জুবায়েরের বিয়ে হয়েছে সবে মাত্র মাস পাঁচেক হলো। আজ সকালে বাসায় স্ত্রীর এক ফুফাতো ভাই বেড়াতে এসেছেন। ফুফাতো শ্যালকটির নাম সলিম। সলিম সম্প্রতি একটি বেসরকারী ব্যাংকে চাকুরী পেয়েছে। মফস্বলে জয়নিংয়ের এক মাসের মধ্যেই ঢাকায় হেড অফিসে পোষ্টেড হয়েছে সে। জুবায়ের সলিম সাহেবের এই এক্সট্রা ম্যানেজমেন্ট ক্যাপাসিটি নিয়ে স্ত্রীর মুখে প্রশংসার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হলেও দীর্ঘ লম্বা দু লাইন বাক্য শ্রবন করেছেন এবং বুঝেছেন সলিম এক মাসেরে মধ্যেই যে হেড অফিসে পোষ্টিং করাতে পারে সেইটা তাদের পরিবারের কাছে সলিমের স্বাভাবিক যোগ্যতার পুরাতন বহি:প্রকাশই কেবল।
আগামীকাল সলিমের ঢাকায় জয়েনিং। ইতোমধ্যে সে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটও ভাড়া করেছে। জয়েন করে ধীরে সুস্থে সেখানে উঠবে। ব্যাচেলর মানুষ সে, একা একা বাসায় উঠবে -তার আগে দু’দিন মামাত বোনের বাসায় কাটিয়ে একেবারে সামনের শনিবার থেকে উঠে যাবে ফ্ল্যাটে এমনই পরিকল্পনা। জুবায়েরের স্ত্রীও তাই চাচ্ছিলো। জুবায়েরে না বলার কোন কারণই থাকে না।
জুবায়েরের স্ত্রী মোবাইল থেকে বের করে তাকে একটা ঘোমটা পড়া মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলছিলো, দেখো দেখো ক’দিন আগে সলিমের জন্য পারিবারিকভাবে পাত্রী দেখা হয়েছিলো । দেখো দেখো সুন্দর না মেয়েটা?-বলেই সুন্দর ঠোঁটের কোনে এক ফালি মুচকি হাসি টেনে ধরলো সে।
জুবায়ের হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো সে কথায়।
সলিম জুবায়েরের চেয়ে বয়সে বছর তিন চার ছোটই হবে আর তার নব বধূর থেকে এক দুই বছর বড় হবে। পিঠাপিঠি কাজিন তারা। সলিম ভারসিটিতে ইতিহাসের ছাত্র ছিলো। অন্যদিকে জুবায়ের বিষয় ছিলো মার্কেটিং, বর্তমানে একটি বিদেশি কোম্পানীতে মার্কেটিং ডিভিশনে চাকুরী করছে সে। বিয়ের প্রস্তাবটা এসেছিলো মার্কেটিং হেডের দিকে থেকে। জুবায়েরে ফাদার ইন ল এবং তার অফিস বস পরস্পর বন্ধু, বাল্যবন্ধু। জুবায়েরের বাবা-মা সোজা মফস্বলে তার স্ত্রীদের বাড়িতে চলে গেলেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, বিয়ে পর্যন্ত সব খুব দ্রুত একদম রূপকথার মত হয়ে গিয়েছিলো, কোন বাধা নেই, কারও মানা নেই। থাকারও কোন কারণ নেই, দুই পরিবারই স্বচ্ছল, পাত্রপাত্রী উভয়েই অন্তত এতটুকু সুদর্শন যে কেউ দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকাবেই আর তারোপর জুবায়েরের মোটা মাইনের চাকুরীতো আছেই।
জুবায়ের ইতিহাসের ছাত্র না হলেও স্কুল জীবন থেকে ইতিহাসের প্রগাঢ় পাঠক সে। ইতিহাস নিয়ে জুবায়েরের ভীষণ আগ্রহ এবং প্রচুর পাঠ রয়েছে। সলিম ইতিহাসের ছাত্র হয়ে এখন ব্যাংকার হয়েছে আর জুবায়ের কঠিন মার্কেটিং জবের মধ্যেও উইকিপিডিয়ায় সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায় ইতিহাসের লেজ থেকে লেজে। তাই সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে সলিমের সাথে যখন কথা হচ্ছিলো, স্বাভাবিক ভাবেই চলে এল ইতিহাসের কথাবার্তা । কথায় কথায় সলিম বলছিলো,
-ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখেছি ইতিহাসে দখলদারিত্ব করেছে যে যত বেশি ইতিহাসের পাতায় পাতায় তারই জয়গান আর গুনকীর্তণ তত বেশি। এক রাজা দখল করে রাজা হয়েছে আর তার দশ পুরুষ পায়ের উপর পা তুলে রাজত্ব করেছে। আর ইতিহাস সেই দখলদারির কাহিনীকে অমুকের প্রথম যুদ্ধ, তমুকের প্রথম যুদ্ধ এইসব বলে বলে আমাদের মাথাটা নষ্ট করে দিয়েছে আবার আমাদের সেই সব দখলদারিদের বীর বলে বলে খাতা ভরাতে হয়েছে। পুরাই বোরিং এবং আনজাস্ট ইতিহাস সব।
-এইটার পেছেনে একটা কারণ হলো আমরা এই মানুষ প্রজাতিইতো এই পৃথিবীতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। সেই এককোষী প্রাণী তারপর চতুষ্পদী জন্তু তাদের বিতাড়িত করে করে পুরো পৃথিবী দখল করেছি, এখনও করছি, ইচ্ছেমত উল্টে পাল্টে চলেছি, তাই ইতিহাসেও সেইটা হাইলাইট করে একধরনের সেলফ জাস্টিফিকেশন করি আমরা আরকি। কিন্ত তারপরও দেখেন আমাদের সেই ইতিহাসেই হিটলার, চেঙ্গিস খান এদের দখলদারিত্ব আর ব্রুটালটিকেও তো হাইলাইট করা হয় ও রিপ্রিহেনসিবল হিসাবে দেখানো হয়ে থাকে।
জুবায়ের কথার রেশ ধরে সলিম আবার বলে ওঠে,
-অথচ ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়েই বসে আছে ঐ যে দুজনের নাম বললেন তারা। আবার আপনি যদি ইতিহাসে মহাবীর আর গ্রেট খ্যাত আলেকজান্ডারের কথা ধরেন, সেতো আরও বড় দখলদারি। দখলদারির সেই খেলায় সে কি মানুষ মারে নি? অবশ্যই মেরেছে। তবুও তো সে মহাবীর। আমিতো দেখি সব বীরই দখলদার ইতিহাসে।
– ইতিহাস তো সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতের মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্যেই তো ইতিহাস। দেখেন মানুষতো শিখেছে, এখন তো আর দখলদারিত্ব করছে না, এখন মানুষ সিস্টেমেটিক হয়েছে, জনগণকে আইন আর শাসনে সম্পৃক্ত করত শিখিছে, আরও শিখছে। সামনে আরও শিখবে। ইতিহাস তো এখান মূলত টুল, ভুল দূর করার টুল।
-কিন্তু জুবায়ের ভাই, আসলেই কি দখলদারি কমেছে? পদ্ধতি বদলেছ কেবল। বড় কোম্পানীর দখল করে নেয় ছোট কোম্পানী। এই যে আপনি বিদেশি কোম্পানীর মার্কেটিং করছেন, সেই পণ্য দখলদারিত্ব করছে, দূর্বল দেশি পণ্য হেরে যাচ্ছে। কিংবা সর্ম্পকের ক্ষেত্রেই দেখেন, প্রভাব আর অর্থ যার সে এসে কারও প্রেমিকাকে বিয়ে করে…
সলিমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জুবায়ের স্ত্রী হঠাৎ উদয় হয়ে বলে উঠল, হয়েছেতো, রাখ তোমাদের ইতিহাসের পাতিহাস উদ্ধার, টেবিলে খাবার রেডি, আস দুজনেই খেতে আস…
পরের দিন বৃহস্পতিবার। সকালে জুবায়েরের সাথেই বের হলো জয়েন করতে সলিম। জুবায়ের অফিস যাওয়ার সময় নিজরে গাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে গেলো। সপ্তাহের শেষ দিন, একটু দেরী হয়ে যায় অফিস শেষ হতে।। জুবায়েরের বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে ধরণীর বুকে। আঁধার তার বাড়ীর ভেতরও সে দেখতে পায় বাইরে থেকে। দরজায়ও তালা। মনে মনে ভাব হয়তো দুই ভাই-বোন মিল শপিংয়ে গেছে। কাছে চাবি আছে তাই আর কল দিলো না। দরজা খুলে লাইটটা জ্বালাতেই জুতোর রাখার শেলফটার উপর পেয়ে গেলো চিঠিটা। একটা ভাঁজ মাত্র। স্ত্রীর হাতের লেখা দেখেই চিনলো।
“ আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জুবায়ের। গত পাঁচটা মাস আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সযত্নে রাখার জন্য আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। সলিমের সাথে আমার আশৈশবের প্রেম। দু পরিবারের কেউ কখনও মেনে নেয়নি। আপনাকে বিয়ে না করলে আমার জন্যে আরও দশটা পাত্র রেডি রাখা হয়েছিলো। আমাকে কাউকে না কাউকে বিয়ে করতেই হতো। এখন ভাগ্যের দোষে সেই কেউ আপনি হয়ে গেছেন। ক্ষমা করবেন। আমার দখল পেতে সলিম এমন একটা খেলনা বিয়ের ধকল মেনে নিতে পারবে সেটা আমরা পরকিল্পনা করে ঠিক করেছিলাম। আজ ওর নিজের পায়ের মাটি শক্ত, আামকে দখল করার মত শক্তি সাহস এখন পর্যাপ্ত, আপনার প্রিয় ইতিহাসেও এমন দুঃসময়ে সাময়িক সময়ের জন্য হেরে গেলেও পরে বিজয় হাসিল করার ভরি ভরি উদাহরণ আছে- সলিম বলেছে আমাকে। পারলে ক্ষমা করবেন। আপনার টেবিলের ড্রয়ারে ডিভোর্স লেটার রাখা আছে। সময় করে স্বাক্ষর কর পাঠিয়ে দেবেন। ”
জুবায়ের একটা লম্বা শ্বাস ফেলে ধপ করে চেয়ায়ে বসে পড়তে পড়তে বলে উঠলো – সলিম মিয়ার দখলদারিত্ব তত্ত্বের রূপরেখা তাহলে এই আসলে !