ছেলেটি মাঝে মাঝেই বিষাদগ্রস্থ ক্লান্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে মনে হতো, জন্ম-জন্মান্তর ধরে আমার দিকেই তাকিয়ে থাকবে সে। গ্লানিমাখা-করুণ সে চাউনি প্রতিবারই কি যেন বলতে চাইতো আমাকে। মাঝে মাঝে বলতও বটে। শ্রোতা হিসেবে আমি খারাপ নই, তবে ছেলেটি বোধহয় অন্য কাউকে বলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।
আমাদের এই আধো-অন্ধকারের প্রকোষ্ঠে কখনো কখনো বৃষ্টির সোঁদা ঘ্রাণ আসতো ঠিকই, তবে বৃষ্টির দেখা পাওয়া যেত না। মলিন দেয়ালজুড়ে ছিলো ছোপ ছোপ দাগ। কিছু উত্তেজক পানীয়ের, কিছু ছেলেটির রক্তের। সে নিজেকে কষ্ট দিতে ভালোবাসতো। আর ছিলো টেবিলের এক কোণে ভাঁজ করে রাখা অসংখ্য জারজ চিঠি। কি কদাকারই না ছিলো সেসব!
ছেলেটি অবশ্য সবই পরম যত্নে আগলে রাখতো।
প্রায়শই সে ঘুণে ধরা টেবিলের ওপর মাথা রেখে কাঁদতো। উস্কোখুস্কো তেল চিটচিটে চুলের ভীড়ে মুখ যদিও দেখা যেত না, তবে তার ডুকরে ওঠা আর্তনাদ আমি শুনতে পেতাম অহরহ। কি ভীষণ অসহায়ত্বই না ছিলো তাতে! হেরে যাবার কষ্ট, নাকি হারাবার? ছেলেটি বলে যায় নি আমাকে।
আমরা দু’জন ছিলাম ভালো বন্ধু। বোবা স্বপ্নের এই জীর্ণ প্রকোষ্ঠে আমরা একসাথে ক্ষুদ্র জীবনের এলোমেলো কত হিসেবই না মেলাবার চেষ্টা করতাম!
ছেলেটি কখনো কথা বলতো দর্শন নিয়ে, কখনো রাজনীতি, কখনোবা তার অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে। শুনতে ভালোই লাগতো আমার। একাকীত্বের করুণ যন্ত্রণা ছেলেটি আমার সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলো বেশ দক্ষতার সাথে, নিপুণভাবে। কেননা, মন খারাপের দিনগুলোয় অন্য কোনো প্রাণী আমাদের গল্প শুনতে আসে নি।
আজ প্রথমবারের মতো ছেলেটির চোখদুটো এত কাছে থেকে দেখার সুযোগ হলো। কি অদ্ভুতরকম ভাবলেশহীন! কবি-সাহিত্যিকেরা দেখলে নিশ্চয়ই মানানসই কোনো উপমা দিতে পারতেন।
আমার গায়ে নাইলনের দড়িতে ঝুলে থাকা ছেলেটির দেহ বোধহয় এখন কিছুটা নির্ভার। তবে, ছেলেটির নিষ্প্রান চোখজোড়া বড্ড জান্তব-ক্রুর।
যেন অট্টহাসি হাসছে কক্ষের বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকা কৌতূহলী চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে।