গুনে গুনে দেখলাম আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। সেদিনও ছিল এমনই বসন্ত চৈত্রের দিন। তপ্ত রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল আকাশ থেকে। আমরা বসেছিলাম মেঘনা ঘাটে। নাসরিন সকালবেলা সায়েদাবাদ বাস স্টান্ডে একটি চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বলেছিল — ‘ আজ তোমার সাথে হয় শেষ দেখা, না হয়, অনন্ত জীবনের শুরু। ‘
সায়েদাবাদ থেকে একটি লোকাল বাসে করে চলে আসি মেঘনা ঘাট। ব্রীজের কাছ থেকে নদীর কূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু পূর্ব দিকে চলে যাই। যতই দূরে যাচ্ছিলাম, ততই যেন জনশূন্য মনে হচ্ছিল নদীর কূল। এক জায়গায় কেমন যেন পোড়া গন্ধ পাচ্চিলাম। পোড়া কাঠ আর কয়লাও দেখতে পেলাম নদীর পাড়ে। এগারো বারো বছরের একটি বালক লুঙ্গী পড়ে খালি গায়ে আসছিল আমাদের দিকে। ওকে বলি — এখানে কিসের পোড়া গন্ধ?
বালক : স্যার, এখানে কাল বিকেলে লাশ পোড়াইছে। এটি একটি শ্মশান ঘাট।
নাসরিন : মেয়ে মানুষের লাশ ছিল, না, ছেলে মানুষের লাশ?
বালক : আফা, মাইয়া মানুষের লাশ।
শ্মশান ঘাটটি পার হয়ে আমরা আরো কিছু দূরে চলে যাই। নদীর কূলেই দেখতে পাই একটি বড় নিম গাছ। আমরা দুজন সেই নিম গাছের তলে ঘাসের উপরে গিয়ে বসে পড়ি। জায়গাটা বেশ রোমান্টিকই মনে হ্চ্ছিল। দূরে ব্রীজের উপর দিয়ে অসংখ্য গাড়ি এদিকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে। নদীতে শ্যালো নৌকা ভটভট করে চলছে। মাঝে মাঝে দুএকটি লঞ্চও চলছে। পাশেই শ্মশান ঘাট। নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উপর থেকে আমাদের উপর চৈত্রের রোদ্দুর ঝরে পড়ছিল।
নাসরিন অনেকটা সুরঞ্জনার মতো করে বলে : ‘ এই খাঁখাঁ চৈত্র দুপুরে, এই শ্মশান ঘাটে কী কথা আমার সাথে? তোমার সাথে কেন যে আমার প্রেম হলো? তার চেয়ে নুরা পাগলা কিংবা শহীদ ডাকাত অনেক ভাল ছিল। ওরা ভাল প্রেমিক হতে পারত। ‘
আমি বলছিলাম — ‘আজ কয়েকদিন ধরে কেবল শ্মশান ঘাটের স্বপ্ন দেখছি। চন্দন কাঠে জড়ানো লাশ। দাউদাউ করে কাঠ আর লাশ পুড়ছে। স্বপ্নে এমনই একটি নদী দেখেছি। এখানে আসার পর সবকিছুই কেমন যেন মিলে যাচ্ছে। ঠিক যেন স্বপ্নে দেখা সেই জায়গা! সেই নদী, সেই নিম বৃক্ষ।’
কাছেই তাকিয়ে দেখি, মেঘনার উপর দিয়ে যাত্রা পার্টির একটি নৌকা যাচ্ছে। হারমোনিয়ামের কড়া সুরের তালে একটি মেয়ে ঘাঘরা পরে নাচ্ছে আর গান গাচ্ছে :
‘ “হাওয়া মে উড়তা যায়ে,
মেরা লাল দোপাট্টা…মল মল কা হো জি…হো জি।”
আমি নাসরিনকে বলি : ‘দেখ মেয়েটি কী সুন্দর করে গান গাচ্ছে। তুমি যদি ঐরকম একটি নটী হতে, কী যে সুন্দর লাগত তোমাকে! ‘
— ‘ আমাকে এই শ্মশান ঘাটে এনে শেষ পর্যন্ত যাত্রার নর্তকী বানালে। ‘
—- এই চৈত্র দুপুরে যদি কোকিল ডাকত এই নিম গাছের ডালে বসে, কী যে ভাল লাগত! কিন্তু কোনো কোকিল এখানে নেই।
—- ঐ দেখ, দাড় কাক বসে আছে নিমের ডালে। ‘
সত্যি তাই। দেখলাম, দুটো কাক কা – কা করে উড়ে চলে গেল। মনটা একটু খারাপই হলো। ওরা কাক না হয়ে যদি শালিক হতো। মনটা সত্যিই প্রফুল্ল লাগত। যেন ‘টু ফর জয়’।
এবার নাসরিন একটু গম্ভীর হলো। আমি বললাম — ‘তোমার কী খিদে পেয়েছে? ‘
—- হ্যাঁ।
—- কাছে কোনো হোটেল নেই। যেতে হবে মেঘনা ঘাট বাজারে। যাবে?
—- না।
—- খাবে না।
—- না।
নাসরিন আমার একটি হাত টেনে নিয়ে ধরে থাকে ওর হাতের ভিতর। খুব মায়াবী করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কিছু সময় পর বলছিল — ‘তুমি এত উদাসীন কেন, বলো তো? তুমি কী সারাজীবন এমনই থাকবে? একটা ভাল চাকুরির খোঁজ নেবে না? টিউশনি করে বিয়ে করতে পারবে? সারাজীবন মেচেই থাকবে?’
—- কেন, তুমি আমাকে বিয়ে করে এমন শ্মশান ঘাটে নিম গাছ তলায় থাকতে পারবে না? ‘
—- তুমি পাগল। তুমি ইডিয়ট। ‘
—- আমি তো তোমাকে নিয়ে এমন খোলা আকাশের নীচে বসবাস করতে পারব হাজার বছর। প্রতি বসন্ত রাতে নক্ষত্র ঝরে পড়বে আমাদের উপর। শীতে পড়বে শিশির। আর বর্ষায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কী যে ভালো লাগবে ! কী পারবে না আমার সাথে থাকতে এমন হাজার বছর? ‘
— তুমি সত্যিই একটা পাগল, সত্যিই তুমি ইডিয়ট।
হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে একটি ঘূর্ণিবায়ুর ধূলো বাতাস এসে লাগল আমাদের গায়ে। বাতাসে উড়ে আসছিল জীর্ণ মরা পাতা। শ্মশানের লাশ পোড়ার গন্ধও পেলাম।
নাসরিন ওড়না দিয়ে ওর চোখ ঢাকে। একসময় ঘূর্ণিবায়ুটি উড়তে উড়তে মেঘনার জলের স্রোতের ঘুর্ণিতে মিশে যায়।
আমরা তখনও বসে আছি ঘাসের উপরে। নাসরিন ওড়না থেকে মুখ বের করে আমার কাঁধের উপরে মাথা ঠেকিয়ে বলছিল — কাল একজায়গা থেকে পাত্র আসবে আমাকে দেখতে। বড় দুলাভাই হচ্ছে ঘটক। যদি পাত্র পক্ষ আমাকে পছন্দ করে ফেলে। যদি বিয়ে পাকাপাকি হয়ে যায়। আমার খুব ভয় লাগছে। চলো কালই আমরা কোর্টে যেয়ে বিয়ে করে ফেলি। ‘
—- আরে না, তোমাকে কেউ পছন্দ করবে না। তুমি দেখতে অনেক কালো। কালো মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি কেউ পছন্দ করবে না। আর, করলেও কালই তো তোমার বিয়ে হবে না। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। দেখি, এর মাঝে একটি চাকুরী হয়ে যায় কিনা? ‘
আর কপালে যা হবার তাই হবে। ভানু চক্রবর্তীর সেই কবিতার মতো —-
‘ …পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত।
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।…’
কোথা থেকে সেই কাক দুটো আবার ফিরে এসে বসে নিম গাছের ডালে । কিছু ধূসর মেঘ হঠাৎ আকাশের তপ্ত সূর্যটাকে ঢেকে ফেলে। একধরনের প্রশান্তির ছায়া নেমে আসে মেঘনার তীরে। চেয়ে দেখি, এমন ছায়া রোদ্দুরে নাসরিনের মুখখানি আরও বেশি উজ্জল দেখাচ্ছে। নদী থেকে তখন শীতল হাওয়া বয়ে আসছিল। বাতাসে উড়ছিল ওর চুল। আমি নাসরিনের চোখের দিকে একবার তাকাই। দেখি সেই চোখে কোনো বিষন্নতা নেই। ওর বিনম্র মুখের দিকে তাকাই। চেয়ে দেখি — সেই মুখে কোনো অভিমান নেই। আমরা দুজন মেঘনার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাস স্টান্ডের দিকে চলে আসতে থাকি।
কথা ছিল আমাদের দেখা হবে আবার। কিন্তু তারপরে নাসরিনের সাথে অামার আর দেখা হয় নাই। যে সমস্ত জায়গাগুলোতে আমরা সাধারণত দেখা করতাম, সে সমস্ত জায়গায় আমি ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিন্তু নাসরিন আর আসে নাই। ওর ঠিকানায় কটি চিঠিও লিখেছিলাম। কিন্তু সেগুলোরও নো রিপ্লাই ছিল।
ওতো কালো মেয়ে ছিল। তারপরও সেদিনই হয়ত ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর তিরিশ বছর চলে গেছে। ওকে ভুলিনি, ও যতই কালো হোক।
***