আসুন শোকগাঁথা লিখি।
২০২০ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখে মেঘডুমুরের সকাল বেলায় সবার সব স্বাভাবিক নিয়মে চলার মাঝেই একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে যায় এবং ওইদিন মেঘ ডুমুরের উত্তর দিকে হুট করেই হৈচৈয়ের শব্দ পাওয়া যায়, যার ফলশ্রুতিতে সব দিক থেকে সবাই এলোমেলো ছুটতে থাকে এবং এক সময় জানা যায় যে আমাদের সবার পরিচিত সেকেন্দার আলীর গরু ইলেকট্রিক পোলের সাথে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হওয়ার খবর জানা যায় এবং যদিও ঘটনাস্থলে না পৌঁছান পর্যন্ত কারোর পক্ষেই এই তথ্যের সত্যতা যাচাই সম্ভব ছিল না তবুও এই কথা শুনেই এলাকার অনেকেই শুকনা বাঁশের লাঠি নিয়ে ঘটনা স্থলের দিক বরাবর ছুটতে থাকে।
ঘটনা যদি এই পর্যন্তও বিদারক হত তাহলে চাষ করা হালের গরু মারা যেত, সবাই আফসোস করত, গরু হারানোর আকস্মিক যন্ত্রনায় সেকেন্দার আলী কান্নায় ভেঙ্গে পরত এবং তার কিছু পরে পতিত স্থানে গর্ত খুড়ে মৃত গরু সৎকারের ব্যবস্থা করা হত।
কিন্তু না। তা হয়ে ওঠে না এবং আমরা দেখতে পাই যে ঘটনা এর থেকেও অধিক অবনতি্র দিকে যায় এবং জানতে পারি যে চাষের গরু না, সেকেন্দার আলী নিজেই বৈদ্যুতিক শকের শিকার হন এবং আমরা জানতে পারি যে ওইদিন ওই সময় ইলেকট্রিক মেইন লাইন থেকে সংযোগ দিয়ে পাম্প চালিয়ে জমির পানি সেচ দিয়ে জমিতে বীজতলা তৈরি করতে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের গোলযোগের কারনে আমাদের এলাকার এক নায়ক মারা যান এবং এই ঘটনা আমাদের মনে পুজি বনাম শ্রম কিংবা যন্ত্র বনাম মানব শক্তির এক অসম সমীকরণ হাজির করে যার রেশ আমাদের মাঝে এক ধরনের চাপা কষ্টের সঞ্চার করে।
এই সব সমীকরণ আমাদের মধ্যে অসম মায়াজাল সৃষ্টি করে ঠিকই কিন্তু মাঝ খান থেকে আমরা দেখতে পাই আমাদের এলাকার প্রিয় দাদাভাই সেকেন্দার আলী মেঘডুমুর থেকে বিদায় নেন এবং ওই দিনের পরের সকাল বেলায় বৃষ্টি ভেজা মেঘডুমুরে পারিবারিক কবর স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
অন্যান্য সকল মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও এই মৃত্যু আমাদের মাঝে অস্বাভাবিক মনে হয় এবং এই মৃত্যু আমাদেরকে অনেক পিছনে নিয়ে যায় এবং স্মরন করায় যন্ত্র চালিত ট্রাক্টরের প্রচলনের শুরুর দিন সমূহের কথা যখন আমাদের চোখের সামনে হালের গরু, লাঙল, জোয়াল দিয়ে জমি চাষার প্রচলন আসতে আসতে বিলুপ্ত হওয়ার ক্রমিক চক্রে চাষের উপকরন হিসেবে ট্রাক্টরের প্রচলন বেড়ে যায় এবং এই বেড়ে যাওয়া এক পর্যায়ে অতি মাত্রায় বেড়ে গেলে এলাকার চাষিরা যখন হালের গরু বিক্রি করে দেয় কিংবা নতুন করে গরুকে জমি চাষ করার শিক্ষা দেওয়ার উপযোগিতা অনুভব করে না এবং লাঙল জোয়ালে ঘুন পোকা ভর করে এবং আমরা দেখি যে যন্ত্রের কাছে আমাদের অঞ্চলের জমি চাষতে হালের গরুর প্রচলন কমতে শুরু করলেও যন্ত্র কিংবা ট্রাক্টরের একচ্ছত্র আধিপত্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একমাত্র সেকেন্দার আলী।
আমদের মনে পরে যে যন্ত্রের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের যুগের পরিস্থিতিতেও সেকেন্দার আলী হালের গরু তুলে ফেলে না এবং লাঙল জোয়াল ঘুন পোকা থেকে বাচিয়ে রেখে যেসব উচু জমিতে ট্রাক্টর পৌছাতে পারে না সেসব জায়গায় গরুর হালের দরকার পরে এবং আমরা অবাক হয়ে ভাবতে থাকি যে সেই সব জমিতে গরুর হাল নিয়ে, গরুর কাধে জোয়াল তুলে দিয়ে এবং সেই জোয়ালে লাঙল ঠেকিয়ে সেকেন্দার আলী যখন জমি চাষ করত তখন এই কথা স্মরণ হত যে যন্ত্রের প্রচলন আঞ্চলিক গরুর হাল দিয়ে জমি চাষার সংস্কৃতি প্রায় দখল করতে পারলেও সেকেন্দার আলিকে দখল করতে পারে নাই। কিন্তু জুলাইয়ের ৫ তারিখে মেঘডুমুরের এক ভর দুপুরে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মেঘডুমুরের সেই নায়ক সেকেন্দার আলীর মৃত্যু ঘটে।
সেই দিন থেকে মেঘডুমুরে আর কখনও গরুর হালের শব্দ, কাঁদা জমিতে চাষের সময় এলোমেলো পা ফেলার ফলে গরুর গলায় ঝুমকার বাজনা কিংবা জমিতে লাঙল দেয়ার সময় গরুর প্রতি সেকেন্দার আলির সেই সব- হু হট হট, পায়েত্তল পায়েত্তল কিংবা বারাবল বারাবল ইত্যাদি নির্দেশনা মেঘডুমুর থেকে খুব সম্ভবত চিরতরেই বিলীন হয়।
এবং আমরা জানতে পারি যে অইদিন ওই সময় ইলেকট্রিক মেইন লাইন থেকে সংযোগ দিয়ে পাম্প চালিয়ে জমির পানি সেচ দিয়ে জমিতে বীজতলা তৈরি করতে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের ভ্রান্তির কারনে আমাদের প্রিয় দাদা ভাই সেকেন্দার আলী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন এবং আমরা প্রয়ান দিবসে আমরা প্রিয় দাদা ভাইকে ভালবাসা নিবেদন করি।