এক ঢিলে বহু পাখি

বাংলাদেশ রেলওয়ের সত্যি দিন পাল্টেছে। রেলপথে এখন যাতায়াত করছে আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ। এক সময় দেখেছি ঢাকা টু মোহনগঞ্জ ট্রেনে কেবল নিম্ন আয়ের মানুষজন চলাচল করতো। এ সকল মানুষ অনেকটা নিরুপায় হয়েই রেলে যেত। কেননা রেলে যাতায়াত করলে অনেক সময় টাকা না দিলেও চলতো। ফাঁকি-ঝুঁকি দিয়ে এভাবে-সেভাবে কোনরকমে তারা গন্তব্যে চলে যেতে পারতো। সে সময় ট্রেনের কামড়াগুলোতে মাছি ভনভন করতো। ছারপোকার সবচেয়ে বড় অভয়ারণ্য ছিলো রেলের এই সিটগুলো। এখন দিন পাল্টেছে। আগের সেই অবস্থা আর নাই।

তো আমি আসলে ঐ সময়ে অর্থাৎ রেলের ঐরকম দুর্দিনে একটা ঘটনার আলোকে আমার গল্পটা বলতে চাই। কেউ পড়তে চাইলে পড়ুন, না চাইলে নাই। অথবা গল্পটার বিরোধিতা কইরা আন্দোলনেও নামতে পারেন। আপনার যা ইচ্ছা!

সে যাই হোক, সেই সময়ে উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত আলেম যাকে দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও যাতায়াত করতে হয়। তিনি সবসময়ই হেলিকপ্টারযোগে যাতায়াত করে থাকেন। প্রায় মাহফিলেই তিনি পূর্বের মাহফিল থেকে কখন বের হলেন এবং এর ঠিক কত মিনিট পর এই মাহফিলে এসে যোগ দিতে পারলেন এবং একমাত্র হেলিকপ্টারের কল্যাণেই যে এটা সম্ভব হয়েছে, এসবের একটা যুথসই বর্ণনা দিয়েই তাঁর ওয়াজ শুরু করেন। এরকম বর্ণনায় অবশ্য দুটো লাভ হয়। একদিকে তিনি নিজের মধ্যে এক ধরণের জোশ অনুভব করেন, অন্যদিকে তাঁর অনুসারীদল ও মাহফিলে উপস্থিত মুসল্লিদের মাঝে তাঁর প্রতি সম্মানের জায়গাটা আরও প্রশস্ত হয় বলেই তিনি মনে করেন।

একবার মোহনগঞ্জের কোন একটা জায়গায় তাঁর মাহফিলের দাওয়াত পড়লো। সে-বার হুজুরের হাতে কিছুটা সময় ছিল। তাই তিনি ঠিক করলেন এইবার ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জগামী ট্রেনে চড়ে মাহফিলে যোগদান করবেন। তিনি তাঁর ইচ্ছার কথাটা ভক্তদের জানালেন। এ কথা শুনে বক্তদের তো মাথায় হাত! হায় আল্লাহ! এ কী করে সম্ভব? ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জগামী ট্রেনের যে অবস্থা, হুজুরের পক্ষে এ ট্রেন ভ্রমণ কিছুতেই সম্ভব না। তারা হুজুরের ট্রেন ভ্রমণের এ সিডিউল বাতিলের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা-ফিকির করতে থাকলো। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। হুজুর তার সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে হুজুরের কায়েশ অনুযায়ী এবারের মত ট্রেন যাত্রাই ফাইনাল। যথারীতি টিকেট কাটা হলো। হুজুরের এ ধরণের মাহফিলে ভ্রমণ কিংবা অন্য যেকোনো ভ্রমণের বেলায়ই টিকেট কাটা থেকে শুরু করে অন্যান্য আনুষঙ্গিক সব কাজ তাঁর ভক্ত-মুরিদানরাই করে থাকে। এসবে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলে। এবারও ভক্তদের চেষ্টা ছিল পুরো একটা কামড়া হুজুরের জন্য বুক করার। কিন্তু হুজুরের ভ্রমণের নির্ধারিত তারিখে পুরোপুরি খালি কোন কামড়াই পাওয়া গেল না। সব কামড়ায়ই কিছু কিছু সিট ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। একটা কামড়া পাওয়া গেলো যেটাতে একটিমাত্র সিট বিক্রি হয়েছে। অবশেষে এই কামড়াটিই তারা বুক করলো।

যথাসময়ে হুজুর তাঁর ভক্ত-সাগরেদ-মুরিদসহ সদলবলে ট্রেনে চেপে বসলেন। বাংলাদেশে ট্রেনের যে দু:সময়ের কথা এখানে বলছি, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না। নির্ধারিত সময়েরও প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ট্রেন ছাড়লো।

