একটা বিড়ালের পাখা আছে। বিড়ালটা মাটির উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখতে অসম্ভব লাগলেও নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। বিড়ালটার দিকে আমি অবাক তাকিয়ে আছি! ঝকঝকে দুপুরের রোদ। কোথাকার যেন এক অচেনা সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র আমি বাপের জন্মেও দেখি নাই। আবার এই সৈকতের একটু দূরে বিড়াল উড়ছে।
উড়ার আমারো বহুদিনের ইচ্ছা। সেই ইচ্ছা এতো বছরেও পূরণ হয় নাই! আজ যদি পূরণ হয়! আমি ছুটছি বিড়ালের দিকে, বিড়াল উড়ছে। আরও কাছে এসে বুঝা গেল বিড়ালটা আসলে জাদু। ও এখানে!
জাদু আমাদের পরিবারের পালা বিড়াল। বিড়াল আমার খুবই অপছন্দ। জাদুকেও। কিন্তু ঘরের সবার বকাবকির জন্য তাকে ভালোবাসার অভিনয় করে যেতে হচ্ছে তিন-চার বছর ধরে। সারাদিন তার সাথে আমার ঠেলাঠেলি। কিন্তু বাড়ির বাঁকি সবাই জাদুকে পছন্দ করে। আমার কিছুই করার নাই। কিন্তু এর মানে এই না যে এই অচেনা প্রান্তরে এসেও আমার পিছু নিবে জাদু! সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক-অকল্পনীয় হলেও আমি সাহস হারাই নাই। লড়ে যাচ্ছি।
বিড়ালের পাখা দেখে আসলে আমার মনে হয়- পাখা থাকলে যদি জাদু উড়তে পারে আমি পারবো না কেন? আমিও পারবো। সেই ইচ্ছার হেঁয়ালি যুক্তি নিয়ে আমি ছুটছি জাদুর পেছনে পেছনে। একটু দূরে বনজঙ্গল দেখা যায়। জঙ্গলের ভেতরে চলে গেলে কিন্তু ওকে আর ধরা যাবে না। কিন্তু বিড়ালেরও তো উড়ার অভিজ্ঞতা কম। উড়তে উড়তে অনেক দূর গিয়ে বিড়ালটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে যায় সমুদ্র ও জংলা নদীর মাঝামাঝি জায়গায়। আমি দৌড়ে গিয়ে ঝপ করে ধরে ফেলি।
হঠাৎ দেখলাম চারিদিকে কোথাও কোন পাখা নাই, জাদু দৌড়ে পালাচ্ছে আমার বিছানার পাশ থেকে। আমি চমকে উঠে বসে যাই। ঘড়িতে সকাল সাতটা! আজকে কপালে খারাপি আছে, হাফেজসাব হুজুর জবাই দিবে, মক্তবের সময় যায় যায়।
ব্রাশ নিয়ে ঘাটের দিকে যেতে যেতে আবার মনে পড়ে স্বপ্নের কথা। দিনের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! আশায় বুক বাঁধতে থাকি। স্বপ্নটা মাথায় ঘুরতে থাকে সারা দিনরাত। ধীরে ধীরে আমার মনে হতে থাকে এমন স্বপ্ন আমি আগেও কবে যেন দেখেছি। বছর দুয়েক আগে হবে মনে হয়। তার বেশিও হইতে পারে। শিউর না। ঝাপ্সা মনে আছে। তবে এই স্বপ্নের কথা কাউরে কখনো বলি নাই! বললে পাগল ভাইব্বা পাবনা পাঠায়া দিতে পারে। স্বপ্নটা মাথায় সারাদিন ঘুরতে থাকে।
স্কুল থেকে ফিরে এসে গ্যাং নিয়ে রওয়ানা দেই বটতলার দিকে। আমি ক্লাস নাইনে, আমার ভাই মাজু টেনে। আমরা পিঠাপিঠি। কিন্তু ও একা থাকলে আমার উপর খুব বড়ত্ব ফলায়। মারামারিতে আমি পারি না। তাই সয়ে যাই। তবে আমরা অনেকটা বন্ধুর মতও।
বিকালে বটতলায় পৌঁছে দেখলাম সবাই উপস্থিত। আমিই লেট কামার। বটতলা আমাদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা। জায়গাটা অসাধারণ! মানুষজন সাধারণত এদিকে আসে না। কাছে ধারে চারদিকে বহুদূর পর্যন্ত মানুষের বসতিও নাই। মানুষ এখানে সাধারণত ঈদের জামাতে আসে। মাঠের দুই আড়াইশ গজ পশ্চিম দিয়ে গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেছে সদর রোড। আমি রাস্তা ধরে আসতে পায়ে কাদায় ভরে গেছে। বটতলার কোল ঘেঁষেই খাল। খাল পানিতে টইটম্বুর। বর্ষায় অনেকেই একে নদী বলে ভুল করে। চৈত্র মাসে খালের তলা পর্যন্ত শুকায়। বটতলার ঈদগাহ ময়দানে পাঁচ বন্ধু গল্প করছি। গল্পের বিষয়বস্তু আমার প্রেম।
মাঠের পুর্বপাশ দিয়ে খালটা এঁকেবেকে চলে গেছে কোথায় যেন। শেষ বিকাল। আমরা বিচ্ছিন্ন গল্পে ব্যাস্ত। এমন সময় হঠাৎ পশ্চিম পাশের বড় রাস্তায় দেখা গেল রুপা যায়। কি কাকতাল! সব সময় আমার সাথেই হয়! যার ব্যাপারে এতক্ষণ সবাই আমারে ক্ষেপাইল সে আবার সামনে। রুপা আমাদের বন্ধু মহলে আলোচিত আমার গার্লফ্রেন্ড হিসাবে। গার্লফ্রেন্ড না ঠিক। আমি তাকে পছন্দ করি। এটা কিন্তু ঐ মাইয়ার চৌদ্দ গুষ্টিও জানে না।
এমন সময় আমার ভাই মাজু বলে উঠে- তুই যদি রুপারে দাড় করায়া পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারছ তাইলে তুই যা বলবি আমি তাই শুনবো, আর না পারলে আমাদের কথা শুনতে হবে। আমি জানি তোর মোটেই সাহস নাই। তুই জীবনেও পারবিনা রুপারে কিছু কইতে। রুপা আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত। গণি মাতাব্বরের ছোট মেয়ে।
যাই হোক, এমন কথায় আমার পুরুষত্বে লাগল! কি বলে! আমি নাকি পারবো না! পারতে আমাকে হবেই। যাহ আজকে যাহয় হোক কইয়া দিমু…। চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করলাম। এগিয়ে যাই কাদামাখা মেটো পথটা ধরে। তাদের ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করার কথা।
রুপা প্রতিদিন বিকালে মতিন বিএসসির কাছে প্রাইভেট পড়ে বাড়িতে ফিরে। তাই স্কুল থেকে ফেরার পর প্রতিদিন এই বটতলায় আড্ডা দেয়ার অভ্যাস করে নিতে হয়েছে। কিন্তু আমার গোঁড়ায় দুর্বল। রুপার কাছে ধারে গেলে আর কিছু বলতে পারি না। সবকিছু উল্টাপাল্টা হইয়া যায়। গুবলেট পাকায়া যায়।
আমি যত কাছে ঘনাচ্ছি তত এক অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করছে। সংকোচ-উত্তেজনা বাড়তে থাকে প্রতিটা পদে পদে। এক সময় রুপার মুখামুখি হই।
আমি শক্ত হয়ে রুপার পথে দাড়িয়ে থাকি। রুপা আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। তারপর লজ্জায় চোখ নিচে নামিয়ে নেয়। রুপা জানে আমি তাকে পছন্দ করি। শুধু রুপা না। স্কুলের স্কাউট করা সবাই মোটামুটি জানে। কিন্তু এত দিনেও আমি রুপার দিকে আগাইতে পারি নাই।
আজ কি খোকার সাহস হবে? রুপা সামনে এসে বলে- সরেন। সে মজা পায় মনে হয়।
“আমি তোমারে কিছু কথা কইতে চাই”
এই কথা তিনবার। ভয়ে চোখ ছোট হয়ে আসে। পরের কথাগুলো আর বলতে পারি না। তোতলামি থামে না।
রুপা লক্ষ করল আমার হাঁটু প্রচণ্ড বেগে কাঁপছে। তার পেট ফুড়ে হাসি আসতে চায়। কিন্তু বের করতে পারে না। তারপর আমাকে কাটিয়ে চলে যায়। যত দূরে যায় তত উত্তেজনা কমতে থাকে।
শেষ বিকালে বাঁশ ঝাড়ের পেছনে চুপে চুপে এই সিন যারা দেখতেছিল তারা ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসে। এবার আমাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়। আজকের মুরগি পাওয়া গেছে।
অতঃপর আমার মায়ের পেটের ভাই মাজু আমারে স্বর্ত দিল রুপাদের গাছ থেকে ডাব ছুরি করে খাওয়াইতে হবে। সবাই দলে থাকবে। কিন্তু গাছে উঠতে হবে আমাকে। আমি এমনিতে গেছো বান্দর। চুরি করে রাতে গাছে উঠা নিজের বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
রুপাদের নতুন বাড়ি। গ্রামের নিয়মিত বসতি থেকে কিছুটা দূরে। আমাদের বাড়ি থেকে মাটির পথ কোথাও কাদায় পা চুবিয়ে যেতে হয়। এটা বড় কথা নয়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে- রুপাদের পরিবার আর আমাদের পরিবার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান বা ইজরাইল-ফিলিস্তিনের মত রাইবাল। দুই পরিবার বড় দুইটা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে। এই দুই পরিবারের ঝগড়া নিয়া বেশ কয়েকবার গ্রামবাসী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি করেছে। শেষে পুলিশ এসে শান্ত করে। সেই বাড়ি থেকে ডাব পেড়ে খাওয়াইতে হবে। নিয়তির কি বিচার!
সন্ধ্যায় এমন ঝিকিমিকি চাঁদের আলো কখনো কখনো হয়। চাঁদের আলোয় কয়েকদিন আগে ধান কাঁটা শেষ হওয়ার পর শুকনো মাঠ। তবে কোথাও দুইদিন আগের বৃষ্টির পানিতে চিকচিক করছে। তারপর বহুদূর ফাঁকা। পরিষ্কার দেখা যায়। মাঠ পার হয়ে যখন পৌঁছাইলাম তখন আটটার বেশি বাজে। আমি গাছে উঠলাম অনেক কষ্টে। ডাবের একটা ভিড় কাঁটার পর নিচে ঝপ করে একটা শব্দ হয়। সাথে সাথে আরেকটা শব্দ হয়, এই কে?
আমি গাছ থেকে শুনতে পাই এবং বুঝতে পারি – এটা গনি মিয়ার গলা! সব্বনাশ! শব্দটা খুব কাছাকাছি। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ নাই। নারকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নামবো না অপেক্ষা করবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই আরেকবার মানুষের গলা শুনতে পাই। সাথে সাথে একটা বিদেশি টর্চের আলো পরিষ্কার চাঁদের আলোর ভিড়েও দেখা গেল। গনি মিয়া বলছে – এই নাম! নামতে নামতে আমি ভাবি – গনি মিয়ার দল এখন ক্ষমতায়। রাম ধোলাই দিবে নিশ্চিত!
