চিরকুট

সাত সাগর তেরো নদীর তুফান বয়ে যাক। পৃথিবী উল্টো দিকে ঘুরুক। সূর্য পশ্চিমে উদয় হোক। আসমান এসে জমিনে ঠেকুক। ভিসুভিয়াসের উদগীরণ আরো একবার নেমে আসুক। ধ্বংস হোক সভ্যতা। তবুও বুকের কষ্টটা কমুক, একটু কমুক।

ঈশ্বর তুমি কি আছো? কোনো দিন ডাকিনি তোমায়। প্রয়োজন হয়নি। নিজের উপর ভর করে ভালোই তো চলছিলাম সব পাহাড় ডিঙিয়ে। টলিনি এক চুল। অথচ আজ ধ্বসে যাচ্ছি। যাই।

ঘুমের ওষুধ যা ছিলো সব একসাথে গেলা যাবেনা। তিন দফায় গিলতে হবে। রীতিমতো হিসেব করে,বহুত খেটেখুটে ত্রিশটি ঘুমের বড়ি যোগাড় করেছি। দশটা, দশটা, দশটা। তিন দফায় গিলবো।

সোজা হেঁটে চলে যাবো বিচে আরো সোজা। চলে যাবো তোমার কাছে। তারপর ঘুমিয়ে যাবো। তোমার পাশে নয়, বুকের উপর। ঘুম না হওয়া প্রতিটি প্রহর কেমন তুমি জানতে। আজ আমিও জানি। তুমি ঘুমাচ্ছো তো শান্তিতে?

সব অশান্তি থেকে পরিত্রান পেয়েছ তুমি আমার আগে। তোমার বউ যখন তার প্রেমিকের হাত ধরে চলে গেলো ভাবতেও পারোনি পৃথিবীতে প্রেম আছে। প্রেম একটা বিচ্ছিরি ধোঁয়াসা তোমার মনে। নির্দিষ্ট কামনা ছাড়া প্রেম কিছু নয় বলেছিলে। এই নিয়ে আমরা কতো বিতর্ক করেছি মনে আছে? আমিও মূলত প্রেমের পক্ষে ছিলাম না কখনও। কারণ উহা আমার কাছেও একটা ছলচাতুরী ছাড়া কিছু মনে হতো না। কিন্তু তোমার সাথে আলাপের পর কি করে যেন উল্টে গেলো ঘড়ির কাঁটা, সমস্ত চিন্তা, দিন এবং রাত। আদাজল খেয়ে নামলাম। বোঝাতেই হবে তোমাকে – প্রেম অমূল্য।

জানোতো আমি সব বুঝে ভেবে, মেপে প্রতিটি বাক্য বলতাম তোমার সাথে। যাতে তুমি আকৃষ্ট হও। অবাক হতাম নিজেই নিজেকে দেখে। আর তুমি ভাবতে আমার ভালোমানুষি। আমি কি দেখেছিলাম তোমাতে? তবে আমি কিন্তু ঠকাইনি তোমায় বিশ্বাস করো। যা করেছি তোমার কাছাকাছি হবার জন্যই করেছি। পৃথিবীতে আর তোমার কাছাকাছি হওয়া হলোনা। তাই পৃথিবী সীমানার বাইরে আমাদের মিলন হবে।

তোমার সাথে পরিচয়ের পর অফিস থেকে চট জলদি ফিরতাম। দিন গুলো সময় গুলো কেমন ছন্দে টেনে আনলে! সপ্তাহে চার দিন কাজকেও অসহ্য লাগতো। বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য জানতাম না। বেঁচে থাকতাম। হয়ত জেদে। বাঁচতে হলে কেবল টাকা লাগে তা তো নয়। সময়টাও কাটানো লাগে৷ তুমি আসার পর জীবনের প্রতিটা দিন আমার কাছে হাওয়াই মিঠাই হয়ে উঠলো। তুমি যাবার সাথে সাথে তা মিলিয়েও গেলো। আমিও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লাম।

আমি রান্না করতাম, তুমি দেখতে। ঘর গোছাতাম তুমি দেখতে। ছোটো খাটো খুনসুটি আর হাসি অভিমানে রোজ নতুন করে বাঁচতাম। প্রেম মানুষকে কী করে ছেলেমানুষ করে দেখতাম পুনরায়। তুমি বলতে ঘুমানোর সময়ও ক্যাম অন রাখতে। কারণ আমার গোলার্ধে সূর্য অস্ত গিয়ে তোমার আকাশে ভেসে উঠতো। দিন রাতের তফাত, আমাদের দূরত্ব, অবস্থান নিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা তুড়ি মেরে আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম।

তবে কেন হঠাৎ তোমার এমন চলে যেতে হলো পথিমধ্যে আমাকে একা করে? বলতে – আমার ডান হাত ধরে আছো সব সময়। অনুভব করতাম তোমার উষ্ণতা। বিশ্বাস করতে তুমি। বলতে- আমরা দুজন দুজনের বিশ্বাস স্তম্ভ। এখন তুমি কই? একটি স্তম্ভ ক্ষয়ে গেলে অন্যটির কি সাধ্য একা দাঁড়িয়ে থাকে।

একবার পাওয়ার পর একবারেই শেষ! জীবনও একটা। এক এক করে সব নাই হওয়ার জন্য জীবন। আমি যখন পৌঁছে যাবো তোমার কাছে, আমার দেহখানি তুলে নেবে ওরা। কতো কি খুঁজবে। ভুল কার? ভুল কোথায়? ভুল কবে থেকে? ময়নাতদন্তে লেগে যাবে সবাই। শেকড় উপড়ে আনবে।

মন খারাপ হয় ভাবলে – বাচ্চাটার একটু কষ্ট হবে। সে কি বুঝবে না? অবুঝ নয় কোনো কালেই। সেই ছোটো বেলা থেকে এতোটুকুও যন্ত্রণা দিতে শেখেনি। বাবার ধাঁত পায়নি। কোনো রাগ নেই, উত্তাপ নেই। কেবলই কোমলতা। এও সম্ভব! মায়ের মতোও নয় সে। যে মা চায় পৃথিবী ধ্বংস হোক সে মা’য়ের কিছু মাত্র তার ভেতর লক্ষ্য করিনা। কার মতো হলো সে? এতটা হজম শক্তি সে কোথায় পেলো! ওর কিছুটাও যদি আমি পেতাম।

যাক ভালোই হলো এই প্রথম আমি খুঁজে পেলাম জীবন অবসানের আনন্দ। জীবন না থাকলে শুরু হবে আরেক জীবন। আর শুরুটা ওপারে বা অন্যকোথাও হবে।

এপারে হলে অন্যরকম কিছুই ঘটতো না। যেমন ঘটেছে তোমার, যেমন ঘটেছে আমার সেই সকলের পুনরাবৃত্তি হয়নি। হবেনা বলেই হয়নি। নয়তো ক্যান্সার স্টেজ ফোরে কেন ধরা পড়লো তোমার? কেন ঠিক তার দুসপ্তাহ আগে আমার মনে হলো তুমিই ঠিক আমার মানুষ। আমার জন্য এসেছ পৃথিবীতে। আমিও তোমার জন্য। যদিও দুজন পৃথিবীর দুই প্রান্তে, দুই মহাদেশে। এখন এক হবো দুই আত্মা।

কুড়িটি বড়ি কণ্ঠনালীর গহ্বর থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গেছে। পাকস্থলীতে পৌঁছে তারা খুব সময় নেয়নি। পাওয়ারফুল ডোজ। দোকানিরা কি সহজে দেয়! ভূয়া প্রেসক্রিপশন তৈরী করতে হলো। আর কি কি করতাম কে জানে। তার চেয়ে এই ভালো হলো – আমি চলে আসছি।

তোমার গায়ের গন্ধ নেবার লোভ কতকাল সামলে রেখেছি বলো? তুমি বলতে এই থেরাপিটা শেষ হলে চলে আসবো। জানতাম তোমার আসা হবেনা। আমিই তো সব গোছাচ্ছিলাম। ভিসা হয়ে গেলো, টিকিট কাটা হলো। আমরা জানতাম সব আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু কি করে যে ফস্কে গেল সব! হড়কে গেলো স্বপ্ন। আটকে রইলাম দুই পাড়ে দুইজন। সব ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেল। ওরা ফোন করে বিনীত ভাবে জানালো পৃথিবীর এই কঠিন মহামারীতে বেশ কিছু দেশের সাথে আকাশপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।

অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে গেলাম আমরা। পৃথিবীর কেউ জানলো না আসলে আমরা আটকে থাকার জন্য আসিনি। এক হবার পথে ধেয়ে চলেছি। তুমি পৌঁছেছ, আমি আসছি। ত্রিশটা গলাধঃকরণ করে নিয়েছি। আমার ছোটো কটেজ থেকে বেরিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ। হাঁটতে ভালো লাগছে। মাটিতে পা পরছে না দেখো! উড়ে চলেছি। সাগরের ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। আর ঢেউ গুলো দেখো কেমন খলবল করে ছুটে আসছে। তুমিই ওদের পাঠিয়েছ জানি। ওরা আমাকে নিয়েই ফিরবে তোমার কাছে।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত