‘খাব না’ বলে চিৎকারটা এতো জোরে করে ওঠে রাফিয়া যে আরেকটু হলে মামুনের হাত থেকে দুধের গ্লাস টা পড়ে যেতো। চমকে ওঠার ফলে গ্লাস থেকে খানিকটা দুধ ছলকে যায়।
মামুনের রাগ এবং ধৈর্যের সীমা তখন মাত্রা ছাড়িয়েছে। সেও চিৎকার করে বলে–
খাইস না। মর। তুই মর। মরলে বাঁচি আমি!
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দুধের গ্লাসটা ঠক করে রাখে টেবিলের উপর। সেই শব্দে রাফিয়া আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। সামান্য তম শব্দও সে বরদাশত করতে পারে না যখন প্যানিক এটাক হয়। ভয়ের চোটে এখন তার কণ্ঠনালী হতে খানিকটা হিককার মতো শব্দ ওঠে। এবং নিজেই জবরদস্তি তা গিলে ফেলে। মামুনের রাগ ধীরে ধীরে বাড়বে রাফিয়া জানে। হাত দুটো অজান্তেই বুকের সাথে ঠেকিয়ে, দুই হাটু জড়ো করে আরো ছোটো হয়ে বসে। রাগ হলে মামুন মানুষ থাকে না। জান্তব ভাব ভর ওর ভেতর। যদিও মামুনের এই রূপটি রাফিয়া আগে জানতো না। কল্পনাও করতে পারতো না। মা মারা যাবার পর বাবার কাছে রাফিয়া খুবই আদরে বড় হয়েছে। রাগ, ধমক কিছু শুনতে হয়নি।তাছাড়া বাবা থেকেছে তার মতো রাফিয়াকে ছেড়ে দিয়েছে নিজের মতো। আজ আর রাফিয়া নিজের মতো নেই। নিজের মতো বলে কিছু ছিলো কী তার জীবনে?
মামুন নিজের হাত পরিষ্কার করে এ্যাটাচি ব্যাগটা কাঁধে নেয়। মোবাইল পকেটে ঢুকায়। গাড়ির চাবিটা উঠায়। প্রচন্ড ক্ষিপ্র এখন তার ভঙ্গি। বিড়বিড় করে করে বলতে থাকে, ‘আমারও একটা সহ্যের সীমা আছে, আমি তো মানুষ, নাকী জানোয়ার হ্যাঁ? ‘ তারপর হিংস্র চোখে তাকায় রাফিয়ার দিকে। যেন কাচা খেয়ে ফেলবে ওকে। আজকাল এই দৃষ্টিটা সে প্রায়ই হানে রাফিয়ার দিকে। যখন থেকে রাফিয়া বিয়ের বিষয়ে কথা বলা শুরু করলো। তার আগ পর্যন্ত এই মূর্তি সে খুব যত্নে গোপন রাখত নিজের ভেতর। প্রেম ভরা, কাম ভরা, মাদকতায় ডুবুডুবু চোখেই তাকাতো সে সব সময়। রাগ বিরক্ত কিছু হতে হয়নি রাফিয়ার প্রতি। এতো লক্ষী আর প্রেমিকা মেটেরিয়াল মেয়ে মামুন আগে পরে কখনও দেখেনি। বাইরে রাফিয়া খুব উড়নচণ্ডী দেখালেও ভেতরে সে অভাবনীয় কোমল যেন ছুঁয়ে দিলেই গলে জল হয়ে যাবে। আজকালের মেয়েরা এমন নয়। তারা খুব প্রেম প্রেম ভাব দেখায়। অল্প সময়ের মধ্যেই সে প্রেম উবে গিয়ে কেবল চাই চাই, দাও দাও, লাগবেই লাগবে পরিনত হয়। টাকা, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, পজিশন। এর মধ্যে অভিনব ঘটনা হলো এক নায়িকা দাবি করে বসলো তার মায়ের ট্রিটমেন্ট করাতে বিদেশে নিয়ে যেতে হবে এবং ভাইকে ইংল্যান্ডে পড়াশোনার খরচ দিতে হবে। কাহাতক ভালো লাগে। এদের টাইট দিতে জানে মামুন। আকাশের স্টার থেকে পথের ভিখিরি করতেও জানে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মামুনের। মেয়েরা এমন হয় কেন!
দেড় বছর ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ রাফিয়া। তার সাথে সময় কাটালে, নিজেকে জড়িয়ে রেখে এখন নিজেকেও মাঝে মাঝে পাগল মনেহয়। এখানে রাফিয়া পাগলামি করছে। বাসায় গেলে বউ ঘ্যানঘ্যান করবে। ছেলে মেয়ে গুলো বাপকে টাকার মেশিন ছাড়া এখন আর অন্যকিছু ভাবে না শুধু ছোটো টা ছাড়া। খুব বাবার নেওটা ছিল সে। তার চেহারার দিকেও আজকাল তাকানো যায় না। মিডিয়া গুলোও আছে সারাক্ষণ হা করে। কোনো শব্দ না করলেও তারা বাক্য সাজিয়ে খবর প্রচার করে দেয়। অবশ্য এদের ভয় করেনি মামুন। আগে-পরে অনেক ঘটনা ঘটেছে, গোপন করেছে, এড়িয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু রাফিয়ার ব্যাপারটা গোপন থাকেনি। ওকে নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে তৃতীয় সেশান নেবার পরপরই কেউ লিক করেছিল ঘটনাটি। এরপর মামুন রাফিয়াকে নিয়ে কাজের কথা বলে সিঙ্গাপুর চলে যায়। তার মনোভাব ছিলো – এবার কী লেখবা তোমরা?
