দরজায় দাঁড়িয়ে সরু চোখে চেয়ে চেয়ে লতার কান্ডকারখানা দেখতে থাকে সুজন। লতা হয়ত ভাবতেও পারেনি সুজন এতো তাড়াতাড়ি কলঘর থেকে ফিরে আসবে। আট মাসের বিবাহিত জীবনের রঙ এখনো ফিঁকে করতে পারেনি দারিদ্র্য। তবুও টুকটাক ঝামেলা কোথায় না হয়।
সাতটা ভাড়াটিয়া পরিবারের জন্য দুইটা টয়লেট, একটা গোসলখানা। সেটাকে কলঘরও বলে। কত সময় কলঘরে এক ভাড়াটিয়া বউ বাসন মাজতে বসলে অন্য ঘরের পুরুষ গোসল করতে গিয়ে উপস্থিত হয়। সুজনই বুদ্ধি করে কল ঘরে একটা পর্দার ব্যবস্থা করছে। দুইটা প্লাস্টিকের বস্তা কেটে গার্মেন্টস থেকেই সেলাই করে নিয়ে এসে দড়িতে টাঙিয়ে দিয়েছে। কারণ তার বউকে অন্য পুরুষ তার অঙ্গ দেখাক যেমন চায় না, নিজেকেও অন্য ঘরের বউরা দেখুক চায় না। পুরুষদের লজ্জা কম কথাটা চালু থাকলেও সুজন দেখছে একটা বয়সের পর মেয়েদের বরং লজ্জা অনেক কম ছেলেদের থেকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুজন গোসলের সময় লতাকে বাসন মাজার জন্য নিয়ে যায়। এই ব্যবস্থাটা অলিখিত হলেও বাস্তবায়িত হচ্ছে কয়েক মাস ধরে। ঘরটায় তারা ভাড়া এসেছে সাড়ে ছয় বা সাত মাস হবে। এক লাইনে ইটের গাঁথুনি। উপরে এক ছাইয়া চাল। সুজন পেয়েছে লাইনের শেষ মাথার ঘরটা। তারপর একটা পানায় ভরা ডোবা। দুজনেই খুব খুশি শেষ ঘরটা পেয়ে।
ঘড় না বলে একে ঘুপচিই বলা যেত যদি বাইরে ডোবার দিকে একটা বড় জানালা না থাকত। জানালা বরাবর চকি রাখতে চাইল লতা। সুজন দিল না। জানালার সামন টুকু খালিই রাখল। একটু দাঁড়ায়। রাত বিরাতে বিড়ি টানে। লতা আয়না নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল দেয় চোখে। এই জানালার জন্য অন্য ঘর গুলো থেকে দুইশ টাকা বেশি দিতে হয়।
সুজন দেখে লতা দ্রুত হাতে তার পরনের বদলে রাখা শার্ট প্যান্ট খুব করে শুঁকছে। আবার ঘরের গেঞ্জিটা শুঁকছে। লুঙ্গিটা যখন হাতে নিল তখন লতার চোখ পড়ল দরজায় দাঁড়ানো সুজনের দিকে। অপ্রস্তুত ভাব খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠে বলল, তাকাইয়া রইছ ক্যান?
সুজনের তখন প্রচণ্ড খুধা পেটে। কলঘরে যাবার আগে বলে গেছে, ভাত বাড়ো তাড়াতাড়ি।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সুজন চলে আসবে বোঝেনি লতা। টয়লেট, কলঘর দুইটাতেই সকালে আর সন্ধ্যায় লাইন থাকে। আধা ঘন্টা এক ঘন্টাও দাঁড়ানো লাগে। আর আজ মাত্র কয় মিনিটে কাজ সেরে ফেলল!
লতা সরে না থম ধরে দাঁড়িয়েই থাকে। সুজনের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। কিন্তু অত সহজে রাগ সে প্রকাশ করতে পারে না। তাই আবার বলে,
‘ খিদা লাগছে তাত্তারি দেওনা ভাত তারকারি যা আছে।’
তবুও নড়ে না লতা। ভাবে খিদা তো তারও লাগছে, গার্মেন্টস সে-ও কইরা আসছে, কই সে তো কাউরে হুকুম করতেছে না, ভাত দেও। আটমাস এর বিবাহিত জীবনে তাদের খুব বেশি ঝামেলা ঝগড়া হয়নাই। সুজন আর লতা কাছাকাছি বয়সের হলেও দুজনের মধ্যে সুজন ধীর স্থির। একই গার্মেন্টসে কাজ করে তারা অনেক বছর। লতা কখনও সুজনকে কারো সাথে ঢলাঢলি করতে দেখেনি। যেখানে অফিসের হেড থেকে শুরু করে চার দিনের চাকরি পাওয়া ছেলে গুলোকেও সে দেখছে কিভাবে মেয়েদের শরীরের উপর চীনাজোঁকের মতো দৃষ্টি লেপ্টায় রাখে। জীবনে কম পুরুষ দেখেনি লতা। এতো অসভ্য অসাধুর মধ্যে বাপ মা’হারা এতিম সুজনকে ঠিক পুরুষ মনে হত না লতার। একটা ঠান্ডা সালুনের মতো পুরুষ মনে হয়। বিয়ের প্রস্তাবটা লতা দিয়েছিল। মেয়েরা ঠাণ্ডা সালুন ঠিক পছন্দ করে না এটাই আশা ছিল লতার। সুজনকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না তার।
