রইছুদ্দিনের চারপাশে তার পরমাত্মীয়রা দাঁড়িয়ে আছে, নজর তার আনকোরা চোখে। একটু পরেই মোড়ক উন্মোচন হবে। তুলো দুটো সরানোর পর রইছুদ্দিন শুনতে পান, “ধীরে ধীরে চোখ খুলুন।” তিনি সেটাই করেন। সামনের দৃশ্য খুবই অস্পষ্ট দেখায় শুরুতে। অল্প আলোতেও চোখ মেলতে কষ্ট হয়৷ তবুও তিনি হাল ছাড়েন না। একসময় পুরোপুরি চোখ মেলেন।
দীর্ঘদিন চোখের জটিলতার পর রইছুদ্দিন স্বাস্থ্যবণিকের দর্শন নিয়েছিলেন। প্রথম ধাক্কায় বিবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষা। তারপর পথ্য ও উপদেশ। রইছুদ্দিন সেসব মানলেন কি মানলেন না। চিরতরে চোখগুলো হারিয়ে বসলেন। এতে তার অনুগতরা, যারা তার আদেশ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতো, যেন দিকশূণ্য হয়ে পড়লো৷শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে নিজেরা ঠোকাঠুকিতে দুই চারটা মরে গেলো। রইছুদ্দিন স্বাস্থ্যবণিককে অত্যন্ত আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে বললেন, “মানি ইজ নো প্রবলেম ডু এভরিথিং ইউ ক্যান। দেখছেনই তো। আমার নেতৃত্ব ছাড়া আমার শিষ্যরাও অন্ধ।”
স্বাস্থ্যবণিক তাকে আশ্বস্ত করেন। তার পরিবার ও শুভার্থীরা স্বান্তনা ও বিশ্বস্ততার প্রমাণার্থে তাকে ঘিরে রাখে। যদিও তিনি এখন আর কাউকে দেখতে পান না। সেটা অবশ্য তাদেরই সৌভাগ্য। আজীবন ক্ষমতার বেদির পুরোহিত হিসেবে বরপ্রাপ্ত সন্দেহবাতিক চোখগুলো নিশ্চিত দেখতে পেতো নিপুণভাবে ভেক ধরা জীবগুলোর দু’চোখে কী পরম আগ্রহ। সেই আগ্রহ তার দৃষ্টি পুনর্লাভের জন্য নয়। পরবর্তী পূজারী হওয়ার কামনায়, তার পতনের।
তিনি স্বাস্থ্যবণিককে তাগাদা দেন৷ বণিকের উত্তর, “আপনি মানি লোক। যেন তেন চোখ কি আর আপনাকে দেওয়া যায়! সেটা হতে হবে বড় কোন ব্যক্তিত্বের। কেবল উপযুক্ত জনের মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি আমরা। আপাতত সবুরেই সফলতা।” নিরুপায় রইছুদ্দিন সবুর করতে থাকেন।
শেষমেষ, বণিক তার দেওয়া কথা রাখেন। এক শুভক্ষণে অপারেশন সম্পন্ন হয়। দেশের একজন স্বনামধন্য নেতার চোখ দেওয়া হয়েছে রইছুদ্দিনকে। গুণে (সম্পদে) ও মানে (ক্ষমতায়) রইছুদ্দিনের চেয়েও বড়। স্বাস্থ্যবণিকের সেরকমই ভাষ্য। যদিও বিরোধীদের কেউ কেউ ছড়িয়ে দিলো ভিতরের ঘটনা না কি ভিন্ন।
চোখদুটোর উৎস নাম না–জানা ঠিকানাবিহীন একটি মরদেহ। জটাজটধারী এই পাগল তামাম দুনিয়া ঘুরে এসে মরলো ঠিক বণিকের দরজায়। তিনিও উপস্থিত বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে সুযোগের সদ্বব্যবহার করে ফেললেন। এই ব্যাটা পাগলটার হিসেবে কৃতজ্ঞই হওয়া উচিত। তার কল্যাণেই তো এই উজবুকের নিতান্ত তুচ্ছ চোখদুটো অন্তত মরণোত্তর জাতে উঠতে পারলো। যদিও গ্রহীতার কাছে এমন ডাঁহা মিথ্যাচারের কারণ ঠিক পরোপকার নয়। নানাবিধ কারণ সেখানে থাকতে পারে। হয়তো এতদিন রইছুদ্দিনকে দেওয়া চাঁদার অর্থ কিছুটা পুনঃহাসিল করা। নিকট ভবিষ্যতে অদ্য উপকারের বিনিময়ে বাড়তি কিছু সুবিধা আদায়। অথবা অন্যকিছু। কে জানে!
এরপর,
“কোন দিকে লাইট?”
“ডানদিকে।”
“এখন কোনদিকে?”
“বাম।”
“ঐদিকে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকান। পড়তে পারেন?”
“পারি।”
“এই বার আমার দিকে তাকান।”
বিস্মিত রইছুদ্দিন স্বাস্থ্যবণিকের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বিস্ময় পরিণত হয় আতঙ্কে। আতঙ্কিত চোখ একে একে সবাইকে দেখে। কেউ আর আগের মতো নেই। সবাই বদলে গেছে। বণিকের মুখের দুই পাশ দিয়ে ভ্যাম্পায়ের মতো দুই শ্বদন্ত বের হয়ে আছে৷ ঠোঁট ফাঁক হতেই দুই পাটি করাতের মতো দাঁত দেখা যাচ্ছে। স্ত্রীর সারা মুখে-হাতে ছোপ ছোপ কালো দাগ। এগুলো আগে ছিলো না৷ একই দাগ দীর্ঘদিনের সহকারীর হাতে-মুখেও। কন্যার মুখ দিয়ে সরীসৃপের মতো জিভ বের হয়ে ঢুকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ছেলের মাথা হাঙ্গরের মাথার আকার নিয়েছে৷দীর্ঘ দিনের পিএসের মুখটা ছুঁচালো হয়ে গেছে। নাকের নীচে লম্বা লম্বা ছুঁচালো গোঁফ। অনেকটা ইঁদুরের মতো। রইছুদ্দিন নার্ভাসলি ঢোক গিললেন।
“কি ব্যাপার রইছ সাহেব? কোন সমস্যা?”
“আয়না আছে?”
একজন ভূতের মতো ফ্যাকাসে ও চোখের পাঁপড়িহীন সেবিকা একটি আয়না এগিয়ে দিলে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তিনি। কপালের উপরে বাঁকানো দুটো শিং।
রইছুদ্দিনের কাঁপা কাঁপা আঙ্গুল কপালে বুলিয়ে সেগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।