কলার, টাই ঠিক করতে করতে মামুনের ভেতর কথা গুলো বাজতে থাকে – অথচ কীই এমন বেশি চেয়েছিলাম আমি? রাফিয়ার সাথে প্রেম’ই আমার অপরাধ? প্রেম কেন অপরাধ হবে? ভালো থাকার জন্যইতো প্রেম। একার ইচ্ছেতে বা জোর করেও করিনি কিছু। কবে কোন মেয়েকে মামুন জোয়ার্দার জোর করেছে? কেউ বলতে পারবে? উলটা নিজের সব ঢেলে দিয়েছি।
শোবিজ ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধার মামুন জোয়ার্দার। একইসাথে পরিচালনা, প্রযোজনা,পরিকল্পনা সব একা হাতে সামাল দেয়। সুন্দরী মেয়েরা নিজে থেকে যেচে এসে তার কাছে গলে যায়। একেকটা মেয়ে যেন সাক্ষাৎ আগুন। সেই আগুনের নৈকট্যে কোন পুরুষ পারে নিজেকে ঠিক রাখতে?
আর রাফিয়া সেখানে আস্ত দাবানল হয়ে এলো মামুনের জীবনে। একটু ভুল হলো। রাফিয়া আসেনি। মামুনই খানিকটা হিপনোটাইজড হয়ে দাবানলে জ্বলবে বলে রাফিয়াকে টেনে আনে। রাফিয়া যতক্ষণ আশেপাশে থাকে ততক্ষণ অ্যাড্রেনালিন হরমোন বিপুল পরিমাণে ক্ষরণ হতে থাকে মামুনের রক্তে। চরম রক্তচাপ আর উত্তেজনা অনুভব করে। সে অশান্তি প্রিয় লোক। জীবনে শান্তি কী জিনিস কখনও জানতে ইচ্ছে করেনি তার। রাফিয়া কাছে থাকলে ভুলে যায় তার বয়স ঊনষাট, নিজেকে আঠাশ বছরের যুবকের মতো ঝরঝরে বোধ হয়। কোনো নেশা দ্রব্য কিংবা আর কোনো নারীর সংস্পর্শে তার এমন হয় না। তবে রাফিয়াকে বিয়ে করতে রাজি নয় সে। বিয়ে করলেই এই উত্তেজনা, এতো চাপ সব নিবে যাবে। রোজকার ডাল ভাত হয়ে যাবে রাফিয়া! ভাবতে পারে না মামুন। স্ত্রী সন্তানরাও পরিস্কার বলে দিয়েছে বাইরের ঘটনা যেন বাইরে থাকে।
পাঁচ বছর আগে এক সন্ধ্যায়, বান্ধবীর সাথে রাফিয়া এসেছিলো শুটিং দেখতে। মামুন তখন ডিনারে ইনভাইট করেছে নতুন এক মডেলকে। সেই মডেলকে নিয়ে বাইরে যাবে বলে বের হয়ে চোখ পড়লো রাফিয়ার দিকে।
পাঁচ বছর আগে প্রথম দেখার সেই শকিং মোমেন্ট মামুন কখনও ভুলবে না। তিপ্পান্ন বছর বয়েসেও তার গুজবাম্প হলো কোনো তরুণীকে দেখে এটা নিজেও বিশ্বাস করতে পারেনি। পাতলা জর্জেট বা ট্রান্সপারেন্ট টাইপের ফিটিং সাদা কামিজ, সাদা চুড়িদার পরে এসেছিলো রাফিয়া। ওড়না টোরনা কিছু ছিলো না। স্লিভলেস, ডিপ নেক কাট কামিজটি আসলে শুধু নামে মাত্র পোশাক বলা যায়।
যদিও রাফিয়া প্রেম হবার পরে বলেছিল, ”যাহ! মোটেই এমন কোনো অশ্লীল কাপড় পরিনি আমি। আসলে তোমার চোখ খারাপ। আমি হোয়াইট শিফনের মধ্যে সিলভার কাজ করা খুবই শালীন পোশাক পরেছিলাম’।
মামুন হো হো করে হেসে ওঠে। বলে, ‘বেইবি তোমার শালীন পোশাকের ভেতর দিয়ে সব দেখা যাচ্ছিল কিন্তু’
রাফিয়া কন্ঠে রহস্যময়তা জড়িয়ে বলে, ‘বিকজ আমি হচ্ছি বেহেশতের হুরি। তাই সব দেখা যাচ্ছিল। আর তুমি বেহেশত নসিব হ্যাণ্ডসাম….’
