- বিজ্ঞাপনটা বেশ কয়েকবার চোখে পড়েছে। একটু ভিন্ন। ফেসবুক স্ক্রল করতে গেলেই ঘুরেফিরে বারবার আসছে। ইদানীং বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে। আগে দেখেছে কি’না ঠিক মনে করতে পারছে না মিতু। করোনার কারণে আজ অনেকদিন অফিস বন্ধ। দিনের একটা বড় সময় কাটে ফেসবুকে অনলাইনশপের বিজ্ঞাপন দেখে। শাড়ি আর সালোয়ার-কামিজের লাইভগুলো দেখতে ভালোই লাগে। পড়ালেখার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে, নিজেদের প্রোডাক্ট বিক্রি করতে কত কষ্ট করছে তরুণ-তরুণীরা! কোভিড উনিশ মহামারি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে মানুষকে। মিতু চায়, অনলাইন বিজনেসগুলো দাঁড়িয়ে যাক, নিজেদের মত করে জায়গা করে নিক। গৃহিণীরাও এখন ঘরে তৈরি খাবার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করছে। সাড়াও মিলছে ভালো। টেস্ট চেইঞ্জের জন্য মিতুও মাঝেমাঝে অনলাইনে খাবার কিনে। শাড়িও কিনেছে বেশ কয়েকটা। খারাপ হয়নি কিছু। তরুণ-তরুণীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার প্রচেষ্টাকে সবসময় ইতিবাচকভাবে দেখে মিতু। গৃহিণীরা ঘর সামলে বাড়তি কিছু রোজগারের চেষ্টা করছে, টাকাপয়সা, হিসেবনিকেশ নিজের হাতে লেনদেন করছে-ভাবতে ভালো লাগে। প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে এর কোনো বিকল্প নেই। এটা থাকলে বাকিগুলো অর্জনের পথ সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া নিজের টুকিটাকি শখ পূরণ করতেও টাকার প্রয়োজন। তানভীর পর্যাপ্ত খরচ দেয়। সংসারে টানাটানিও নেই তেমন। দুজনের আয়ে মোটামুটি ভালোই চলে যায় ওদের। তবু মিতুর নিজের আয়ের টাকায় কাউকে কিছু দিতে পারলে আনন্দটা যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। বিশেষ করে তানভীরকে আর নিজের মেয়েটাকে।
- ঐশী, একটাই মেয়ে তানভীর আর মিতুর। খুব আদরের। অনার্স দ্বিতীয়বর্ষে পড়া হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েটি করোনা আসার পর থেকে ঘরে বন্দী। কতদিন আর ভালো লাগে। প্রথম প্রথম এনজয় করলেও কয়েকদিন ধরে খুব বিরক্তিবোধ করছিল। ছোট মানুষ। ওর আর কী দোষ। মিতু নিজেও হাঁপিয়ে গিয়েছে। শুধু তানভীরের অফিস খোলা। ওরা দুজন একদম ঘরে বন্দী। মা-মেয়ে দুজনে মিলে এই সুযোগে ভালো ভালো কিছু মুভি দেখে ফেলেছে। ইদানীং মুভি দেখতেও ভালো লাগছে না। গতকাল নিজে থেকেই যখন ঐশী নানুর বাড়ি গিয়ে দু’চারদিন থাকতে চাইলো, ওরা কেউ আর নিষেধ করতে পারলো না। বেড়িয়ে আসুক বেচারা। সারাটাদিন বাসায় থেকে থেকে বোর হয়ে গেছে। সত্যিই! অসহ্যকর হয়ে উঠেছে মিতুর দিনগুলোও। অনলাইনে অর্ডার করে বাতিঘর থেকে বইও কিনেছে অনেক। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছে না। নিরবচ্ছিন্ন অবসর যে এতো বিশ্রীরকমের বিরক্তিকর, এ অবস্থায় না পড়লে জানা হতো না। অথচ কতটা দিন কাজের চাপের ফাঁকে একটু অবসর চেয়েছে, বই পড়ে শেষ করতে, মুভি দেখতে। এখন অফুরান অবসর পেয়েও কিছুই ভালো লাগছে না। মানুষ বড় অদ্ভুত। বড় অদ্ভুত মানুষের মন।
বিজ্ঞাপনটার দিকে আবার চোখ পড়ল মিতুর।
“বডি-ম্যাসাজ চিটাগং- লেডিস অনলি”
‘ইফ ইউ ওয়ান্না রিসিভ আ প্রফেশনাল ম্যাসাজ সার্ভিস ফ্রম আ সার্টিফাইড ম্যাসেস, প্লিজ ইনবক্স আস। ওয়ান আওয়ার বডি ম্যাসাজ স্টার্টিং ফ্রম সেভেন হানড্রেড টাকা অনলি। - *ম্যাসাজ উইল বি ডান বাই সার্টিফাইড মেইল ম্যাসেস*’।
‘ম্যাসাজঃ আ সিক্সটি-মিনিট ভ্যাকেশন। নো কিডস, নো ফোন, নো ইমেইল, নো মেইল, নো হাউজওয়ার্ক, নো ট্রাফিক, নো স্ট্রেস!’
