মানুষ সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়। এই যেমন সৈকত সব সময় একটা কথাই শুনে – বিয়ে করো। সে জানে বিয়ে করার পরেই শুনতে হবে বাচ্চা নাও। বাচ্চা নিলে শুনতে হবে আরেকটা বাচ্চা নাও। একারণে সে এসব কথা গায়ে মাখে না। তার অফিসের বস পারলে ধরে বেঁধে সুমনার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। সুমনা স্মার্ট। একাউন্টস দেখে। হাঁটার সময় খটখট শব্দ হয়। আশেপাশে সবাইকে জানান দিয়ে হাঁটে। স্মার্ট মেয়ে আসছে খটখটখট। অফিসে একটা কানাঘুষা চলে। সুমনা কান খাড়া করে রাখলেও সৈকত নির্লিপ্ত থাকে। ফলে রোমান্স মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।
সৈকতের এমন একাকী জীবন বেশ চলে যাচ্ছে। সকাল সন্ধ্যা চাকরি। তারপর ইচ্ছেমতো চলা। কোনদিন ইচ্ছে হলে বাসায় রান্না চড়ায়। ইচ্ছে হলে বাইরে খায়। ইচ্ছে না হলে না খায়। কোথাও কোন তাড়া নেই। এ এক অদ্ভুত উপভোগ্য জীবন।
বছরের শেষ দিন ছিল বলেই হয়তো অফিসে কাজের চাপ বেশি ছিল। বাসায় ফিরতে অন্যদিনের চেয়েও দেরী হলো। সৈকত বলতে গেলে বাসায় একাই থাকে। মাঝে মাঝে তার মা বেশ কিছু পাত্রীর ছবি নিয়ে তাকে বিয়ের জন্য ঝুলাঝুলি করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। সৈকতের মনে হয় ২১ থেকে ৩৫ এর মধ্যে কারো বিয়ের ফুল না ফুটলে পরে আর জোর জবরদস্তি ফুল ফুটানো একটা বড় ভুল।
সৈকত তার ফ্ল্যাটে ঢুকে জবরদস্ত একটা ধাক্কা খেল। সে কি তার বাসায়ই এসেছে কিনা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল। সে দেখল তার ড্রইং রুমের সোফায় একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে বসে টিভি দেখছে। টিভিতে জুমানজি দেখাচ্ছে। বাচ্চাটির বয়স তিন/চার হবে। তাকে খেয়াল করল বলে মনে হলোনা। তার দৃষ্টি টিভিতে নিমগ্ন। তার বাসাটি থেকে ব্যাচেলর ভাইব বেমালুম গায়েব। এখানে সেখানে খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রান্না ঘরে কিছু একটা রান্না হচ্ছে। শুকনা মরিচের পোড়া ঝাঁজ বাতাসে ঘুরঘুর করছে। সৈকত বুঝতে পারছেনা তার সাথে কী ঘটছে। সে ডাইনিং স্পেসে এসে দাঁড়ানো মাত্রই রান্না ঘর থেকে এক তরুণী বের হয়ে আসলো। তাকে দেখে ঝাজিয়ে উঠলো।
এখন তোমার আসার সময় হলো! ঘরে যে কোন বাজার নাই সে খেয়াল আছে? পেঁয়াজ আনতে বলেছিলাম কই এনেছ!
সৈকত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলো। পরে বলল ভুলে গেছি। আচ্ছা নিয়ে আসছি। বের হওয়ার সময় সে খেয়াল করল ঝাঁজালো তরুণীটির কোঁকড়া চুল আর ফর্সা মুখের সাথে ড্রইং রুমের বাচ্চাটির মিল আছে। তাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চা মেয়েটি বলল আব্বু বাইরে যাচ্ছো! আমার জন্য পতেত নিয়ে এসো।
সৈকতের মাথা ঘুরছে। সে নিজের গায়েই বেশ কয়েকবার চিমটি কাটল। এটা স্বপ্ন নয়তো! সে বাজার থেকে পেঁয়াজ আর কিছু সবজি নিল। ফিরতে ফিরতে ভাবল বাসায় গিয়ে হয়তো সে দেখবে আগের মতোই কোথাও কেউ নেই। কিন্তু তা হলো না। সে তার হঠাৎ করে পাওয়া পরিবারের সাথে রাতের খাবার খেল। মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ বার্বি ডল নিয়ে খেলল। তারপর ঘুমাতে গেল।
সৈকত ভেবেছিল সকালে ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে সব আগের মতো। কোথাও কেউ নেই। কিন্তু তার কিছুই ঘটল না। এভাবে হঠাৎ করে পাওয়া রেডিমেড ফ্যামিলি পেয়ে সুখী মানুষের মতো দিনাতিপাত করতে লাগলো।
এতদিন ধরে সবাই যেখানে দেখা হওয়ামাত্রই বলতো বিয়ে করো তারা এখন সেসব কিছু বলছে না। ভাবটা এমন যেন সবাই সবকিছু জানে। আসলেই কি জানে! সৈকত বুঝতে পারেনা। তবে কারো সাথে সে কোন আলাপ করেনা।
একদিন অফিসের বস সৈকতকে হতভম্ব করে দিয়ে বললেন সৈকত আপনার মেয়েটা ভালো আছেতো! বয়স যেন কতো হলো? স্কুলে দিয়েছেন?
সৈকতের কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! সবকিছু স্বাভাবিক আছে আবার কিছুই স্বাভাবিক নেই। কোথাও একটা বড় ধরণের ভুল হচ্ছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছেনা।
মেয়েটির বেশ জ্বর। ভাইরাল ফিভার। বলল আব্বু আজ অফিসে যেও না। কিন্তু সৈকতের আজ অফিসে জরুরী মিটিং। তাকে যেতেই হবে। কোঁকড়া চুলের ফর্সা তরুণীটি, যে তার বউয়ের মতো আচরণ করছে সেও বলল আজ না গেলে হয়না! সৈকত বলল মিটিং শেষ করেই চলে আসবো। দেরী হবেনা।
সৈকত সত্যি সত্যি আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হলো। এতদিন নিজেকে অসামাজিক অসাংসারিক ভাবলেও এখন কেনো জানি তার এই সংসার সংসার খেলা বেশ লাগছে। বাসায় ফিরে ছোট্ট মেয়েটির মুখে আব্বু ডাক শোনা। কোঁকড়া চুলের তরুণীর পান থেকে চুন খসলেই ঝাঁজালো বকাবাজ্জি। সবকিছুতেই কেমন যেন সে একটা মধুর স্বাদ পেয়ে গেছে সে।
সৈকত খুব করে ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করল। বাসায় ফিরে দেখল কোথাও কেউ নেই। তার পৃথিবী দুলছে। বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে। আসলেই কি কেউ ছিল না!
সৈকতকে খুব বিধ্বস্ত লাগছে। তার সব কিছু এলোমেলো। অফিসের বস বললেন একি হাল হয়েছে আপনার? কতদিন ধরে বলছি বিয়ে থা করেন। একা একা আর কতদিন!
অধ্যাপক এন আহমেদ সৈকতের এই ডাবল রিয়েলিটির গল্প শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলেন। তার জীবদ্দশায় এমন কেস শুনেননি।
সৈকত আগেও একা ছিল কিন্তু কখনো তাকে একা মনে হয়নি। এখন সে ভীষণ একাকীত্বে ভুগে। তবে সে অফিস শেষে মাঝে মাঝে খুব করে বাজার করে বাসায় ফেরে।