এক দেশে এক রাজা ছিলো । রাজার ছিলো সবই । হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া । ঐ যতদূর চোখ যায় আলোর ছোঁয়া, কালুঠাকুরের বন থেকে শুরু করে আরবিয়ালের নদ পর্যন্ত, বিস্তৃত এ রাজ্য রাজার অধীন । আর অন্তঃপুর? রাণী ললোমাহ পরমা সুন্দরী ।
‘ ফের ছেলেভুলানো পুথিগল্প শুরু করলে পথিক ! যাহোক.. তারপর? রাজা কি খুব সুখী ছিলেন? ‘
রাজার কোন দুঃখ ছিলো না । সকালবেলা যখন পাখির গানে উদ্যান মুখর হয়ে যেত ভোর না হতেই, তিনি জেগে যেতেন । স্রষ্টার আরাধনা শেষে হাঁটতেন জানা অজানা কত ফুল আর লতার পাশ ঘিরে । পাশে রাণীকেও নিতেন । ডালে বসা বাচ্চা পাখিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো । তাদের মায়েরা বলতো, ঐ দেখ এই রাজ্যের রাজা, ঐ যে রাণী । আহা মরি মরি… স্বর্গের শোভা তারা ।
‘ —- এ তো সেই আষাঢ়ে রুপকথা । এরপর কি হবে আমি বলে দিতে পারি, শৈশবের নিশিতে কতোবার এ সব গল্প শুনেছি, একেবারে ভুলে যাই নি । ‘
বলো শুনি…. বিশাল পাকুড় গাছের নিচে বসে শ্বাস ফেলে তাকায় আগন্তুক।
দুরন্ত শ্রোতা সোৎসাহে বলে,
‘—– তারপর একদিন রাজা শিকারে গেলেন! সেখানে তিনি সত্যি সত্যিই মায়াবিনীর সন্ধান পেলেন! যতোই দেখতে লাগলেন ততোই মুগ্ধ হতে লাগলেন ।’
তারপর?
আগন্তক সুবিশাল নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ।
‘——-তার মনে হতে লাগলো এই তার সেই আরাধ্য সৌন্দর্যের স্মারক । তারপর আর কী ।রাজা তার সাথে করে মায়াবতী নিয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন । কিন্তু তারপর থেকে আর তার বাগানে ফুল ফোটে না, সুখ পাখি কথা কয় না ।কিন্তু রাজার সেদিকে খেয়াল নেই! রাজা রানীকেও ভুলে গেলো । সে তার স্বপ্নের সুন্দরের আরাধ্যে ব্যস্ত থাকলো কয়েক যুগ । রাজ্যের দিকে খেয়াল ছিলো না ।’
তারপর? ফুল কি আর ফোটে নি? পাখি কি গায় নি?
আগন্তক শুধায়, তার চোখের তারা অকম্পিত উজ্জ্বল । শরতের শান্ত গোধূলি নেমে আসছে ।
শ্রোতা গম্ভীর হয়ে বলে, ‘মস্ত ফাকি শিখেছো দেখি বাপু । গল্প তো তোমার, এইটুকু এগিয়ে দিলাম । আবার বাকিটুকুর ভাড়া চাচ্ছো যে বড় ! ‘
আগন্তুক প্রাচীন মৃদু হাসি হেসে বলে, আচ্ছা বলছি শোনো ।
হঠাৎ একদিন এলো ঈশান কোণে কালো মেঘ । যুদ্ধের দামামায় আরবিয়ালের পানি কেঁপে কেঁপে উঠে যেন । হন্তদন্ত হয়ে রাজা ছুটলেন অন্তঃপুর থেকে । নতুন রাণী মায়াবতী কে কোথাও দেখতে পেলেন না । প্রথম রাণী ললোমাহ কে চোখে পড়লো ঐ গরাদের পাশে, মলিন চেহারা, চোখে ক্ষয়ে যাওয়া পানি ।
রাজা বিচলিত বোধ করেন । মাঝে মাঝেই প্রথম রাণীকে দেখে রাজা উদাস হয়ে যান, কেমন যেন পালিয়ে বাঁচতে চান । নতুন রাণী অবশ্য সবকিছু ভুলিয়ে দেয় দ্রুতই । সেই নতুন রাণী কোথায় গেল? ওদিকে হৈ চৈই বা কিসের? মস্ত লাগোয়া বারান্দাটা পার হয়ে নিচে নেমে আসেন রাজা । কী হলো কী হলো –
প্রধান উজির এসে চুপ করে দাড়িয়ে রইলেন পাশে । রাজা অধৈর্য হয়ে জানতে চান কি হয়েছে –
প্রধান উজির মৃদুস্বরে বলেন,
কালসুর রাজ্য আমাদের আক্রমণ করেছে,রাজাধিরাজ ।
আমাদের সৈন্য প্রস্তুত?