আমার বাবার দল এখন বিরোধী দলে। বাঁচাইতে পারবে না। এবার গনি মিয়া নিশ্চিত ঝামেলা করবে! আমার খবর আছে। সব রুপার জন্য। এমন বিচ্ছিন্ন ভাবতে ভাবতে গাছের গোঁড়ায় নামলাম। গনি মিয়া একটু এগিয়ে এসে আমাকে দেখে থেমে যায়। সে বলে, খায়েগো বাড়ির পোলা ডাব চুরি করে!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আমি ধীরে ধীরে বাম দিকে কয়েক পা পিছিয়ে স্যান্ডেলের পাশে গিয়ে স্যান্ডেলটা নিয়ে ভো দৌড়! গনি মিয়াকে দেখে মনে হল গনি আমাকে পালানোর সুযোগ দিছে। ছুটে যেতে যেতে ভাবার চেষ্টা করি – গনি যদি বিচার দেয় বাবার কাছে! তাইলে কি হবে? পিঠের ছাল তুলে ফেলবে! আরও ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করতেছে আমার জন্য।
এবার গনির একটু বর্ননা দেয়া যাক। গনি মিয়ার দুই ছেলে আমেরিকায়। মেলা টাকা-পয়সার মালিক। গ্রামের সালিশ করে। আবার এই বয়সেও তাবিজ কবজের কাজ করে, ঝাড়পোক করে টাকা কামায়, শালা খাডাশ! কিপ্টাও।
রাতে ঘরে ঢুকে দেখি মাজুকে। মাজু আমাকে সবকিছু বিস্তারিত জিজ্ঞেস করে। আমি রাগে ওকে কিছু বলি না। মাজু ধমক দেয়, যদি আমার কথা বলিশ বাবা কি মারবে আমরা সবাই মিলে তোকে আরও বেশি মারব।
তারপর না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। এভাবে কতক্ষণ কাটল মনে নাই। হঠাৎ চমকে উঠি! বাইরে কেউ হাঁকাহাঁকি করতেছে। কান খাড়া করে শুনার চেষ্টা করলাম। গনি মিয়া, নিশ্চিত! ভাবলাম রাতে সে আর আসবে না। কিন্তু শালা জম খাটাশ! আজকে আমার রক্ষা নাই।
মাইর খাইতে আমার অত ভয় নাই। অভ্যস্ত। কিন্তু পুরা পরিস্থিতিটাতে কী কী ঘটবে, কতটা মাইর খাইতে হবে, কতক্ষণ চলবে, কারা কারা বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে আসবে, ভাবার চেষ্টা করছি, দাদু বাড়িতে আছে কিনা বুঝার চেষ্টা করছি। গনি মিয়ার চিল্লাচিল্লি আর শুনতে মন চায় না। শেষে বাবা কি যেন বুঝায়া দিলে সে চলে যায়। গনি চলে গেলেই তো আমার পালা আসবে। কখন বাবা আমার রুমের দিকে আসবে এই ভাবতে ভাবতে ঘোর লাগে।
হঠাৎ চমকে উঠি। বাবা ঢুকে রুমে লাইট জ্বালায়। আমার ভয় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আজু বলে হাঁক মারে। আমি জাগি না। কয়েকবার ডাকে। আচ্ছা ঘুমের মানুষরে জাগানো যায় কিন্তু স্বজাগ মানুষরে কি জাগানো যায়? আমার বাবা ছিদ্দিক খা বিরক্ত হয়ে এবার তাজা বাঁশের ঝিংলা দিয়া ঠাশ ঠাশ বাড়ি মারে। আমি লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে থাকি। এভাবে চলে মিনিট দশেক। তারপর কান ধরে নিয়ে খাইতে বসিয়ে দেয়া হয়। রাতটা এভাবে কাটে।
সকালে মক্তব থেকেই প্রতিজ্ঞা রুপারে ভুইলা যাবো। আর গনির কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে হবে। গনিকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। গনির কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে সব বন্ধুরা একমত। তারা আমাকে সহানুভুতি জানিয়ে একটা বিকাল কাটায়। আর আমরা সাথে সাথে ফন্দি ফাঁদতে থাকি কি করে গনিরে উচিৎ শিক্ষা দেয়া যায়। একজন বলে, রাইতের অন্ধকারে ঢেল মারতে, একজন বলে তার ঘরের দরজায় সবাই মিলে হাইগা আসবে, একজন বলে ওকে অন্ধকারে ভয় দেখাবে, আরেকজনের প্ল্যান রাইতের অন্ধকারে একা যাওয়ার সময় ধইরা বুড়ির পুকুরে চুবাইতে – এসবের আমার মন ভরে না! ব্যাথা এখনো আছে। কাঁচা বাঁশের কাঞ্চির বাড়ি লাল লম্বা লম্বা দাগের দিকে তাকিয়ে আমার দুঃখ বাড়ে। আমি বলি, জম অপমান করতে হবে শালারে। বাজারে সব মানুষের সামনে।
মাজু বলে, শালিশের মধ্য থেকে তার জুতা দিয়া তারে পিডাইতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তার জুতা চুরি করে নতুন আসা ইলেক্ট্রিক থামে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সাথে একটা ঘোষণা পত্র থাকবে। যাতে লেখা থাকবে – গণিমত উল্লা রাত দুপুরে একলা বাড়ির জয়নালের বিধবা বউয়ের কাছে যাইয়া কি করে? আর বাঁকি সব জানা অজানা বিত্তান্ত।
যেই কথা সেই কাজ। হাজি বাড়িতে রাতের শালিশের সময় সবাই গোল হয়ে বসে শালিস শুনছে। এমন সময় সবার পায়ের তলা দিয়ে কারো চেয়ারের নিচ দিয়ে লম্বা বাঁশের কাঞ্চি ঢুকিয়ে বের করে আনা হয় গণি মিয়ার একটা জুতা। এনে টানিয়ে দেয়া হয় বাজারের মুখের থামের মাঝামাঝি উঁচুতে। সাথে একটা চিঠি থামের সাথে আঠা নিয়ে আটকে দেয়া হয়। এ নিয়ে পরের দিন গ্রামে মেলা হউকাউ হয়। কিন্তু কেউই জানতে পারে না কে করেছে। এক দুই দিন পরেই ব্যাপারটা সবাই ভুলে যায়।
একদিন বটতলার আড্ডায় আমি সবার পরে যাই। কিছুক্ষণ চুপ করে গল্প শুনার পর আমার আর ভাল্লাগছিল না। শান্তি পাইতাছিলাম না। এখনো প্রতিশোধ নেয়া হয় নাই! এই প্রতিশোধের ধান্ধায় সবাই রুপাকে তো ভুলে গেছেই, এমনকি আমিও। এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে ভুলতে পারিনি মোটেই। সবার সামনে স্বাভাবিক কথা বললেও ভেতরে ভেতরে আমার সেই ক্ষোভ দিন দিন ফুঁসতে থাকি। গনিরে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতেই হবে।
গণি মিয়া চিকন লম্বা করে, কাবু-কাহিল মানুষ, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, বয়স তিনকালে গিয়া ঠেকছে – এখনো তার এত পাওয়ার! আমি এই পাওয়ারের উৎস খোঁজার চেষ্টা করি, ভাবি, গণির টাকা-পয়সার অভাব নাই তারপরও সে তাবিজ-কবজ, কুফুরিকালাম, হাবিজাবি এত কিছু করে ক্যান? এভাবেই দিন যায়। গণির কাছ থেকে আমার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আর আসে না।
হঠাৎ একদিন। আবার সেই বিড়াল। এবার অন্য কোথাও! আমাদের গ্রামের কাছে ধারের কোন একটা জায়গা হবে। খুব পচিরিত মনে হচ্ছিলো জায়গাটা। পাথারের মাঝ বরাবর দিয়ে জাদু উড়ছে। আমি তার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছি। বহুদূর যাওয়ার পর জাদু পড়ে যায়। দৌড় মারে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে পাখাটা লাগিয়ে নেই নিজের পিঠে। আমার উড়ার স্বপ্ন স্বফল! আমি উড়ছি। আমাদের সারা গ্রাম। আমাদের বাড়ি পার হয়ে তারপর ঘোষের বাড়ি, কাজী বাড়ি, হাজি বাড়ি পার হয়ে সব জায়গায় খুঁজতেছি গণি মিয়ারে। কোথাও তার টিকিটাও দেখা যায় না। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাজারে। বাজারের পাশে মসজিদ বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা গেল গোলাকার হয়ে একদল মানুষ কি যেন একটাকে ঘিরে আছে। উঠানের ঠিক উপরে আসলে দেখা যায় সালিশ হচ্ছে। মন্দার বাড়ির বারিক মিয়া উত্তর পাড়ার অজিউল্লার গাই গরুরে শাবলের এক বাড়িতে মুহুর্তেই শেষ করে দেয়। বারিক মিয়া কতটা নিষ্ঠুর তা ব্যখ্যা করতেছেন গণি মিয়া সহ সব শালিশেরা।
ঠিক এই মুহুর্তে আমি হুট করে নেমেই খপ করে তুলে নেই গণি মিয়ারে। সবাই হাঁ করে থাকে, চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে, শেষে ভয়ে চুপ হয়ে যায়। আমি গনিরে একবার অনেক উপরে তুলি আবার নিচের দিকে ছাড়ি, আবার তুলি আবার ছাড়ি। এভাবে কিছুক্ষণ উঠ-ছাড় পর্ব চলার পর অনেক উপর থেকে তাকে ছেড়ে দেই। গণি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
থপ করে একটা শব্দ কানে আসে। আমি খাট থেকে পড়ে যাই। রাত কয়টা হবে আন্দাজ করতে পারি না। এমন সময় আমার মাথায় খেলে যায় অন্য চিন্তা! আমি চিৎকার দেই। মুহুর্তের মধ্যে মাবাবা, ভাই, আপু সবাই উঠে আসে। সবাই আমাকে ঘিরে ফেলে কি হয়েছে বলে। মাবোন কান্নাকাটি শুরু করে। পাশের বাড়ির মানুষও এসে জমে যায়। আমি চোখ বড় করে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকি। বকতে থাকি অনবরত। কাউকাপ শহর নিয়ে গল্প করতে থাকি।
তাড়াতাড়ি ভাইয়ের সাথে আরেকজনকে পাঠানো হয় গণি মিয়ারে আনতে। ততোক্ষণে মাবাবা, বোন, কাকা, কাকীরা, দাদু সবাই আমার থেকে ভয়ে দূরে দূরে সরে যায়। সবাই কোরান-কালাম ঝপতে থাকে। একটা শোর উঠে। এভাবে চলে অনেকক্ষণ। চোখ বন্ধ থাকতে থাকতে আমার আবার ঘুমের ঘোর লাগে। হঠাৎ সবার ‘এই সরে যা’ চ্যাচামেচিতে আমি কান খাড়া করি। গণি মিয়ার কণ্ঠ পাওয়া গেছে! গণি মিয়াকে দেখে আমি আবার চোখ লাল করে গর্জে উঠি। গণি মিয়া এগিয়ে এসে আমার বাম হাত ধরার চেষ্টা করে। আমি ছুটায়া নেই। সে শক্ত করে আমার কেনে আঙ্গুল ধরে। খুব ব্যাথা লাগে! সে জিজ্ঞাসা করে, কে তুমি!
আমি কোন কথা বলি না।
সে এবার ধমকের সুরে বলে, এই কে তুই?
এবারো আমি কোন কথা বলি না। গণি একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে উপস্থিত দর্শক সারির দিকে তাকিয়ে আবার জোর করে আঙ্গুল চেপে ধরে। আমার খুব ব্যাথা লাগে। এবার আমি গর্জে উঠি! শরিলের সব শক্তি দিয়ে ডান হাতে ঠাশ করে এক চড়! উপস্থিত সবাই হতভম্ভ! গণি আমার হাত ছেড়ে কোন কথা না বলে চুপচাপ বেরিয়ে যায় আমাদের ঘর থেকে। ততোক্ষণে ঘটনাটা অনেকে আন্দাজ করতে পারে। বিশেষ করে আমার ভাই। আমি মুহুর্তেই কাত হয়ে শুয়ে পড়ি।
পরের দিন এই ঘটনা গ্রামে ছইছই হয়ে যায়। গণি অপমানে ঘর থেকে বের হয় না। সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময় জীবনে শেষ বারের মত রুপার সাথে আমার দেখা হয়। স্কুলে অনেকে রুপার বাবার এই অপমান নিয়ে আলোচনা করে। মেয়েটা খুব লজ্জায়, কষ্টে, ঘৃণায় সেদিন তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে চলে যায়। আমি সবার সামনে হিরো হয়ে যাই। তবে আমাকেও পরের দিন শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জীবনে রুপার সাথে আমার আর কখনোই দেখা হয় না।
১৮ ই জুলাই, ২০১৩