স্কেজিউল ইওর নেক্সট মিনি-ভ্যাকেশন টুডে! - বেশ কয়েকবার গভীর মনোযোগের সাথে বিজ্ঞাপনটি পড়ল মিতু। সাহসী বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মতো জায়গার জন্য। ঢাকার অভিজাত কিছু এলাকায় মেয়েদের জন্য এরকম সার্ভিস আছে বলে শুনেছে, তবে সত্যি না মিথ্যা তা জানে না। মানুষ তো অনেক কথা রঙ চড়িয়ে বলে। কিন্তু চট্টগ্রামে পুরুষ দ্বারা বাসায় গিয়ে নারীদের বডি-ম্যাসাজ দেয়ার কথা এই প্রথমবারের মতো জানলো মিতু। অস্বস্তির সাথে সাথে একটু শিহরিতও হলো। কী মনে করে যেন একদম ঝোঁকের মাথায় ম্যাসেজ করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স এলো। মিতু জানতে চাইলো, ম্যাসাজের জন্য ফিমেল ম্যাসেস পাওয়া যাবে কিনা? উত্তরে খুব সুন্দরভাবে জানালো, পেশাগত সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে তারা হোম-সার্ভিস দিয়ে থাকে। পুরুষ দ্বারা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ তারা পাননি এবং সফলতার সাথে তাদের সার্ভিসটি দিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন থেকে। সবধরণের গোপনীয়তা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করারও অঙ্গীকার করলো। মাথায় যেন ভূত চাপলো হঠাৎ! দুম করে ঠিকানা আর ফোন নাম্বার ইনবক্স করলো মিতু। মিতুকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল হাতের ফোন। সার্ভিসটি আপনি কখন নিতে চাইছেন, ম্যাম? ও প্রান্ত থেকে ভারী শোনালো পুরুষালী কণ্ঠস্বর। এখনই, এইমুহূর্তে। ওকে ম্যাম, আমি নিজেই আসছি, জাস্ট ফিফটিন মিনিটস প্লিজ।
সারাশরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল মিতুর। এই ঠাণ্ডাতেও কুলকুল করে ঘামতে লাগলো। বাসার কাপড়েই ছিল, ঢোলা ট্রাউজার আর টি-শার্ট। উপর থেকে টি-শার্টের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে নিলো, গাঢ় নীলরঙের ব্রেসিয়ার পরনে। মিতুর বুকটা বেশ ফর্সা। নীলরঙে তাই সুন্দর দেখাচ্ছে। অস্থির পায়চারিতে পাঁচ মিনিটেই যেন কেটে গেল ফিফটিন মিনিটস। ডোরবেলের শব্দটা প্রথমবার মিস করলো মিতু। দ্বিতীয়বার বাজতেই স্মার্টলি দরজা খুলল। লম্বা, স্বাস্থ্যবান, শ্যামবর্ণের এক তরুণ দাঁড়িয়ে। মুখে মাস্ক থাকায় চেহারাটা সম্পূর্ণ বোঝা গেল না। তবে বুঝতে পারলো, মেয়ের বয়সী না হলেও অনেক ছোট হবে মিতুর। ভদ্রভাবে ডাকলো, ম্যাম! দরজা থেকে সরে জায়গা করে দিলো মিতু। হাতে স্টেরিলাইজার মাখতে মাখতেই ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো, সার্ভিস কোন রুমে নিবেন, ম্যাম? মিতু ওকে অনুসরণ করতে ইশারা করলো।অন্যান্যদিনের চেয়ে আজ একটু আগেই ফিরলো তানভীর। দুজনে একসাথে বারান্দায় বসলো। হালকা নাস্তা আর চা খেল। ঐশী বাসায় নেই বলে একটু ঘনিষ্ট হয়ে বসলো দুজন। মিতুর নরম চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, আজ তোমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। চোখেমুখে যেন প্রাণ টিকরে বেরুচ্ছে । লাবণ্যে ঝলমল করতে করতে মিতু বললো, হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছে, শরীরে যে জং ধরে গিয়েছিল তা যেন আজ কেটে গেছে।
নিজের সৌন্দর্যের প্রতি নতুন করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা মিতুকে হঠাৎ খুব রহস্যময় আর অচেনা মনে হলো তানভীরের!