হা,আলমপনা । কিন্তু-
কিন্তু কী?
আমাদের সেনাপতি হত । বিষপ্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছে ।
হতবিহ্বল রাজা শুধান,
এ স্পর্ধা কার? কোথায় সে খুনী? স্বহস্তে দন্ডবিধান করবো । রোষে কেঁপে ওঠে রাজার কন্ঠ ।
আপাতত খুনীকে নিয়ে নয়, যুদ্ধ নিয়ে চিন্তা করা শ্রেয়তর, মহারাজ ।
পরিকল্পনা প্রস্তুত?
হাঁ, মহারাজ । এই যে যুদ্ধ নকশা । মাত্রই প্রস্তুত ।
আচমকা দরজায় বার্তাবাহক সালাম ঠুকে । প্রধান উজির শুধান,
দ্বারিসর, কি খবর এনেছো?
পশ্চিম তীরে শত্রুপক্ষ আস্তানা গেড়েছে । যুদ্ধ করা বৃথা । সেনাপতির মৃত্যুতে সৈনিকদের মনোবল যাচ্ছেতাই । আর সবচেয়ে বড় কথা, শত্রুরা তৈরী হয়েই এসেছে । ভিতরকার সমস্ত খবর জেনেই এসেছে তারা ।
বিস্ময়াপ্লুত রাজা শুধান,
কিভাবে ? কিভাবে জানে সব তারা?
বার্তাবাহক উজিরের দিকে তাকান । যেন ভয় পাচ্ছে মহারাজকে বলতে, তাই ভরসা চায় উজিরের কাছে ।
প্রধান উজির তার প্রাচীন সফেদ দাড়িতে হাত বুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন,
তারা গুপ্তচর পাঠিয়েছিলো, রাজাধিরাজ । আজ আমরা জানতে পেরেছি তা ।
গুপ্তচর? রাজা বিস্ময়ে ফেটে পড়েন ।
হাঁ, রাজাধিরাজ ।
সে গুপ্তচর ধরা পড়েছে?
না, মহারাজ ।
পরিচয়?
প্রধান উজির পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রাজার দিকে, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে । তারপর প্রায় শোনা যায় না এমন কন্ঠে বলে,
আপনার নতুন রাণী মায়াবতীই ছিলো সে গুপ্তচর, মহারাজ ।
সন্ধ্যা নামে । স্নিগ্ধ আঁধার ঘনায় চারপাশে ধীরে ধীরে । আগন্তক প্রশ্ন করে, গল্প কেমন লাগলো?
‘এ তো আষাঢ়ে গল্পের চাইতেও এক সিড়ি উপরে, হাহ্। নতুন রাণীকে এতদিনে নিশ্চয়ই ধরে ফেলতে পারতেন রাজা ।’
তাই বুঝি?
‘ হাঁ তাই, তুমি মশাই রুপকথার সুন্দর পথটুকু ধরলে না, ওদিকে বাস্তবের সূত্রটুকু তাও খাটে না তোমার কাহিনীর গর্ভে । কিছু মনে নিও না কথক, এই সন্ধ্যাকালে নিতান্তই খানিক সময় নষ্ট করলাম বলে মনে হচ্ছে ।’
নষ্ট হওয়াই যে নিয়তি । আগন্তক শ্বাস ফেলে বলে ।
‘কিন্ত…. কিন্ত….’ শ্রোতার চেহারায় কেমন অন্যমনস্ক সুর । ‘ তোমার গল্পের সবটা মিলিয়ে কোথায় কি যেন একটা কথা বলবার আছে তোমার । অনুভব করছি, ধরতে পারছি না পুরোটা একসাথে মিলিয়ে ।’ আগন্তক মৃদু হাসে ।
শ্রোতা উঠে পড়ে । বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে হাঁটতে শুরু করে বিস্তৃত পথের কিনারে ।
আগন্তক পিছন থেকে উঁচু গাঢ় স্বরে বলে, মানুষ বারবার মায়াবতীকে ডেকে আনে কেন জানো?
শ্রোতা জানে না । সে হাটতে থাকে । আগন্তক আনমনে বলে চলে, আমিও জানি না । শুধু দেখে যাই । কোনো এক আদিগন্ত মিথ্যা কেমন অদ্ভুত মায়াবতীর রুপ নিয়ে পৃথিবীর ওপর চেপে আছে জীবনভর ।
শ্রোতা থেমে যায় । পিছন ফিরে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করে, ‘ –অর্থাৎ… ‘ । তারপরই চুপ করে । সেখানে সেই পাকুড় গাছের তলায় তখন কেউ ছিল না ।