ক্ষুধা

ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে স্টেশনে এসে দাঁড়ালো পরিবানু। আর ঠিক তখনই হুইসেল বাজাতে বাজাতে ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। পরিবানু হাঁপাতে হাঁপাতেই সবার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে ট্রেনে উঠে পড়ল। লোকাল ট্রেন। বসা তো দূরের কথা। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। আবার দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না বানু। তাই সে দুই সিটের মাঝে নিচেই বসে পড়ল ছেলে কোলে নিয়ে। পেটের মধ্যে ক্ষিধেটা মোচড় দিয়ে ওঠায় তার মনে পড়ল গত দু’দিন ধরে তেমন কিছুই পেটে পড়েনি। ধান কাটার মজুরি নিয়ে সেই যে তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছে মাস খানেক আগে। তারপর থেকে তার আর কোনো খবর নেই। তার বউ- বাচ্চা কী খেয়ে, কেমন করে বেঁচে আছে তার খবরও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি সে। গতকাল সকালের ঘটনা। ঘরে খাওয়ার তেমন কিছু ছিল না। সামান্য চাল ছিল। তাই দিয়ে ভাত রান্না করে ডাল সিদ্ধ করছিল মাটির চুলায় লাকড়ির জ্বালে। ছেলে উঠানে বসে খেলছিল। সে কলপাড়ে গিয়েছিল খাবার পানি আনতে। হঠাৎ ছেলের চিৎকার শুনে ছুটে এসে দেখে ছেলে ডাঙায় ওঠা কই মাছের মতো লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে। কী ঘটেছে বুঝতে তার একটু সময় লাগল। পাশেই ডালের হাঁড়ি পড়ে আছে। ডাল গড়িয়ে গেছে। তার মধ্যেই ছেলে দাপাচ্ছে। বুঝতে পেরে সে ছেলেকে তুলে দৌড়ে গেল বড় জায়ের ঘরে। বানুর ভাসুর ঘরেই ছিল। সে ওদের সঙ্গে করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেল। ওরা তাৎক্ষনিকভাবে মলম লাগিয়ে দিয়ে বলল, এখানে ভালো চিকিৎসা হবে না। সবচেয়ে ভালো হবে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে। ওখানে বিনা খরচে ভালো চিকিৎসা পাবা। পরীবানু তাই সকালে ছেলে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ওর কাছে টাকা পয়সা কিছুই নেই। তবু ছেলেকে তার বাঁচাতেই হবে! শুধু এই ইচ্ছেকে সম্বল করেই সে ঘর থেকে বের হয়েছে। ছেলে হঠাৎ কেঁদে উঠল। হাত- পা নাড়তেই ওর ক্ষতস্থান বের হয়ে এলো। ট্রেনের যাত্রীদের কারো কারো চোখে পড়ল সেটা। এক লোক হঠাৎ দলা পাকানো একটা পুরনো বিশ টাকার নোট বানুর কোলে ছুঁড়ে দিল। বানু অবাক হয়ে তাকাতেই আরো কয়েকজনও আগের জনের দেখাদেখি টাকা দিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই বেশ কিছু খুচরো টাকা জমে গেল বানুর কোলে। ট্রেন কমলাপুর এসে থামতেই লোকজন ব্যস্ত হয়ে নেমে গেল। পরিবানু টাকাগুলো গুছিয়ে আঁচলে বেঁধে ছেলে কোলে নিয়ে ট্রেন থেকে নামল। পেটে তখন প্রচন্ড ক্ষিধে। ওড়নার আঁচলে বাঁধা খুচড়ো টাকা তখন বানুর হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। স্টেশনের বাইরে এসে ভাতের দোকান চোখে পড়তেই সে ছেলে কোলে নিয়ে খেতে বসে গেল। প্রথমে নিজে কয়েক গ্রাস খেয়ে ছেলের মুখে ভাত দিতেই ছেলেও কান্না থামিয়ে খেতে থাকল। খাওয়া শেষ হতেই দুজনেই স্টেশনের বারান্দার ঘুমিয়ে পড়ল। পরিবানুর আর হাসপাতালে যাওয়ার কথা মনেই রইল না।

লাবণ্য লিপি এর অন্যান্য গল্প:

মেঘমল্লার দিনগুলি

আয়না

হিমঘরে পৌঁনে দুইদিন

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত