মকবুল এক ভবঘুরে। অনেকে তাকে পাগলও বলে। খিলগাঁও রেলগেটের আশেপাশের এলাকায় পথের পাশে ধুলাবালি মেখে সে পড়ে থাকে। তার থাকা, খাওয়া, ঘুম—সব ওই পথের ধারে ফুটপাতের উপরই। পরনে তার ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে যাওয়া রঙের শতচ্ছিন্ন পোশাক। সে দিনের বেশিরভাগ সময় ফ্লাইওভারের নিচে ঠাঁই বসে থাকে, কখনও বা এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়িয়ে কারও ছোটখাটো ফাইফরমাশ খেটে এক–দু-পয়সা জোগাড় করে পেটে কিছু দেয়, আবার মাঝেমধ্যে এ–তার কাছে হাত পাততে চেষ্টা করে। কেউ হয়তো এক–দুই টাকা দেয়, তবে বেশিরভাগই ফিরিয়ে দেয়। কারণ ভিক্ষা–ব্যবসায় লাভবান হওয়ার মতো আকর্ষণীয় শারীরিক ত্রুটি বা বয়স তার নেই। তার এক পা পঙ্গু বা এক হাত না থাকলে হয়তো সেই কমতিকে পুঁজি করে লোককে অধিকতর আবেগায়িত করে এক–দু পয়সা বেশি রোজগার করা যেত। এদিকে বয়স খুব বেশি নয়—অক্ষম বৃদ্ধ সে নয় আরকি। তাই লোকও খুব একটা আগ্রহী নয় তার মতো শারীরিক ত্রুটিহীন জোয়ানমস্ত বেটাকে ভিক্ষা দিতে।
ক্ষিধে পেলে কখনও কখনও রাস্তার পাশের ছোট হোটেলগুলোর মালিকের কাছে গিয়ে খাবার চায়। কখনো–সখনো হয়তো দিনশেষে বেঁচে যাওয়া খাবারের কিছুটা অংশ সে পায়। আবার কিছুই না জুটলে, হোটেলের মালিকেরা সব ফিরিয়ে দিলে খুব বেশি পেটের টানে সে হয়তো ডাস্টবিনের দিকেই ছুটে যায়। মারণ–খিদের যন্ত্রণায় ডাস্টবিনের দুর্গন্ধময় উচ্ছিষ্টকেও বিস্বাদ বলে মনে হয় না তখন। ক্ষিধে মানুষকে দিয়ে সবই করায়—বহু অসম্ভবকেও বাস্তবে রূপ দিয়ে ছাড়ে এই বুভুক্ষ শরীর।
আজ দিনটা বেশ ভালো যাবে বলেই মনে হচ্ছে। বেশ খিদে পেয়েছে তার। গতকাল দুপুরের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি। আশপাশের পাতি মাস্তান রাজু তার হাতে একশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল বিকেলের দিকে বড় মাঠের দিকে উপস্থিত থাকতে। সেখানে আজ কোন এক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি আছে, গিয়ে গ্যাঞ্জাম করতে হবে—এই ভাঙচুর, আগুন ধরিয়ে দেওয়া আরকি। রাজু অবশ্য সবাইকে অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে না, তবে মকবুলকে দেয়। সে জানে মকবুল টাকা পাওয়ার পর কাজে ফাঁকি দেয় না—সে ঠিকঠাক কাজটাই করে। বহু বছর থেকেই এই পথে পড়ে থাকতে দেখেছে তাকে। আগেও মকবুলকে দিয়ে বহু কাজ করিয়েছে সে। সবই তার ওই দলের কাজ—ওই গ্যাঞ্জাম বাঁধানোর।
কাজটা শেষ হলে আরও কিছুটা টাকা পাওয়া যেতে পারে। টাকা পাওয়া না গেলেও একটা ভালো খাবারের প্যাকেট অন্তত পাওয়া যাবে, অথবা পাত পেড়ে এক থালা। খাবার বলতে কখনও বিরিয়ানি, কখনও বা খিচুড়ি–মাংস অথবা ডাল–মাংস–ভাত। তার ভালো–মন্দ যা খাওয়ার সব ওই রাজনৈতিক দলগুলোর নানান গ্যাঞ্জামেই প্রাপ্তি ঘটে। এদিকে বা আশেপাশের এলাকায় রাজনৈতিক সভা–সমাবেশ বা গন্ডগোল থাকলে সে ছুটে যায়, সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার বস্তির ছেলেপিলে, রাস্তায় বসবাসকারী তার ভবঘুরে সঙ্গীরাও জুটে। সবাইকেই টাকা অথবা খাবারের বিনিময়ে ভাড়া করে বড় নেতার ছোট চ্যালাপ্যালারা—কখনও একশো টাকা, কখনও দুটো সিঙ্গারা, কখনও এক থালা অন্নে।
রাজুর কথামতো বিকেলের দিকে সে ও তার আর–সকল পথবাসী সঙ্গীসাথীরা মিলে বড় মাঠের পেছনের দিকে গিয়ে জড়ো হলো। বড় মাঠে গণসমাবেশে অন্য একটা রাজনৈতিক দলের বড় নেতা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বড় মাঠের পুরোটা অগণিত মানুষে পরিপূর্ণ। মানুষের ভিড় মাঠ ঠেলে মোড়ের ওদিকটা পর্যন্ত চলে গেছে—কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। মকবুল ও তার সঙ্গীসাথীদের হাতে কিছু লাঠি দেওয়া হলো। রাজুর দলের কর্মীরাও লাঠি ও হকিস্টিক হাতে সওয়ার হলো। সে যদিও দেখতে পাচ্ছে না, তবে সে জানে মকবুলের দলের কর্মীদের কতজনের হাতে ছুরি, রামদা ও বন্দুক রয়েছে। ভিড়ের মধ্যে তারা লুকিয়ে রয়েছে—সময়মতো আত্মপ্রকাশ ঘটাবে।
এর মধ্যে নেতার আরেকজন চ্যালা শাহীন বলল ভিড়ের বাম পাশটায় অবস্থান নিতে। তারা ইশারা করলেই সমাবেশে থাকা লোকজনের উপর আক্রমণ শুরু করতে হবে। সে ও তার সঙ্গীসাথীরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিল। নির্দিষ্ট সময় পার হতেই তাদের ইশারায় শুরু করল উপস্থিত জনতার উপর অতর্কিত আক্রমণ। জনতা দিগ্বিদিকশুন্য হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। এর মধ্যে বিপরীত দলের কর্মীদের সঙ্গে চলল তাদের ধাওয়া–পাল্টা–ধাওয়া। দু’পক্ষেরই বেশ কিছু লোক আহত হলো। তবে বিপক্ষ দলের নেতা মুরাদের অবস্থা মনে হলো বেশ খারাপ। তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে—ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। অচেতন পড়ে থাকা মুরাদকে দেখে সে বুঝতে পারছে না সে বাঁচবে কি না। তবে এই বেটা মরে গেলে সে বেশ খুশি হয়—বজ্জাত মুরাদ তাদের ভিক্ষার টাকার উপরও ভাগ বসাত। মানে এই এলাকায় ভিক্ষা চালিয়ে যেতে হলে তাকে রোজ নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো।
তারা এরপর শাহীনের নির্দেশে ছুটে গেল মঞ্চের দিকে। মঞ্চে থাকা বড় নেতা ওদের দেখেই পালিয়েছে কয়েকজন, আর বাকিরা পালানোর চেষ্টায় রত। তারা গিয়ে শাহীনের কথামতো মঞ্চে আগুন ধরিয়ে দিল। এদিকের কাজ শেষ হলেই শাহীনের কথামতো তারা বড় মাঠ ত্যাগ করে আধ কিলো দূরে ওভারব্রিজের নিচে জড়ো হলো—পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই। ওভারব্রিজের নিচে এইমাত্র চুলা থেকে নামানো কতগুলো খাবারের ডেকচি সাজানো রয়েছে। খিচুড়ি ও মাংসের সুঘ্রাণ আসছে। লোভনীয় খাবারের ঘ্রাণে তার পেটে থাকা ক্ষিধে আরও তীব্রভাবে চাড়া দিয়ে উঠল। সে সকলের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে গেল সুস্বাদু খাবারটির স্বাদ আস্বাদনে—লাইনটি যেন আর শেষ হচ্ছে না!
গতকাল থেকে তার কিছুই খাওয়া হয়নি। চারপাশে কি নিয়ে যেন আন্দোলন চলছে গত কয়দিন ধরে। রাস্তায় রাস্তায় গ্যাঞ্জাম। পুলিশ সাধারণ মানুষকে আটকাচ্ছে, তো সাধারণ মানুষ পুলিশের উপর চড়াও হচ্ছে। গতকাল থেকে পুরো ঢাকা শহরে কারফিউ জারি। প্রায়ই গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে।
দোকানপাটও সব বন্ধ। মানুষের কাছে দুটো পয়সা ভিক্ষা চাইবে কি—এই অবস্থায় সকলেই প্রাণ বাঁচাতে ঘরবন্দি। তাই মকবুলের পেটেও কিছু পড়ছে না গত কয়দিন থেকে। গতকাল থেকে একদমই কিছু খায়নি। চোখে সে অন্ধকার দেখছে। আশেপাশে কোন দোকানপাটও খোলা নেই যে কোন এক খাবারের দোকানে গিয়ে সে দোকানদারের কাছে পেটে দেওয়ার মতন সামান্য খাবার চাইবে। অনেক সময় হোটেলের মালিকরা দয়া–পরবশ হয়ে দুটো খেতে দেয়। সেই উপায়টিও খোলা নেই।
তার শরীর আর চলছে না। সে এক জায়গাতেই ঠাঁই শুয়ে রইল। এর মধ্যে হঠাৎ শাহীন এসে খবর দিয়ে গেল—মোড়ের ওখানটায় যেতে। তাদের আজ পুলিশের সঙ্গে গ্যাঞ্জাম করতে হবে। শাহীনের দলের লোকেরা আজ হরতালের ডাক দিয়েছে—সরাসরি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। খুব রিস্কি কাজগুলো। তবে ব্যাপার না—এ ধরণের কাজ করতে সে আগে থেকেই অভ্যস্ত। জাস্ট পুলিশের গায়ে কটা ইট–পাটকেল ছুঁড়ে মারতে হবে। সঙ্গে বিরোধীপক্ষের নেতার চ্যালাপ্যালারাও থাকতে পারে ওদিকে। তবে সাবধানে থাকতে হবে—যেন পুলিশ ধরতে না পারে। পুলিশ তাড়া দিলেই ছুটে পালাতে হবে।
এই কাজটা শেষ হলেই আবার সেই সুস্বাদু খিচুড়ি–মাংস! অথবা বিরিয়ানি! দূর থেকে যেন চুলা থেকে নামানো ধোঁয়া–ওঠা ডেকচির সুঘ্রাণ পেল সে! সেই খাবারের সুঘ্রাণেই যেন অভুক্ত শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে উঠে দাঁড়াল। সে হাঁটা ধরল—সুস্বাদু খাবারের লোভই তার দুর্বল শরীরটাকে মোড়ের মুখে এনে দাঁড় করাল। দুদিন পরে আবার সেই উদরপূর্তির সুযোগ! জাস্ট এই কাজটুকু মিটে গেলেই!
এদিকে গ্যাঞ্জাম শুরু হয়ে গেছে। তার দিকে প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে। বিপরীত দিকে পুলিশ—সরাসরি পুলিশের মুখোমুখি তারা! সকলে মিলে পুলিশের দিকে ইট–পাটকেল যা পারে ছুড়ে মারতে শুরু করল। চারপাশে পুরোই অস্থিতিশীল অবস্থা—কখন কার গায়ে পুলিশের গুলি এসে লাগে তার ঠিক নেই! এর মধ্যে তার দিকের লোকেরা রাস্তার পথচারী দু’জনকে পাটকেল নিক্ষেপ করে আহত করল। রাজুর গ্রুপের লোকেরা একজন পুলিশ সদস্যের মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করল। পুলিশ সদস্যটির অবস্থা বেশ গুরুতর—মাথার খুলি ভেঙে সমানে রক্ত বেরোচ্ছে, সম্ভবত স্পট ডেড। নিজেদের কর্মীর উপর এরকম সহিংস আক্রমণে পুলিশ সদস্যরা আরও ক্ষেপে উঠেছে। ক্রমাগত তাদের দিকে গুলি ছুঁড়ছে।
মকবুল পথ থেকে বড় সাইজের একটি ইটের টুকরা নিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারল, যেটি গিয়ে লাগল তাদের মুখোমুখি থাকা এক পুলিশ সদস্যের গায়ে। পুলিশ এবার তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে লাগল। দুটো গুলি ছুঁড়েছে ইতোমধ্যে, তবে লক্ষ্যভেদ হয়নি। তার আর–সকল সঙ্গীসাথীরা পেছনদিকে ছুটে পালাতে চেষ্টা করছে—বেশিরভাগই পালিয়ে গেছে। মকবুলও বাঁচার চেষ্টায় পড়িমরি করে ছোটার চেষ্টা করল, তবে গত দুইদিন অভুক্ত থাকা দুর্বল শরীরটা তাকে এবার আর সেই সাহায্য করল না। তীব্র ক্ষুধায় জর্জর শরীরটা নিয়ে ছুটতে গিয়ে সে মাথা ঘুরে পড়ল। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হয়তো করল, কিন্তু এবার উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেহে আর সেই বলটা ফেরত পেল না—যে জোরটা সে পেয়েছিল ঘণ্টাখানেক পূর্বে এখানে আসার সময় দূর থেকে ভেসে আসা খাবারের সুঘ্রাণে। ঘুরে উঠতে না পারা তার কাহিল শরীরটাতেই দুটো বুলেট এসে বিদ্ধ করল।
মকবুল আর কোন শব্দ করল না, একদম ছটফটও করল না—স্থির হয়ে রইল। হয়তো মৃত্যুযন্ত্রণাকে অনুভব করতেও কিছুটা শক্তির দরকার পড়ে—সেটুকু শক্তিও তার বুভুক্ষ শরীরটাতে উপস্থিত নেই।