বাদামী তরলে মেটে সাদার শ্বেড কুণ্ডলী পাকাচ্ছে…
অদ্ভুত একটা কাপে করে কফি এলো। এটাকে কাপ না বলে মগ বললে বোধ করি ভুলটা শুধরে নেয়া হয়। হাতলের জায়গায় হাতল ঠিকই আছে তবে সেটা শুরু হয়ে আর শেষ হয়নি। ব্যাপারটা অনেকটা এই রকম যে, পাত্রের কানা থেকে সেটা শুরু হয়ে রুক্ষ একটা বাঁক নিয়ে হঠাৎ থেমে গেছে। না, ভেঙ্গে যায়নি। দেখলে মনে হয়, বুকে ফুলের নকশা আঁকা, নীল উর্দি পরা একজন যুবক। বয়সের সাথে সাথে বোধ করি আমার মনের জড়তার সাথে পাল্লা দিচ্ছে অনুভূতির প্রখরতা।
কিন্তু হাতল আর শরীরের মাঝখানে এই ফারাক কেন? যেন কাপের কাঁধ বেয়ে একটা ছন্দ শুরু হয়ে মাঝ পথে হোঁচট খেয়ে হঠাৎ থেমে গেছে। যেন নীল উর্দি পরা এক তরুন আনমনে কোমরে হাত রাখতে গিয়ে হঠাৎ নিষ্প্রাণ পোরসেলিন হয়ে গেছে। শুধু নীলাভ চকচকে ভাবটা রয়ে গেছে এখনও অম্লান। কিন্তু এর পেছনের কারণটা কি? বোধ হয় পাশে রাখা ত্রিভঙ্গমুরারী কফিপট। বেশ বাহারি। একটা মসৃণ কার্ভ সামনের নলে, আরেকটা হাতলে এবং দুর্দান্ত বাঁকটা পেটের কাছে। ঢাকনিতে চুড়োখোপা, পরনে নীল ঘাগরা, দক্ষিণহস্ত ওপরের দিকে তোলা – হাতে শ্বেত জবার বদলে ধুম্রকুন্ড। আর যে হাতে সিঁদুর বা টিপ পরে, সেই হাত কোমরে। কেটলির ঊর্ধ্বাংশ জুড়ে জোড়া দেয়া ‘Infinity’ চিহ্ন। চুড়োখোপার নীচের অংশটি বেশ প্রশস্ত হয়ে শুরু হয়ে হঠাৎ বিদ্রোহ করে সরু হয়ে গিয়ে আবার মান ভেঙ্গে প্রশস্ত হয়ে – তারপর কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপর পোরসেলিনের কফিপটে ভরতনত্ত্মের মুদ্রা। পাশে বেচারা পেয়ালার হাতের ছন্দ থেমে যেতে তো বাধ্য!
এদিকে ধুম্রকুন্ড মাঝে মাঝে বেশ ছান্দসিক হয়ে উঠছে খোদ কাঞ্চণজঙ্ঘার ভিজে শীতল বাতাসে। উদাত্ত কাঞ্চণজঙ্ঘার বিশালতার খাঁজে, ছোট পাহাড়ের ছোট কফি শপের, আরও ছোট তৈজস্পত্রগুলো সৌন্দর্যের শিখরে পৌঁছে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে – এই পুরো পর্বতারন্যের মতোই। বিশালতার সৌন্দর্য সব কিছুকেই সংক্রমিত করে। আর প্রকৃতি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে সব কিছুকে আপন করে নিয়ে।
‘Let it be…’ তাজা বাতাসে সাঁতার কাটতে গিয়ে আধমরা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজানো Beatles জীবন্ত হয়ে উঠছে। মহয়া ফুলের মালা হাতে একটি আদিবাসী মেয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছে। ফুলগুলো সুন্দর, মালাটি নয়। টয় ট্রেন শিশ দিচ্ছে সমান্তরালে। দু’দিন দাঁড়ি কামানো হয়নি। দাঁড়িগুলোয় পাঁক ধরেছে ঠিকই কিন্তু চোখের মনি আজকাল সারাক্ষণই চকচক করে। আমার ছোট্ট কিউরিও শপের নেপালি ছোকরা তার সরু চোখ দিয়ে নাকি সেটা লক্ষ্য করেছে। একটু নড়েচড়ে বসতেই ক্যানভাসের চেয়ারটাতে মচ করে একটা শব্দ হল। চেয়ারের পায়ার মোচড় সংক্রমিত হল আমার হৃৎপিণ্ডে। মন বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা এই পনেরো বছরে পেয়ালায় রাখা কফির মতোই অব্যাবহারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আর সব কিছুই ঠিক আছে শুধু কফির বাদামী আর সাদার অদ্ভুত শ্বেড তার উষ্ণতা হারিয়ে শান্ত শীতল হয়ে গেছে।
“নমস্কার!” কফির পেয়ালা থেকে চোখ তুলে যাকে দেখতে পেলাম তিনি সোমনাথ। নামের ধ্বংসাত্মক প্রতিরুপের সাথে তার স্থূল শরীর আর চটুল হাসির কোন যোগাযোগ নেই। এই ভদ্রলোকের পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে। চোখে গান্ধী ফ্রামের চশমা, মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ। ইনি আবার কম্যুনিস্ট চারু মজুমদারের খুব ভক্ত। সমস্ত দার্জিলিং শহরে এই একটি মাত্র প্রাণী যিনি প্রবল প্রতাপে ওভারকোটের তলায় ধূতি পরে ঘুরে বেঁড়ান। কাঁচাপাকা দাঁড়ি সমেত বাঁকা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেশ করলেন, “কেমন আঁচেন?” উত্তরের অপেক্ষা না করে চেয়ার টেনে সামনে বসলেন। কফির পটটা নেড়েচেড়ে বললেন, “নায়া চিজ?” কথাটা হঠাৎ অশ্লীল মনে হল। ভদ্রলোক কফি পটটাতে নাক গুঁজে গন্ধ নিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। তারপর কাঞ্চণজঙ্ঘা বরাবর মাথা ঘুড়িয়ে চোখ খুললেন। অস্ফুটে বললেন, “আহ!” এই উচ্ছ্বাসের উৎস যে আসলে কোনটি বোঝা গেলো না।
ভদ্রলোক প্রতিদিনকার মতোই আজও দিনের প্রথম কাপ কফি আমার সাথে সারবেন। গত পনেরো বছর ধরে এই চলে আসছে। একই কফি শপ, একই টেবিল, একই কাঞ্চণজঙ্ঘা – শুধু গরম কফি শেষ করবাব সময়টুকু কেবল দীর্ঘতর হচ্ছে। “অওর কফি লাও!” – খেঁকিয়ে উঠলেন সোমনাথ চাটুজ্জ্যে। তারপর একটু নরম সূর গোপন করে বললেন, “সৈয়দ সাহেব, ওপাড়ের খবর কি? শুনলাম একটা কিছু এবার নাকি হয়ে যাবে?” সূর পাল্টে দাঁত বের করে বললেন, “একবার তো কাঁপিয়ে এঁয়েচেন! আবার movement-এ যোগ-টোগ দেবেন নাকি? এতদিনে হুলিয়া-টুলিয়া সব উঠে গেছে বোধ হয় – হেঃ হেঃ হেঃ!” কিছু না বলে ঠাণ্ডা কফিতে চুমুক দিলাম। সামনের দিকে চোখ তুলে দেখি কাঞ্চণজঙ্ঘার বিপরীতে লাল রঙের সূর্য উঠছে।
২০০০