অঝোর ধারায় বৃষ্টি
আলেয়া নামের সেই মেয়েটি এই ঢাকা শহরেই থাকে জানা ছিল না। আর জানার জন্য ঐরকম আগ্রহ কখনো হয়নি । তবে ওকে যে মনে পড়ত না, তা নয়। কখনো যদি অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে, আর সে সময়টা যদি দুপুরের হয়, তখন আলেয়ার কথা মনে পড়ে।
আলেয়ার সাথে সম্পর্ক কিংবা জানাশোনা ছিল মাত্র পঁচিশ ত্রিশ দিনের। আমরা তখন ভাড়া থাকতাম পুরনো ঢাকায় দীননাথ সেন লেনের একটি বাসায়। ঠিক পাশের বাসাটা ছিল আলেয়ার বড়ো বোনের । তারাও ভাড়া থাকত। আর এখানেই বেড়াতে এসেছিল আলেয়া। ঠিক বেড়াতেও নয়, ছেলে দেখাতে নিয়ে এসেছিল ওকে। আর এখান থেকেই ওর বিয়ে হয়ে যায়।
তখন ঢাকাতে ‘আলো তুমি আলেয়া’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। মরহুম ফতেহ লোহানী একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছিল। সেদিন রূপমহল সিনেমা হলে ম্যাটিনী শো ‘আলো তুমি আলেয়া’ ছবিটি দেখে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছিলাম। দেখি দুই বাসার গলিমুখে আলেয়া দাঁড়িয়ে। এর আগেই ওর সাথে পরিচয় ও কথা হয়েছে। ও আমাকে দেখে একটু হাসি মুখ করে । বাসায় ঢোকার সময় আমি ওকে বলি– ‘আলো তুমি আলেয়া’।
এর পরেও ওর সাথে আমার দেখা হয়, কথা হয়।মেয়েটি দেখতে ভালোই। মফস্বলের সরলতা ছিল ওর চোখে মুখে। কিন্তু ওর সাথে প্রেম করব, এই ভাবনা কখনো ভাবিনি। আমি তখন কেবল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। বিয়ে সাদির কথা মুখে আনলে সোজা বাড়ি থেকে আমাকে পিটাত।
আলেয়ার সাথে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, সে আমাকে ভালোবাসতে চায়। ওকেও যে ভালোবাসা যায়, সেই রকমই একটি মেয়ে আলেয়াও । সুচন্দার মতো টানাটানা চোখ, স্লিম বডি, লম্বা কালো চুল, শ্যামবর্ণ গায়ের রং। আমারও মনে হতো, ওর সাথে একটু প্রেম করি। দূরে কোথাও পালিয়ে নিয়ে যেয়ে ওকে বিয়ে করি। কিন্তু তা আমি নিজেকে করতে দিলাম না।
ইতোমধ্যে আলেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে হবে তার তিনদিন আগের ঘটনা। সেদিন ছিল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সময়টা ছিলো দুপুর। রুমের মধ্যে একাকী ছোট জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিলাম। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ির সামনে গলিটি জলে ভেসে গেছে। বৃষ্টির সাথে শীলাও পড়ছিল। এবং সাথে মেঘ গুরুগম্ভীর বজ্রপাত। আমার রুমটা ছিল পুরনো জীর্ণ। দেয়ালে পলেস্তারা খসে গেছে। মেঘ বৃষ্টির কারণে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। রুমটা অন্ধকারোচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বাইরে তখনো মুষুলধারে বৃষ্টি। হঠাৎ রুমের মধ্যে কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আলো আঁধারিতে দেখতে পাই, আলেয়া।
আলেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা লুকিয়ে কাঁদতে থাকে, এবং বলতে থাকে — তুমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও। আমাকে তুমি এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।’ আমি কোনো কথা বলিনি। এটা আমার কাপুরুষতাও নয়। আমি তো আলেয়াকে কখনোই ভালোবাসিনি। ওকে আমি কখনোই বলিনি
ভালোবাসি।
তখনো আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে। আলেয়া আমার বুকে জড়িয়ে। মানুষ মাঝে মাঝে প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়। মানুষ একাকার হয়ে যায় বৃষ্টি, নদী, সাগর, জ্যোৎস্নার রাত কিংবা পাহাড়ি নির্জন অরণ্যের মতো প্রকৃতিগুলোর মাঝে। প্রকৃতি তার অসীম শক্তি দিয়ে মানুযকে কাছে টেনে নেয়, আর মানুষও তখন প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে যায়। ধারণ করে স্বর্গীয় রূপের যা মর্তলোকের জীবন আচরণের সাথে কোনো মিল নেই। আলেয়ার চোখের জল ততোক্ষণে শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।
আলেয়ার ঐ ছেলের সাথেই বিয়ে হয়ে যায় এবং স্বামীর ঘরে চলে যায়। দু’তিন মাস পরে দীননাথ সেন লেনের বাসা ছেড়ে আমরা আজিমপুর কোয়ার্টারে চলে আসি। এরপর আলেয়ার সাথে কিংবা ওদের পরিবারের কারো সাথে আমাদের দেখা নেই।
ঠিক নয় বছর পর, একদিন নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানের সামনে আলেয়ার দেখা পাই। একটি আট বছরের ছেলের হাত ধরে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই একে অপরকে চিনে ফেলি। দু’জনের চোখে মুখে বিস্ময় এবং বিষণ্ণতা মুহূর্তেই ফুটে উঠে। সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হই ওর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার চাহনি থেমে যায় ছেলেটার মুখের উপর। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। শরীরের সমস্ত রক্ত হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে হিম শীতল হয়ে গেল। ঐ রকম বয়সে আমাকে দেখতে ওর মতোই লাগত। আলেয়া বেশিক্ষণ দেরি করেনি। ছেলের হাত ধরে চলে যেতে উদ্যত হয়।
ছেলেটিকে খুব আদর করতে ইচ্ছা হলো। ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করি- বাবু তোমার নাম কি ? ছেলেটি ওর যে নামটি বলেছিল – সেটি যে আমারই ডাক নাম।
~ কোয়েল তালুকদার