ছন্দময় ভঙ্গিতে রাজহাঁসটি হাঁটছিল। মরাল গ্রীবা উঁচু করে হাঁটছিল কংক্রিটের মেঝেতে। হাঁটছিল আর তাকাচ্ছিল চারদিকে। ভাবছিল, কোথায় এলাম। সঙ্গী-সাথিরা নেই, গাছগাছালির মায়াময় স্পর্শ নেই। ওর মনে হচ্ছিল, বড় কঠিন আর নির্মম জগতে এসে পড়েছে। রাজহাঁসটির আজ ভারি মন খারাপ।
হঠাৎ করে ওখানে এল বিন্নি, বিন্তি আর বিন্দি। একরাশ খুশি ছড়িয়ে ওরা বলল, দাদু রাজহাঁস আমরা কিন্তু পুষব। দেখো অনেক আদর করব আর খাওয়াব। ওর কোনো কষ্ট হবে না। অবাক বিস্ময়ে শিশুদের দেখছিল রাজহাঁস। মাঝে মাঝে হাঁটছিল তবে গর্বিত ভঙ্গিতে নয়, ওর হাঁটার মধ্যে ছিল কান্নার মতো করুণ এক আর্তি। বিন্নি, বিন্তি আর বিন্দির কথা শুনে মনে হলো পৃথিবীটা এখনো অতো নিষ্ঠুর হয়নি। শিশু তিনটির মুখশ্রী কিছুটা আনন্দিত করেছিল ওকে। ওদের নিষ্পাপ চাহনি বড় ভালো লাগছিল ওর। ওরা যখন এসে রাজহাঁসটির গায়ে হাত রাখল তখন মনে হলো বড় আপনজনের মতো এই স্পর্শ।
বিন্নি বিন্তি বিন্দি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদু তুমি কিন্তু ওকে দেখে রেখো। কেউ যেন নিয়ে না যায়। দুপুর হয়েছে। বিন্নিরা রাজহাঁসটিকে খাবার এনে দিল। বেশ খানিকটা ভাত। তারপর বলল, আমরা খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব। তুমি এখানে থেকো।
ভাত খাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না রাজহাঁসের। ও ভাবছিল গ্রামের কথা। বড়োই মায়াময় সেই গ্রাম। অজস্র পাখির কলতান; নিবিড় ভালো লাগার মায়াময় পরিবেশ রাজহাঁসটিকে ব্যথিত করে তুলছিল। সেই গ্রামের পুকুরের নিস্তরঙ্গ জল ওকে টানছিল। বড় বেশি টানছিল। পুকুরে সাঁতার কাটার সেই অপরূপ দৃশ্য মনে পড়ছিল। আহা কী শান্তি। এখানে শান্তি নেই, সব আনন্দ নির্বাসিত।
বিন্নিদের কথা ভাবছিল। চারদিকে তাকাল রাজহাঁসটি। কোথাও ওরা নেই। এমন সময় মানুষ এসে ওকে ধরে নিয়ে গেল। অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তখনো সেই গ্রামের জলের স্পর্শ ওকে টানছিল। সেই স্পর্শ সারা শরীরে মেখে রাজহাঁসটি নির্বাক হয়ে গেল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল মানুষের দিকে। হাতে চাকু। মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন? পৃথিবীকে শেষবারের মতো দেখার আগে বিন্নিদের কথা মনে হলো। ও দেখতে পেল তিনজোড়া সজল চোখের করুণ মায়াময় চাহনি।
সেই দৃশ্য সহ্য করা বড় কষ্টকর। সমস্ত শরীরে আমার বিষণ্ণতা। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। কী দেখছিলাম মনে নেই। ভয়ানক এক নিষ্ঠুর দৃশ্য অবলোকন করছিলাম।
বিন্নিরা এল। অঝরে কাঁদছিল ওরা। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদু তুমি রাজহাঁসটিকে ধরে রাখতে পারলে না।
ওদের সজল চোখের ধারা অজস্র ধারায় সিক্ত করল আমাকে। বিন্নি-বিন্তি-বিন্দি বলল, তুমি পচা দাদু।
বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমি কি মানুষ? আমার এখানে দোষ ছিল না, তবু নিজেকে মানুষ ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হলো পৃথিবীর সবকিছু পচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেছে। এই পরিবেশ থেকে পরিত্রাণ পাবার কোনো উপায় নেই।