অণুগল্প গ্রুপে ইভেন্ট চলছে। কিন্তু নির্বিকার নবীন অণুগল্পকার রুদ্র মুহম্মদ। কোনো আইডিয়াই মাথায় আসছে না।
মোবাইলের চারকোণা নীলরঙা-গলাকাটা-মাথা নোয়ানো চিহ্নটায় ক্লিক করে সে। উফ, সবাই কী দারুণ দারুণ অণুগল্প লিখছেন!
হঠাৎ ফোনটা হালকা কেঁপে ওঠে।
– কী ব্যাপার রুদ্র দা? এই ইভেন্টে আপ্নে কিছু লিখতেছেন না! আপ্নের কিন্তু এই ইভেন্টে পাঁচটা অণুগল্প লেখতে হইব। ভিডিও কলে একনাগাড়ে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলেন গ্রুপের অ্যাডমিন বিলাল হোসেন।
– কী যে লিখব বুঝতে পারতেছি না বিলাল ভাই। হতাশার সুর রুদ্রের কণ্ঠে।
– শুনেন, এইবারের ইভেন্ট হইলো সেতু নিয়া। সেতু কিংবা ব্রিজ যাই বলেন। তাইলে আপ্নে কিন্তু লেখার বিষয় পাইয়া গেছেন। শুধু এর সাথে মালমশলা যোগ কইরা একটা সুন্দর অণুগল্প লেইখা ফালান।
– বিষয়বস্তু না হয় বুঝলাম। কিন্তু…?
– আরে, কী যে বলেন! আজকে আপ্নারে গল্প লেখা ধরাইয়া দিতেছি। শুনেন, আপ্নে সেতু সম্পর্কে কী জানেন বলেন তো?
– সেতু আর কী? খাল, নদীর উপরে থাকে। মানুষ চলাচল করে। এইতো..
– হ্যাঁ, ঠিক বলছেন। সেতু আসলে দুইটা গ্রাম বা শহররে কানেক্ট করে। ঠিক্কিনা?
– হু।
– আচ্ছা, সেতু হইল। এখন আপনার কাজ- এর দুই পাড়ে দুই গ্রামের দিকে নজর দেওয়া। দুই গ্রামে কয়েকটা চরিত্র ঠিক করা। তাদের নিয়োগ দেন। তারাই তো আপনার গল্পরে টাইনা নিয়া যাইব।
– ভাই, নিজেরে তো অফিসার অফিসার মনে হইতাছে। হাহাহা।
– আরে ভাই, লেখক হইতেছে ইশ্বরের মত। যা খুশি তাই সৃষ্টি করতে পারেন। ঠিক কিনা?
– তা ঠিক।
– এখন আবার আসেন, ওই যে গল্পের সেতু, যেইটা কিনা উপুড় হয়া পইড়া আছে, ধরেন, আপনার ধরলা নদীর উপর। তার একপাশে ইকরতলী, আরেকপাশে রসুলপুর গ্রাম। কিন্তু গল্পের খাতিরে ওই সেতু এখুনি নদীর উপর বসায় দিয়েন না।
– আচ্ছা আচ্ছা। উৎসুক হয়ে শুনেন রুদ্র মুহম্মদ।
একটা সিগারেট ধরান বিলাল হোসেন। তারপর আবার বলতে থাকেন-
– ওই যে ইকরতলী গ্রাম। সেই গ্রামে ধরেন রাহেলা আর ছন্নছাড়া প্রকৃতির সবুজের মধ্যে প্রেম। গ্রামের প্রেম তো, ধরেন তাদের মধ্যে কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ কম। হয়তো ধরলা নদীতে গোসল করার সময় সবুজ তারে ফলো করে। দুইজনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হয়, তারপর একটু হাসি। এই আর কি।
– কী গল্প বলতেছেন ভাই? মনে হইতাছে আপ্নে দেইখা আসছেন। হাহাহাহা।
– গল্প ভিজুয়ালাইজ না করতে পারলে আপ্নে গল্প লেখতারবেন না। বুঝেন নাই? মোবাইলের স্ক্রিনে বিলাল হোসেনের হাসিমুখটা দেখা যায়।
– তারপর?
– তারপরই আসল খেলা। গল্পে এইবার ব্রিজটারে নিয়া আসেন। এমপিরে দিয়া উদ্বোধন করান। নেতা, পাতি নেতাদের দিয়ে শ্লোগান দেওয়ান, বুঝলেন?
– এমপি ক্যান! দরকার হইলে মন্ত্রী নিয়া আসুম, হাহাহা।
– দরকার পড়লে মন্ত্রী আনবেন। ছোট নদী হইলে এমপি, বড় নদী হইলে মন্ত্রী। মোটকথা গল্পটা যেন বিশ্বাসযোগ্য হইয়া ওঠে।
– তারপর?
– তারপর, ব্রিজ দিয়ে মানুষ চলাচল করুক। এই গ্রামের মানুষ ওই গ্রামে যাক, ওই গ্রামের মানুষ এই গ্রামে আসুক। হোক তাদের মধ্যে একটা বন্ধন।
– ওঁ মধু, মধু।
– ওই বন্ধন আরো দৃঢ় করার জন্য গল্পে একজন ক্যাডার নিয়া আসেন।
-কন কী? ক্যাডার দিয়া কী করবেন?
-এইটাই তো টুইস্ট। একদিন শ পাঁচেক বরযাত্রীসহ সেতুটার বুকের উপর খটখটিয়ে ওই রাহেলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
– মারছেন। ক্যাডার আনমুই-বা কই থিকা? তার বাড়ি কই দিমু?
– কেন, ওইপাড়ের গ্রাম রসুলপুর। ভার্সিটি, কোচিং নিয়ে এতদিন যে ঢাকার ফার্মগেটে থাকত। মেধাবী ছেলে। সদ্য বিসিএস। অ্যাডমিন ক্যাডার।
– সবুজের জন্য খারাপ লাগবে না?… হঠাৎ করে…
– প্রেমের সমাপ্তি, রুদ্রদা, আকষ্মিকই হয়। তাছাড়া গ্রামে বা শহরে কেই-বা এমন পাত্র হাতছাড়া করে!
– আর কি কোনো মেয়ে নাই ভাই?
– মেয়ে তো আছেই। কিন্তু রুপে গুণে রাহেলার মতো নাই।
মুচকি হেসে ফোন রেখে দেন বিলাল হোসেন।
নবীন কথাকার উদাস হয়ে বসে থাকে। কোথা থেকে যেন একটা হু হু করা বিষাদে ছেয়ে যায় চারদিক।
মিথ্যে, কল্পিত সবুজের জন্য কষ্ট লাগে তার। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রুদ্র মুহম্মদ। বুক চিরে বের হয়ে আসে তিনটি শব্দ-
আহা ধরলা সেতু!