এ ধরনের চমকদার কথা সব সময় রাফিয়ার ঠোঁটের আগায় এসে থাকে। যা মামুনকে চরম মানসিক উত্তেজনা দেয়। জীবনে মামুন শান্তির চেয়ে উত্তেজনাকে বেশি প্রাধান্য দেয় আজো।
শান্তির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। একই রকম রয়ে যায় শান্তিময় জীবন। ওটা চাইবে চাকরিবাকরি করা ছাপোষা মানুষ। তাদের জীবনের কোনো আলাদা ছবি থাকে না। বাপ দাদারা যেভাবে বড় হয়েছে, বিয়েথা করে সংসার করেছে, তেমনি করতে চেয়ে নিশ্চয়তা হিসাবে কলমপেষাকে আঁকড়ে ধরে।
তখন রাফিয়ার বয়স পঁচিশ। পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি হাইট। গায়ের রঙ যেন দৃষ্টি পিছলে যায়। দুর্ধর্ষ ফিগার স্টাটিস্কস! চোখে মুখে জড়তা হীন ঝলক। এতো লোকের মধ্যেও সবাইকে অগ্রাহ্য করে সিগারেট ফুঁকছিল হুশহুশ করে।
অবাধ্য ঘোড়া কে পোষ মানানোর পুলক কতটা জানে জোয়ার্দার। প্রথম দিনের মোক্ষম সাক্ষাতের লোভ সে সংবরণ করতে পারেনি। ডিনার ক্যন্সেল করলো। মডেলকে ম্যানেজারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে ডাক পাঠালো রাফিয়া আর তার বান্ধবিকে। বিনা কারণে যে এক মিনিট দেয় না কাউকেই।
দীর্ঘ সময় ধরে খানাপিনা, আড্ডা, মিলিয়ে যথেষ্ট সময় দিয়েছিল। সেদিনই মামুন একটা লোভোনীয় প্রস্তাব দেয় রাফিয়াকে, সিনেমায় নতুন মুখ খুঁজছে সে। সিনেমার চরিত্রের সাথে রাফিয়ার সব কিছু খুব যায়।
এমন অভাবনীয় প্রস্তাবে রাফিয়া হকচকিয়ে গেলো!
মামুন জানে নতুন পাখিকে খেলিয়ে খেলিয়ে আনন্দ নিতে হলে লম্বা সময় কাছে চাই।
সিনেমা শুরুর সময় নায়িকা ভাব দেখায় পরিচালকের সাথে গভীর প্রেম। তারপর সিনেমা করতে করতে নায়িকারা নায়কের দিকে ঝুঁকতে থাকে। বুড়ো, আধবুড়ো মাতাল পরিচালকরা একঘেয়ে হয়ে ওঠে খুব দ্রুত।
মামুন প্রথম দিনই সব জেনেছিল রাফিয়া সম্পর্কে। তিন বছরের বিবাহিত জীবনে, ছয় মাস হাজবেন্ডের সাথে ছিল। তারপর আমেরিকা থেকে একদিন ডিভোর্স লেটার এলো। বাবার বন্ধুর ছেলে বলে নামমাত্র কাবিনে তাদের বিয়ে হয়। তাই খোরপোশ আদায়ের জন্য যে উকিল ধরা হয় সে উকিল রাফিয়াকে প্রেম নিবেদন করে। অদ্ভুত লাগে এইসব প্রেম। জীবনে কতো প্রেম এসেছে, গেছে হিসাব করতে কাগজ কলম লাগবে রাফিয়ার। একবার ঠিক করেছিল তাকে যারা প্রেম নিবেদন করেছে সবার ডিটেইলস সে লিখে রাখবে।
একটু পর রাফিয়া সোজা হয়ে বসে। স্বর নিচু করে ভীত চোখে শুধু বলে, বউ ছাড়া এখন একটা রাতও থাকতে পারো না? না?
তাকায় মামুন স্থির দৃষ্টি নিয়ে। তার রাগ কমে গেছে। মায়া হয় অসুস্থ মেয়েটার জন্য। আর কেউ না জানুক মামুন তো জানে, সে-ই চেয়েছে রাফিয়া ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাক। আর কারো হতে দেবে না সে রাফিয়াকে। আবার তার সাথে থাকাও এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। নিজের তৈরী ফাঁদে সে শুধু রাফিয়াকে ফেলেনি। নিজেও আটকে গেছে।
কাছে এসে দৃঢ় হাতে রাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে। চুলে, মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আজ না হানি। আজ আমার ছোটো ছেলের জন্মদিন। ওর সাথে টাইম স্পেন্ড করব, ওকে কথা দিয়েছি। আগামীকাল অবশ্যই থাকবো তোমার সাথে। তিন দিন একসাথে থাকব আমরা দেখো’
রাফিয়া কাঁদে।
মামুন টেবিলের ওপর থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে জোর করে খাইয়ে দেয় রাফিয়াকে। যাতে শক্তিশালী কোনো ওষুধ মেশানো ছিলো।
তারপর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে ঘুমাও বেইবি, তোমার ঘুম দরকার।