টিউলিপের গন্ধে ভাসি

টিউলিপের গন্ধে ভাসি

একজন অদ্ভুত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলেসের ওয়েস্টার্ণ বেলিভিউয়ের একটি মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে। লোকটির নাম ছিল বিলি উইল্ডার। বয়স সত্তর বছর হবে। আগ বাড়িয়ে বিলি নিজেই আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল। বিলি মুহূর্তে দেখা মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারত। যেমন আপন করে নিয়েছিল আমাকে।

বিলি একা মানুষ। তাই হয়ত তার ভিতর মানুষকে কাছে টানার টান ছিল প্রগাঢ়। সে উইকেন্ডে আমার গ্রামের্সি প্লেসের হোস্টেলে এসেছিল বেশ কয়েকবার । সত্তর বছর বয়স তার। অথচ সে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করত। একদিন অনেকটা জোর করেই সে আমাকে তার রাইটউডের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।

সেদিন ছিল বসন্তের এক উজ্জ্বল দিন। বৃষ্টির মেঘ নেই আকাশে। ঝিকিমিকি রোদ্দুরের নিচ দিয়ে গাড়ি চলছিল। লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির বাইরে আর একটি ছোট শহর রাইটউড। সেই শহরের শহরতলিতে বিলির বাড়ি। যেতে যেতে পথের দুপাশে অজস্র টিউলিপ ফুলের প্রান্তর পড়ে। এত ফুল একসাথে এর আগে কখনও আমি দেখিনি। কী এক অদ্ভুত গন্ধে বর্ণে উদ্ভাসিত ছিল চারদিকে। বিলি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিল। গাড়ির স্টেরিওতে একজন অজ্ঞাত শিল্পীর একটি মেলোডি গান বাজছিল। খুবই মায়াবী ছিল সে সুর। অপূর্ব ছিল গানের কথা। যার অর্থ — ‘পথেই পথ মিলে আর একটি পথের, আমরা দুজন চলছি , সেই পথের দিকে। আমরা মিলব ঐ সুদূরে।’

রাইটউডের শহরতলির একটি নির্জন গ্রেভইয়ার্ডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গ্রেভইয়ার্ডের শেষ প্রান্তে একটি নিরিবিলি বাড়ির সামনে যেয়ে গাড়িটি থামে। আশেপাশে অন্য আর কোনও বাড়ি নেই। আমি বিলিকে বলি — ‘এইটি কী তোমার বাড়ি?’ বিলি বলে, হ্যাঁ, এইটি আমার বাড়ি।

বাড়িটিতে অন্য আর কোনও মানুষ নেই। চার কক্ষ বিশিষ্ট একতলা বাগান বাড়ি। বাড়ির সামনে রাস্তার ঐ পাশটায় গ্রেভইয়ার্ডের সীমানা। কবরস্থানটা খুবই মনোরম। টিউলিপ ফুলসহ নানারঙের, নানা বর্ণের ফুলে ফুলে শোভিত।

আমি বিলিকে বলি —- ‘তোমার কী আর কেউ নেই?’
—- আমার দুইটি ছেলে আছে। ওরা স্ত্রী সন্তান নিয়ে অন্য স্টেটে, অন্য শহরে থাকে।
—- তোমার স্ত্রী নেই?
—- আছে। ঐ যে গ্রেভইয়ার্ড দেখেছ, এর মাটির তলায়
সে শুয়ে আছে।

বিলির কাছে থেকে যা জানতে পারি, তার স্ত্রী ছিল একজন সঙ্গীত শিল্পী। ছোট ছোট ঘরোয়া পার্টিতে ও মিউজিক রেস্টুরেন্টে গান গাইত সে। নাম ইভা গ্যাবর। আর, বিলি উইল্ডার নিজে ছিল একজন গীতিকার ও সুর শিল্পী। গাড়িতে আসতে আসতে যে গানটি শুনেছিলাম, সেই গানটি গেয়েছিল ইভা গ্যাবর। আর গানটি লিখেছিল ও সুর করেছিল বিলি উইল্ডার।

বিলি আর ইভার ছিল বিয়াল্লিশ বছরের সুখের দাম্পত্য জীবন। প্রেম করে ওরা বিয়ে করেছিল। বিলির লেখা গান ও সুরে কণ্ঠ দিত ইভা। গান লিখতে লিখতে, গানের সুর তুলতে তুলতে, আর গান গাইতে গাইতে দুজনের ভিতর প্রণয় গড়ে ওঠে। তারপর বিয়ে করে। ঠিক তার বিয়াল্লিশ বছর পর ইভা বিলিকে ছেড়ে পরপারে চলে যায়। বিলি হয়ে যায় একা।

বিলি ঘুরে ঘুরে ওর স্টুডিও রুমটি দেখাচ্ছিল। দেয়ালের গায়ে অনেক গুলো ইভার ছবি সাঁটা আছে। ঘর ভর্তি গানের ইনস্ট্রুমেন্ট। আমি বিলির চোখে মুখের দিকে তাকাই। কী অবাক বিষণ্ন চাহনি। সে গরগর করে বলে যাচ্ছিল — ইভার যত সফলতার কথা।

আমি কৌতুহল ভরে বিলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি জৌলুসপূর্ণ লস অ্যাঞ্জেলেস ছেড়ে এই ছোট্ট শহরে, এই নির্জনে কবরস্থানের পাশে কেন বাড়ি কিনলে? কেন এখানে থাকো? এখানে একাকি থাকতে তোমার ভয় করে না?

বিলি উত্তর দিয়েছিল, দিনের একাকীত্বে, নিঃসঙ্গ রাত্রির মধ্য প্রহরে আমি মগ্ন চিত্তে ওর গান শুনি। মন খারাপ লাগলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই সমাধির পাশে। বসে থাকি চেরী ফুলের ছায়ায়। টিউলিপের গন্ধে ভাসি। দূর কোথাও থেকে ওর গান ভেসে আসে। নির্জনে যে ওকে আমি নিবিড় করে কাছে পাই।

বিলির জন্য, ইভার জন্য আমারও মনটি কেঁদে উঠে। পৌঢ় বিলি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে এত ভালবাসে? আমি বিলিকে বলি — ‘ চল ইভার সমাধির পাশে। আমি ওর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করব।’

বিলি আমাকে নিয়ে যায় ইভার সমাধির পাশে। কবরের চারিদিকে কত রকমের ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। দূর্বা ঘাসের উপর কতো বৃষ্টি ঝরে পড়ে। কত ফুলের সুবাসে ভরে আছে এখানের বাতাসে। শ্বেত পাথরের সোপানের উপর লেখা আছে :

Here lies my wife, I bid her Goodbye
She rest in peace.

EVA GABOR

( 1948 — 2009 )

” Where have you gone for beyond me,
Far away
How many songs written about you
How many tune old …..”

ইভার কবরের কাছে নীরবে দাঁড়িয়েছিলাম আমি আর বিলি। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। দূরের সান গ্যাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে ভেসে আসছিল সজল বাতাস। টিউলিপ ঝাড়ের ফুলগুলো মৃদুমন্দ দুলে উঠেছিল। একবার চেয়েছিলাম বিলির চোখের দিকে। দেখি, তার চোখের কোণ্ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু কণা ঝরে পড়ছে।

~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত