহেবের বাসায় সেদিন দুপুরে খাবার নেমন্তন্ন ছিল। সেই সাথে রাতে একটি অভিজাত হোটেলে ডিনার ইনভিটেশন। দুপুরে তিনি গিয়েছিলেন ঠিকই তবে ঠিকমত খাওয়া হয়ে ওঠেনি। খেতে বসলে এক অতিথি কি এক বিষয়ে ফোড়ন কাটলে তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়েছিলেন। তবে তিনি মনের সাথে যুদ্ধ করেছেন। রাতে ডিনার এটেন্ড করবেন বলে ঠিক করেছেন।
তিনি ভগ্নকুলীন। সময়ের স্রোতে ভেসে গিয়ে আজ কূল মান সব হারিয়েছেন। নিভু নিভু প্রদীপের মত তার শেষ ব্যবসাটি ধরে রাখতে চাইছেন। তার ভেঙ্গে পড়া আর্থিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে তার স্ত্রী তাকে পরিত্যাগ করেছেন। তার স্ত্রী যাবার সময় পুত্র কন্যা উভয়কে সাথে করে নিয়ে গেছেন। অথচ এমন এক সময় ছিল যখন সপ্তাহান্তে তিনি খুব খাবারের আয়োজন করতেন। কাছে দূরে সকলকে নিমন্ত্রণ করতেন। তার সেই দিন আর নাই। আজ তাকে নেমন্তন্নে অপমানে টেবিল ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছে। তার আভিজাত্যে বিষয়টি বেশ বেধেছে। আভিজাত্য আর টাকার সনাতনী মেলবন্ধন সম্পর্কে তিনি খানিকটা ভাবলেন। সন্ধ্যা নাগদ তিনি ডিনারে উপস্থিত হবেন বলে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
সিএনজি করে রওয়ানা হলেন। পথে লাল বাতিতে থামলেন। হলুদ বাতিতে অপেক্ষা করলেন। সবুজ বাতিতে আবার চললেন। আনমনে ভাবলেন, এত নিয়ম মেনেই বা কি লাভ হল। টাকার শোক আবার তার মনে ডানা বাঁধতে শুরু করেছে। তিনি গুনগুনিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করলেন। মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। তিনি ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছেন। পরন্ত সন্ধ্যায় রাস্তায় নিওনের আলোয় তিনি হুঁশ হারালেন। ক্রনিক সাইকোসিস।
হঠাৎ অনুভব করলেন ধূপছায়া আঁধার কেটে তিনি হেঁটে চলেছেন। এরপর মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর পেরিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন। এরপর দূরে দিকবালিকায় দেখতে পেলেন পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক আলোর শহর। আলোর গতিতে পেছনে সরে সরে যাচ্ছে সব। তিনি ছুটে চলেছেন পেছনে ফেলে বন বনান্তর। আঁধার কেটে সূর্য উঠছে এরপর। আকাশে শত সহস্র সূর্য যেন তীক্ষ্ণ আলোয় ঝলসে দিতে চাইছে তার দু’চোখ। তিনি চোখ ঢাকার চেষ্টা করলেন। অনেক পথ পেরিয়ে গিয়ে এরপর তিনি থামলেন। সামনের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেন। আলো ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো। ঘন সূর্যালোক ভেদ করে তিনি দেখলেন দূরে চিরপরিচিত হোটেলটি দেখা যাচ্ছে। শফিক সাহেবের নেমন্তন্ন সেখানেই।
মন্থর গতিতে তিনি হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন। চারিপাশে কেউ নেই, জনশূন্য। হোটেলে পৌঁছে বিশাল দরোজায় কড়া নাড়লেন। গেটে কোন সেন্ট্রি নেই যে দরোজা খুলে দেবে। তিনি ভেতরে ঢুকলেন। এলাহি কারবার। হীরা ঝলসানো আলোয় অভিজাত পুরুষ আর অপসরা প্রতিম নারীকূলের গুঞ্জনে গমগম করছে গোটা হলরুম। কাউকে চেনা যাচ্ছে না। তিনি তাদের ভেদ করে এগুলেন। কেউবা তাকে দেখছে। হলের কোনে যেখানে খাবার পরিবেষণ করা হয়েছে সেই দিকে পা বাড়ালেন। বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা মিঃ শফিকের ডিনার তো!” বেয়ারা মিষ্টি হেসে বললেন, “মিঃ শফিকের ডিনার ঐ দিকে। ওপাশে দরজার ওপারে।”
তিনি সেই দিকে পা বাড়ালেন। হাতল ঘুরিয়ে দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। দেখলেন একটি প্যাঁচানো সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে। আরও নীচে ঘন অন্ধকার। একবার এক পলক তাকালেন পেছনের দিকে। বন্ধ দরোজার তলায় ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলেন। তিনি নামে যাচ্ছেন ধাপে ধাপে।
হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ খুললেন এমনই বোধ করলেন। হুড়মুড় করে উঠে বসলেন। রাস্তার পাশে সিএনজি থামিয়ে ড্রাইভার তার চোখে মুখে পানি ছেটাচ্ছেন। তাকে উঠে বসতে দেখে আশ্বস্ত হলেন। বললেন, “কিছু হয় নাই তো স্যার? আপনি এখন ঠিক আছেন তো!” তিনি মৃদু হাসলেন। এরপর তারা পুনরায় ডিনারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
০১.০২.’১৭