ট্রেন তার আপন গতিতে ছুটে চলেছে। যত সময় গড়াচ্ছে ট্রেনজুড়ে মানুষের হুড়োহুড়ি আর ছুটোছুটি ততই কমে আসছে। নয়-দশ বছরের একটি ছোট্ট ছেলে হুজুরের সামনা-সামনি সিটটিতে বসে আছে। ছেলেটি এ কামড়ার আগেই বিক্রি-হওয়া সেই সিটের সৌভাগ্যবান যাত্রীটি কি-না কিছুই বুঝা গেল না। কেননা হুজুরের সফরসঙ্গী অন্যান্য ভক্ত-মুরিদানদের মতই এই ছেলেটিও অপার বিস্ময় আর ভক্তিভরা চোখে হুজুরের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। অন্য সবার মতো সে-ও তন্ময় হয়ে হুজুরের কথাগুলো শুনছে আর অপার্থিব এক শ্রদ্ধায় নত হয়ে আছে। সাথীদের মধ্যে কেউ কেউ বসে তসবিহ জপছে আর ঝিমুচ্ছে। দেখে মনে হতে পারে এই লোকগুলো হয়ত ঘুমিয়েই পড়েছে। কিন্তু হুজুরের কথার কোরাস হিসেবে সকলে যখন সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ—সুবহানাল্লাহ বলছে তখন এই তসবিহ-পড়া লোকগুলোও সকলের সাথে ঠিকই গলা মেলাচ্ছে।

একসময় মনে হলো হুজুরের শরীরে ও মনে কিছুটা ঘুমভাব চলে এলো। শেষের দিকে কিছুক্ষণ তিনি চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিলেন। কিন্তু এখন আর তিনি কোনো কথা বলছেন না। এই ফাঁকে হুজুরের সাগরেদ-মুরিদরা নিজেদের মধ্যে খোশগল্পের জন্য কিছুটা অবসর খুঁজে পেল। তারা একে অন্যের সঙ্গে নিজেদের দরকারি কথাগুলো সেরে নিচ্ছে। যদিও তারা ফিসফিস করেই কথা বলছে তবুও এতে কামড়াজুড়ে হট্টগোলের মত কিছুটা আওয়াজ উঠলো। ছোট ছেলেটি এতক্ষণ তন্ময় হয়ে হুজুরের কথা শুনছিল। এখন এইসব হট্টগোলের মাঝে নিজের মনে কী যেন ভাবছে!

এমন সময় হুজুর তাঁর সিটে হেলান দেওয়া অবস্থায়ই হাতের উপর কিছুটা ভর রেখে নিজের পাছাটাকে একটু উপরের দিকে ভাসিয়ে বায়ু ত্যাগ করলেন মানে সোজা বাংলায় যাকে বলে পাদ দিলেন। হুজুরের পাদের যথেষ্টই শব্দ হলো। তাছাড়া বাচ্চারা এসব ব্যাপারে একটু বেশিই কৌতুহলী হয়ে থাকে। পাদের এই আওয়াজ অন্য কেউ টের পেলো কিনা কিছুই বোঝা গেল না। কিন্তু হুজুরের পাশে বসে থাকা ছেলেটি ঠিকই বুঝতে পারলো, এমনকি সে হাসি হাসি মুখে হুজুরকে আচমকা প্রশ্নও করে বসলো—হুজুর কি পাদ দিলেন? অবশ্য হুজুর ছেলেটির এ প্রশ্নের কোনো প্রতিউত্তর করলেন না। তবে তিনি মনে মনে খুব বিরক্ত আর রাগান্বিত হলেন। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ছেলেটির দিকে একবার শুধু তাকালেন আর অস্ফুট ভাষায় স্বগতোক্তির মত কী যেন বলতে লাগলেন—এই ছেলে তো দেখছি আচ্ছা বেয়াদব হে! দুনিয়াজুড়ে সকলে আমায় চেনে আর কত সম্মান করে। এই বেয়াদব ছেলেটা আমায় চিনতে পারেনি? আর চিনতে না পারলেই বা কি, আমার পোষাক-আষাক, আদব-লেহাজ দেখেও তো বোঝা যায় আমি কত বড় এবং সম্মানী একজন আলেম মানুষ। ও কি দেখছে না আমার সাথের লোকগুলো আমায় কেমন তোয়াজ করে কথা বলছে? অথচ সে কত বোকার মত আমায় কিনা এমন একটা প্রশ্ন করে বসলো। হুজুর মনে মনে এইসব ভাবছেন আর ভেতরে ভেতরে ফোঁসে উঠছেন। ছেলেটার দিকে আরেকবার তিনি কটমট চোখে তাকালেন। এ মুহুর্তে হুজুরের মনে আরও একটা প্রশ্ন উঁকি দিল—আমাকে এমন একটা অপমানজনক প্রশ্ন করার পরও আমার সাগরেদ-মুরিদরা এই বেয়াদব ছেলেটাকে কিছুই বলছে না কেন? রাগে-দু:খে ভেতরে ভেতরে তিনি খুব ক্রোধান্বিত হলেন। হুজুরের চোখ-মুখ কেমন যেন ফেঁপে ওঠেছে আর লাল হয়ে গিয়েছে।

হুজুরের সঙ্গী-সাথীরা এতক্ষন নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মেতে ছিল, কেউ কেউ তসবিহ জপছিল আবার কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। সে কারণেই তাদের মধ্যে কেউই আসলে উদ্ভুত পরিস্থিতির সঠিক কারণটা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারছে না। হুজুরও নিজের মুখে কিছুই বলছেন না। হুজুরের এমন রাগান্বিত চেহারা দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্রই তার সফরসঙ্গীরা সকলে একে-অপরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। সকলের চোখে-মুখেই তখন চাপা একটা প্রশ্ন খেলা করছে কিন্তু মুখ ফুটে কেউই কিছু বলছে না। হুজুরের এমন নাখোশ হওয়ার কারণ জানার জন্য সকলেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো।

ওদিকে ছোট্ট ছেলেটির সরল কৌতুহল তখনও কাটেনি। এমন মুহুর্তেই হুজুরের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি আগের সেই সরল প্রশ্নটা আবারও করে বসলো—হুজুর কি পাদ দিলেন? তবে, এবার আর যায় কোথায়? এবার তো সকলেই হুজুরের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। তাই ছেলেটির কথা সকলেই স্পষ্ট শুনতে পেল এবং সবার মুখ ও চেহারায় এমন একটা ভাব চলে এলো যেন এমন কথা আর জীবনে কেউ কোনোদিন শুনেনি। ছেলেটির মুখে এমন একটি কথা শুনে সকলের মাঝে একটা হুলস্থুল পড়ে গেল। ছেলেটি যেন মৌচাকে ঢিল ছুড়ে দিল। হুজরের যত সাগরেদ-মুরিদ, সাঙ্গু-পাঙ্গু, ছেলা-চামুন্ডা সকলে যেন আহত মৌমাছির মত ছেলেটির উপর হামলে পড়লো। কিল-ঘুষি, লাথি-উষ্ঠা যে-যা পারছে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছেলেটাকে সকলে মিলে পেটাচ্ছে। দৃশ্যটা এমন যেন একটা মায়া হরিণকে চারদিক থেকে অনেকগুলো সিংহ খুবলে খাচ্ছে। ছেলেটির আকাশ কাঁপানো চিৎকার কারও কানেই পৌছুল না। এমনকি দয়ার সাগর, মায়ার অবতার সেই হুজুরের কানেও না। এভাবে একসাথে অনেকের বিশৃঙ্খল উত্তেজনা আর আক্রোশের ফলসরূপ ছেলেটিকে একসময় ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হলো। এবং ফেলে দেয়ার মুহুর্তে অবচেতনে হলেও হুজুরের দৃষ্টি আকর্ষণে সকলের একটা মৌন চেষ্টা লক্ষ্য করা গেলো। কেননা হুজুরের আত্মার শান্তির জন্য, হুজুরের দিল খুশি করার উদ্দেশেই তো তার ভক্তদের এমনটি করা। অবশেষে হুজুরের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে সকলে খুবই তৃপ্ত হল, কেননা ভক্তগণের এমন কান্ড দেখে হুজুরের চেহারায় এতক্ষণে একটা খুশি খুশি ভাব চলে এসেছে। নিজের প্রতি ভক্তকূলের এমন ব্যাকুল আনুগত্য দেখে তিনি খুবই প্রীত হলেন। মনে মনে এক ধরণের পুলক অনুভব করলেন এবং তার চেহারায় একটা গদগদে ভাব চলে এলো।

এই যে হুজুর ওয়াজ মাহফিলে যাচ্ছেন। সেখানে তিনি বক্তৃতা করবেন। মানুষকে হেদায়েত করবেন, মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করবেন। তার কথা শুনে হয়ত অনেকেই দীনের পথে, সত্যের পথে জীবনকে প্রবাহিত করার সুরঙ্গ খুঁজে পাবে। এই এতকিছুর পরেও দিনশেষে আসলে কী লাভ? কীসের মূল্য আর কতটা কল্যাণ নিহিত এসব দামি দামি কথায়? চোখের সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল। যে ঘটনার সাথে তাঁর নিজের সরাসরি একটা কার্যকারণ সম্বন্ধও আছে। অথচ এই নিরপরাধ ছেলেটিকে বাচানোর জন্য হলেও, হুজুর যে পাদ দিয়েছিলেন এই সত্যটুকু তিনি স্বীকার করতে পারলেন না?

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত