জীবনের কোনো না কোনো সময় সবারই কিছু না কিছুর নেশা করতে ইচ্ছে হয়। একবারের জন্যেও নেশা করতে ইচ্ছে জাগে নি এ কথা কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না।
বাংলা মদে বুঁদ হয়ে থাকা মফিজ নিজের নেশা করার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চায় সম্ভবত। এত উচ্চমার্গের চিন্তা মাথায় আসাতে নিজেকে নিজে বিদ্রুপ করে সে – ‘কালা মফিজ, এত ভাইবা তোমার লাভ কী? তোমার কাম নেশা করন আর কল্লা নামান’।
টাকরাতে জিভ দিয়ে টক করে একটা শব্দ করে হাত দিয়ে কল্লা নামানোর অভিনয় করে মফিজ। বাবা-মায়ে নাম রাখছিল মফিজ।
গায়ের রঙ মিশমিশে কালো হওয়ায় সবাই ডাকে কালা মফিজ। ভাড়ায় মানুষ মারার কাজে ঝুনা ওস্তাদের সাথে আজ প্রায় দশ বছর। আগে কুলিগিরি করতো। এখন আর শরীরে কুলায় না। তাছাড়া সহজে টাকা কামাইয়ের আর কোন পথ জানা নেই। ঝুনা ওস্তাদ ভালো মানুষ কিন্তু ভীষণ করা মেজাজের! টাকা নিয়ে টালবাহানা করে না ঠিকই, শুধু এক কথা ‘টাকা নিয়া হয় কল্লা নামাইবি, নাইলে আমি তর টা নামামু’। মফিজও আজতক কোনো কথার বরখেলাপ করে নাই।
পকেটের টাকার তোড়াটাতে গভীর স্নেহে হাত বুলায় মফিজ। আহ! টাকা ছুঁয়েও সুখ! একটা মেয়েমানুষের কল্লা নামানোর কন্ট্রাক্ট পেয়েছে কাল। পাঁচ হাজার এডভান্স বাকি পাঁচ হাজার কাজের পর।
শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির পেছনের বস্তিতে মফিজের ঘর। ঘর বলতে বাঁশের কঞ্চি আর পলিথিনের তৈরি মাথা গোঁজার নড়বড়ে একটু ঠাই। ছয় বছর হল, বৌটা মফিজকে ছেড়ে চলে গেছে! আরেক পুরুষরে বিয়া কইরা সংসারি হইছে! আহারে, বড় ভালো আছিল বউটা। খাটনি করতে পারতো খুব। শুধু খিদা সহ্য করতে পারতো না একদম! তখনও এই লাইনে মফিজ খুব বেশি সুবিধা করতে পারে নাই। টাকাও পাইতো কম। অনেকদিন খিদার জ্বালায় কাঁদতে দেখেছে বৌকে।
ঢকঢক করে আরও খানিকটা মদ গলায় ঢালে মফিজ। নাহ, বৌ চলে যাওয়ায় তার কোনো দুঃখ নেই। যে যে যার যার মত ভাল থাকুক। ভালো থাকাটাই জরুরি। বৌটা চলে যাবার পর নিজেকে বরং স্বাধীন স্বাধীন লাগে। মন চাইলে আর হাতে পয়সা থাকলে মাঝেমধ্যে মেয়েসঙ্গও নেয়। পকেটের টাকা ফুরালে সব ফুর্তি শেষ। মদ গিলার পয়সাও থাকে না অনেক সময়। মদের কারবারিটাও আস্ত টেকনা, নগদ ছাড়া সামান্যও দিতে চায় না। তবে মাল ভালোই রাখে ব্যাটা! আজকেরটা ভালোই ধরেছে, মফিজ গাইতে থাকে – ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে…’।
নিজে নিজেই বিড়বিড় করে মফিজ, শুধু গান গাইলে তো চলতো না, যেই টাকা দিয়া ফুর্তি করতাছ, সেইটা তো হালাল করন লাগবো। এবারের কাজটা একটু ইন্টারেস্টিং! জামাই টাকা দিছে বৌরে মারনের লাইগা। অনেক দিন আগে এইরকম একটা কেস পেয়েছিল। আবার একবার পেয়েছিল, বৌ টাকা দিয়ে কন্ট্রাক্ট করেছে জামাইকে মারার জন্য। যাকগে, অতোকিছু ভেবে কাজ নেই। কালা মফিজের কাজ কল্লা নামানো। তবে মেয়েমানুষকে মারা একইসঙ্গে খুব সহজ আবার খুব কঠিন কাজ! মেয়েমানুষ হলো আল্লাহতায়ালার তৈরি সবচেয়ে মহব্বতের জিনিস। মারার জিনিস না।
মোবাইলে সময় দেখে মফিজ। সাড়ে আটটা বাজে। আজ রাতেই কাজটা সারতে হবে। মেয়েটার স্বামী অফিসের কাজে চট্টগ্রামে গেছে। স্ত্রীর মৃত্যুতে যাতে স্বামীপ্রবর সন্দেহের আওতামুক্ত থাকে, সেভাবেই প্ল্যান করা হয়েছে। ‘কত রংগ দেখি দুনিয়ায়…’ গাইতে গাইতে একদলা থুথু ফেললো মফিজ। উঠে দাঁড়াতেই টের পেলো পা টলমল করছে। শালা! আজ মনে মাল বেশি টানা হয়ে গেছে! সামনে রাখা চাটাইয়ের ওপর ধপ করে বসে পড়ে। পাশ থেকে ইট তুলে নিয়ে মাথার নিচে দিয়ে চিত হয়ে শোয়। আহা, আকাশের বুক জুড়ে কোটি কোটি তারা! খোদার কসম, দুনিয়াটা আসলেই খুব সুন্দর! যত অসুন্দরতা সব মানুষের মনে! ‘আইজকা কী হইছে আমার, কেমন ঘোর ঘোর লাগতাছে আর দামি দামি কথা মনে আইতাছে’ – হাসে মফিজ। একটুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে কাজে যাবে বলে সিদ্ধন্ত নিল।
বাড়ির ঠিকানাটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। অপারেশন রাত দুটোয়! ঘুমন্ত দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে ঘরে ঢুকতে তেমন বেগ পেতে হল না। খাবার ঘর পেরিয়ে বামদিকে শোবার ঘর। নীল ডিমলাইট জ্বলছে। হাত দুটো ভাঁজ করে গালের নিচে রেখে ডানকাত হয়ে শুয়েছে মেয়েটা। গোড়ালি থেকে কোমর পর্যন্ত পাতলা চাদর টানা। নিটোল পায়ের পাতাদুটো বেরিয়ে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে বুকটা ওঠানামা করছে! নীল আলোতে ধবধবে সাদা রাতপোশাকটিও নীল দেখাচ্ছে। অনিন্দ্য সুন্দর একটি দৃশ্য! ভারি সুন্দর দেখতে মেয়েটি। এত মেয়ে দেখেছে মফিজ, কিন্তু এত পবিত্রতা আর মায়ার সম্মিলন দেখতে পায় নি কারো মধ্যে। বেহেশতের হুরপরিরা নাকি অসম্ভব সুন্দর। মফিজের কেন যেন মনে হচ্ছে তারা কিছুতেই এই মেয়েটার চেয়ে সুন্দর হতে পারে না। সৌন্দর্যের সাথে পবিত্রতা আর মায়ার মিশেল অপরূপা করেছে মেয়েটিকে। স্বামীটি কেন মেরে ফেলতে চায় এই মেয়েটিকে! মফিজের মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। প্যান্টের পকেটে ধারালো অস্ত্রটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে আবার।
কানে ভেসে আসে ঝুনা ওস্তাদের কথা – ‘হয় ঠিকমত কল্লা ফেলবি, নাইলে তর কল্লা পাইতা দিবি’।
ভোরের আজানের একটু আগে বেরিয়ে আসে মফিজ। ওর মত একজন এই দুনিয়া থেকে মাইনাস হলে তেমন কিছুই এসে যাবে না, তবু পবিত্র, মায়াবী সুন্দরতা বাঁচুক।
বেশ ভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিজেকে তার মানুষ বলে মনে হতে লাগলো!