তমসা কাটা
চৈত্রের খরতপ্ত দুপুর যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীটাকে। অরিত্রিকা অজু করে অপেক্ষমাণ ধাতব চেয়ারে বসেই দুহাত তুলে মুনাজাত শুরু করে-হে করুণাময় আমি আমার ২১ বছরের জীবনে কোনদিন কিছু চাইনি তোমার কাছে। এটা সত্যি যে আমি সেভাবে হয়তো ধর্মের কাজ করিনা। আজ নিজের বিপদে তোমার কাছে হাত তুলেছি। কিন্তু তুমি তো মানুষ নও, তুমি দয়ার সাগর, মহান প্রভু, আমাকে মাফ কর আর আমার এই প্রার্থনা কবুল কর। আমার আব্বুর জন্য একটি আইসিইউ বেড জোগাড় করে দাও। আর কখনও আমি তোমার কাছে কিচ্ছু চাইব না, কেবল একটা আইসিইউ বেড দাও আর আব্বুকে তুমি সুস্থ করে দাও… মেয়েটির দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল ঝরতে থাকে। সে নিরবে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতেই থাকে…
ওর বাবার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। একটি আইসিইউ বেড ইমিডিয়েট দরকার। মামা, চাচা, আব্বুর অফিসের লোকজন সবাই এই শহরের সব ক্লিনিক, হসপিটালে লাগাতার খোঁজ নিচ্ছে একটা বেড খালি হলেই আব্বুকে সেখানে দেয়া হবে।
মুনাজাতের মধ্যেই সে টের পায় মা এবং অন্যান্যদের দ্রুত তৎপরতা।
পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! অতি দ্রুত অরিত্রিকার আব্বুকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স সেই হসপিটালের পথে রওয়ানা দেয়।
পৃথিবীর অবস্থা ভয়াবহ। অতি তুচ্ছ অণুজীব সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। বদলে গেছে চেনা শহর। চারিদিকে হাহাকার, শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেন সংকট।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে আর অজস্র মানুষ অসহায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই মহামারি এ পর্যন্ত মানুষকে ২৯ লাখের একটা সংখ্যা বানিয়ে দিয়েছে।
ওদিকে নির্ঝরের মাও আইসিইউতে আছে। আন্টির অবস্থা ক্রিটিকাল। ওরা দুজন অনবরত পরস্পরকে সাহস, সান্ত্বনা ও সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। আজ দুপুরের পর থেকে নির্ঝরের সাথে কথা হয়নি। ও ওর মাকে নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে আব্বু দ্রুত আশংকাজনক অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
অরিত্রিকাদের গাড়িটা হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়ালে ওরা নামার আগেই এ্যাম্বুলেন্স থেকে আব্বুর বেডটা নামিয়ে নার্স, বয়’রা প্রাণ বাজী রেখে ছুটতে থাকে আইসিইউ ইউনিটের দিকে। ওরা আর যেতে পারে না। এ পর্যন্তই ওদের সীমানা, অপেক্ষার চেয়ারে বসে থাকে। কিছুক্ষন পরে সংবাদ পায় আব্বুকে ঠিকঠাক আইসিইউতে দেয়া হয়েছে। যাক কিছুটা স্বস্তি আসে।
অরিত্রিকার মনে হলো গুড নিউজটা নির্ঝরকে জানানো যাক, শুনলে ও কিছুটা আশ্বস্ত হবে। সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে মেসেঞ্জারে যায়, ওর চোখ বিস্ফারিত, দমবন্ধ হয়ে আসে। কিছুক্ষন আগে নির্ঝর টেক্সট করেছে- ‘আম্মু চলে গেল’।
অরিত্রিকার বুকটা ফেটে যেতে চায়, আহা! আন্টি!
নির্ঝরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার এক প্রবল আকুতি ওকে কাতর করে তোলে।
নির্ঝর বা অরিত্রিকা কেউ জানতেও পারেনা নির্ঝরের মায়ের খালি হওয়া বেডটাই ওর আব্বু পেয়েছে।
তখনও ওই হসপিটালের বেজমেন্টে নির্ঝরের মায়ের শবদেহ রাখা ছিল। হসপিটালের কোন এক সেকশনের লাইনে দাঁড়িয়ে বিল মিটিয়ে মায়ের ডেথ সার্ফিকেটটা নিচ্ছিল ওরা।