অথচ কয়দিন যাবত কী যেন হয়েছে সুজনের। লতা ঠিক ধরতে পারে না। কয়েকদিন আগে সুজনের গেঞ্জির মধ্যে একটা বিশাল লম্বা চুল পায়। কাপড় ভাঁজ করার সময় চুলটা হাত দিয়ে উঠাতে গিয়ে দেখে এতো লম্বা যেন আর শেষ হয় না! এতো লম্বা চুল ওয়ালা কেউ তাদের গার্মেন্টসে কাজ করে না। লতা চোখ দিয়ে সবার চুল মাপে রোজ।
আরেক দিন কাপড় ধুতে গিয়ে অদ্ভুত কয়েকটি দাগ দেখল লতা। কলারের কাছে কালো কালো দাগ! মানুষের জামাকাপড়ে লিপিস্টিকের দাগ থাকে। অথচ সুজনের গেঞ্জিতে কালো দাগ দেখে অবাক হয়। কাজল আর চোখের পাপড়িতে মাখানোর মাশকারা না হয়েই যায় না। আঙুল দিয়ে ঘষে, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। সুজনকে জিজ্ঞেস করে মনের মত উত্তর পায়নি। সুজন বলে মেশিনের কালি। মেশিনের কালির সাথে তেল মিশে থাকে। তেলের একটা মরিচা গন্ধ থাকে। এমন সুন্দর সুবাস থাকে না।
সুজনের হাবভাব খুব সুক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করে লতা। আজকাল সে শুয়ে পড়লেই ঘুমায় না। খুব এপাশ ওপাশ করে। বলে এই ঘুপচি ঘরটা ছেড়ে দেবে। ফ্ল্যাট বিল্ডিংয়ে উঠবে। টাকার প্রশ্ন তুললে বলে দুই মাস পর তার একটা বড় প্রমোশন হবে। বিশ হাজার টাকার বেতন হবে চল্লিশ হাজার টাকা। তখন আর লতাকে সে চাকরি করতে দেবে না তা-ও বলে। এসব শুনতে লতার খুব ভালো লাগে। সুজনের বুকের ভেতর আরেকটু ঢুকে যেতে ইচ্ছা হয় তার। কিন্তু সুজন তখন আলগোছে নিজের শরীরটাকে ওপাশ ফেরায়। তবু্ও লতার খারাপ লাগে না। সে নতুন বাড়ির কল্পনা করে। কল্পনায় ভাসে। পথে চলতে যত ফার্নিচারের দোকান দেখে, ফুটপাতে যা কিছু পসরা দেখে সব কিছু সে মন দিয়ে দেখে। নতুন বাড়িতে উঠলে টাকা পয়সা জমিয়ে এগুলো কিছু কিছু তো কিনবেই। সে ভুলে যেতে চেষ্টা করে সুজনের জামায় লেগে থাকা সুবাস।
হঠাৎ একদিন দুপুরে বড় সাহেবের রুমে ডাক পড়ে লতার। বিশাল এসি ঘরে ঢুকেই লতার নাকে কেমন যেন একটা চেনা চেনা গন্ধ ধাক্কা দিল! সে এই গন্ধটা চেনে! কিন্তু মনে করতে পারে না কিভাবে চেনে?
লতার কাজে আজকাল অনেক ভুল হচ্ছে। এমন করলে চলবে না, সাবধান না হলে অনেকের মতো তাকেও ছাটাই লিস্টে পড়তে হবে, এমনিই প্রতিষ্ঠান লসের উপর চলছে বহুদিন। এমন বহু কিছু শুনতে হল লতাকে। কথা গুলো বড় সাহেব বললেন না অবশ্য। উনি চুপচাপ ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। যা বলার বলছিল বড় সাহেবের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। পাঁচ বছর ধরে এই গার্মেন্টসে চাকরি করে লতা। মনোযোগ দিয়ে কাজ করে, কামাই করে না বলে তার সুনাম আছে সুপারভাইজারদের কাছে। দুই জন মালিক এই গার্মেন্টসের। তারাও কখনও খারাপ ব্যবহার করেছে লতার সাথে একথা লতা বলতে পারবে না। কিন্তু বসের বউয়ের মুখে এমন রাম ধমকের জন্য একেবারেই প্রস্তুতি ছিলো না লতার।
অপমানিত লতার চোখ কড়কড় করে উঠল যখন তার চোখ পড়ল বসের তৃতীয় পক্ষের বউয়ের চুলের দিকে। এতো লম্বা চুল! বিস্ফারিত চোখে লতা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মেকাপ করা মুখে মাশকারা ভরা চোখের দিকে। ম্যাডাম উঠে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড ধমক দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলে লতাকে।
বাড়ি ফিরে লতা তখনই সুজনের জামা কাপড়ের গন্ধ শুকতে থাকে, অফিস ঘরে যে গন্ধ সে পেয়ে এসেছিল।
দরজায় দাঁড়ানো সুজনকে অগ্রাহ্য করে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে সে নাকের কাছে কাপড় গুলো নিয়ে গন্ধ শুঁকতে থাকে।
সুজন দেখে লতার চোখ থেকে টপটপ করে বড় বড় জলের ফোঁটা ঝরছে।
গল্পঃ জলের গন্ধ।
তাইমুন পিয়া।