মৌমিতা কিংবা জোছনার গল্প

১.
চার বছর পর মৌমিতার খবর পাই; সুমিতের কাছ থেকে।

সুমিত আমার স্কুল ফ্রেন্ড। মৌমিতাও। এসএসসির পরই ঢাকায় চলে আসায় স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যোগাযোগের মাধ্যম তখন এত বেশি ছিল না। ফেসবুক-টুইটার তো দূরের কথা, কলেজপড়ুয়া ছাত্রের হাতে মোবাইল ফোনও অনেক অভিভাবক বাড়াবাড়ি ভাবতেন। তাই ওদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখা হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় অনেকের সঙ্গে এই দূরত্ব ঘুচে যায়। কিন্তু যাদের সঙ্গে তখনো দেখা হয়নি, সুমিত তাদেরই একজন। আর মৌমিতা?

মৌমিতাকে বন্ধু বলে পরিচয় দিলাম। আসলে স্কুলের দিনগুলোতে আমার কাছে ও ছিল তার চেয়ে একটু বেশি। নির্দিষ্ট করে বললে সেই অষ্টম শ্রেণি থেকে। তবে ও কখনো তা জানতে পেরেছিল কি না আমি জানি না। ওর সামনে যে আমি উন্মুখ হইনি কখনো। টিনএজ বয়সের প্রেম কিংবা ভালো লাগা যেমন হয়, মৌমিতার প্রতি আমার ব্যাপারটাও হয়তো তেমনই ছিল। তবে আজ এত দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে বলতে পারি মৌমিতাই আমার প্রথম ভালো লাগা, প্রথম ভালোবাসা।

সুমিতের সঙ্গে সেদিন দেখা কমলাপুর স্টেশনে। যাচ্ছিল রাজশাহী। রাজশাহী ভার্সিটিতে ও ফিজিকসে পড়ছে। আমরা প্ল্যাটফর্মে বসেই গল্প শুরু করি। এক ফাঁকে জানতে পারি মৌমিতার কথা। সুমিতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সেখানে আমাদের ব্যাচের আর কেউ আছে কি না। তখনই ও মৌমিতার কথাটা পাড়ে। মৌমিতা নাকি সেখানে পড়ছে সাংবাদিকতা বিভাগে।

সুমিতের মুখে মৌমিতা নাম শুনেই আমার হৃদয় কেমন তোলপাড় করে ওঠে। আমি ফিরে যাই আমার কৈশোরে, স্কুলের সেই দিনগুলোতে। আমার চোখে ভাসতে থাকে ক্লাস এইটের একটি স্মৃতি।

২.

বর্ষণমুখর দিন ছিল সেদিন। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই দুপুরবেলায় আমরা স্কুলে এসেছি বৃত্তি কোচিংয়ের জন্য। ক্লাসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, তবু স্যারের দেখা নেই। আমরা তাই ক্লাসে বসে গল্প করছিলাম। ঠিক সেই সময় আমার চোখ পড়ে বাঁ দিকে মেয়েদের সারিতে। সেকেন্ড বেঞ্চের কোনায় বসা মেয়েটির ওপর থেকে আমি চোখ সরাতে পারি না। মেয়েটি তার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলছে, সেই কথা বলার ভঙ্গিতে কেমন নৃত্য খেলা করছে। মাঝেমধ্যে ডান হাত দিয়ে মাথার চুল শাসন করছে। বেয়াড়া চুলগুলো তবু বারবার কপালের সামনে চলে আসছে। মুহূর্তটাকে আমার স্বপ্ন বলে মনে হয়। আমি হারিয়ে যাই অচেনা কোনো দিগন্তে। আমার মনে পড়ে ক্লাস সেভেনে আকাশ স্যারের বলা সেই কথাটা, ‘সবার জীবনেই প্রেম আসে…।’

প্রেমের পরশে আমার এক বন্ধুকে কবি হতে দেখেছিলাম। আমি তেমনটা না হলেও পড়াশোনাটা আমার মাথায় ওঠে। এসএসসির পর বাবা-মা আমাকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। আমি কলেজে ভর্তি হই। দিন চলতে থকে। কিন্তু মৌমিতাকে আমি ভুলতে পারি না।
৩.

আজও ভুলিনি। তাই সুমিতের কাছ থেকে মৌমিতার পাওয়া নম্বরে ফোন দিই। বহুদিন পর কথা হয় আমার মৌয়ের সঙ্গে। আমি আবারও সেই কৈশোরের মতো পাগল হয়ে উঠি। আমার মন শুধু চায় মৌমিতার সঙ্গে সারাক্ষণ কথা বলতে। দ্বিতীয় দিন কথা হওয়ার পর তৃতীয় দিন আমি আমার মনের কথা বলার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু সেদিন আর ফোনে ওর সংযোগ পাই না, শুধুই ব্যস্ত দেখায়। আমার হৃদয় ব্যাকুল হতে থাকে। একপর্যায়ে ফোন দিই অন্য নম্বর থেকে। এবার কলটা ঢোকে। আমার কণ্ঠ শুনেই ওপাশ থেকে মৌমিতা বলে ওঠে, ‘তুমি আর কখনো ফোন দিয়ো না প্লিজ। আমার হাজবেন্ড মাইন্ড করে।’

৪.

আকাশে চাঁদ ছিল সেদিন। পূর্ণ চাঁদ। কিন্তু সেই চাঁদকে আমার নিষ্ঠুর মনে হয়। সেদিন থেকে আমি আর জোছনা দেখি না।

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত