সমুদ্র সৈকতে গেলে তার সব সময় মনে পড়ে প্রথম সমুদ্রে যাওয়ার স্মৃতি। এমনি এক স্মৃতি যা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির এতো এতো রঙিন ঝলমলে আলোর মধ্যেও। এতো রঙিন আলো, ফিল্ম স্টার, চারিদিকে ধনীদের আনাগোনা, অনবরত জ্বলতে থাকা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, সব কিছু ছাপিয়ে সে একা হয়ে যায়। তার আশপাশে থাকা অনেকে জানে বিষয়টা – সমুদ্র নিয়ে নায়িকার একটা অবসেশন আছে। এজন্য সে সমুদ্রে যেতে চায় না কারো সাথেই। কিন্তু এক-দুই দিনের জন্য কেউ দশ লাখ টাকা অফার করলে লোভ সামলামে এমন নায়িকা ইন্ডাস্ট্রিতে কয় জন আছে! তাছাড়া শহরের মাল্টি মিলিয়নিয়রদের অনুরুধ রক্ষা তার কাজের মধ্যেই পড়ে।
দুই দিনে দশ লাখ দাম তার! লোকটার বয়স কোন ফ্যাক্ট না। অথচ এক সময় সে ভাবতো দুইশ টাকা হলে সে তার বাবার স্বপ্ন অর্থাৎ তার বাবা তার জন্য একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারতো। আজ তার রিক্সা চালক বাবা পৃথিবীতে বেঁচে নেই। বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা রত্না আজ ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির নায়িকা। কোথা থেকে কোথায় এসেছে সে! এর মাঝে বিশটি বছর চলে গেছে। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে সাত-আট বার সুইসাইড এটেম্পট করেছিল সে।
আজ রত্না এসেছে শহরের এক বিজনেস বিগ শর্ট’র সাথে মিয়ামি বিচ এ। পৃথিবী ব্যপি বড়ো ধনীদের পছন্দের বিচগুলোর মধ্যে মিয়ামি নিঃসন্দেহে প্রথম সারিতে থাকবে। তাকে গম্ভীর দেখে লোকটা তাকে কিছুই বলেনি! এমনকি শরীরে টাচও করেনি! লোকটা মদ খেয়ে বারবার বলছে, আমি চাইলে তোমাকে মিয়ামির এই ফাইভ স্টার হোটেল কিনে দিতে পারি, সামনে যে ইয়টগুলো দেখছ তার সবচেয়ে দামিটা কিনে দিতে পারি, বলো কি পেলে তোমার মন ভালো হবে?
মেয়েটা আলিশান সুইটস এর খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না। সে জানে এটা অপেশাদারিত্ব। টাকা দিয়ে যখন কেউ তোমার সময় কিনে নেয় তখন তার মনোরঞ্জন করতে তুমি বাধ্য। সেটা সে জানে। তাও আজ লোকটাকে সে পরীক্ষা করতে চায়। সে আসতে চাইছিলো না সমুদ্রে। কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা। পারে না তার হাতে পায়ে ধরে মিয়ামিতে আসার জন্য। শহরের সবচেয়ে সুন্দরী নারীর সাথে মিয়ামি বিচে ঘুরবে, কম বয়সে এটা নাকি তার স্বপ্ন ছিল। চল্লিশ বছর ধরে ব্যাবসা করে সে এই স্বপ্ন পূরণের সময় পায় নাই। এমন ভাবে কাতর গলায় লোকটা কথাগুলো বলছিলো সে নাও করতে পারে নাই। এসে মনে হয় মেয়েটা ফেসে গেছে। কোন ক্রমেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারতেছে না।
এর মাঝে লোকটা কয়েক পেগ গিলেও ফেলেছে। কিন্তু রত্না এখনো তাকিয়ে আছে নীল সমুদ্রের দিকে। তার কালচে বাদমী চুলগুলো দুই পাশ থেকে উড়ছে বাতাসের সাথে সাথে। সে হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে বলে, এজন্য আমার সমুদ্র পছন্দ না। লোকটা বলে, এতো সুন্দর সাজানো বিচ যার পছন্দ না তার সাথে আমি সমুদ্র বিলাশে আসছি, এটা আমার জন্য অন্য রকম অভিজ্ঞতা। আমি আবারও জানতে চাইবো, কি পেলে তোমার মন ভালো হবে? তুমি প্রজাতির মতো উড়বে?
মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর হাতের গ্লাসটা রাখতে রাখতে বলে, আমি যা চাই তা দিতে পারবেন? লোকটা বলে, হুকুম করেই দেখোনা। মেয়েটা ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তার দিকে অনেকক্ষণ। তারপর বলে, আমার শৈশব এনে দিতে পারবেন, যখন আমার বাবা সাগর পাড়ে রিক্সা চালাইতো, আমি সাগর পাড়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উইড়া বেড়াইতাম। আজকে আমি ইন্ডাস্ট্রির একজন সফল নায়িকা। কিন্তু আমার বাবা আমাকে দুইশ টাকার জামা কিনে দেয়ার জন্য জীবন দিছে। এনে দিতে পারবেন, সেই সময়টা?
লোকটা গ্লাসের পর গ্লাস সাবাড় করতে থাকে। তার মতো লোকের ভাড়া করা মাগির এতো নেকামো পছন্দ হওয়ার কথা না। কিন্তু লোকটা তার কথায় প্রতিনিয়ত আগ্রহী হয়ে উঠছে। এক সময় লোকটা বলে, দুইশ টাকার জন্য জীবন দিয়েছে মানে!
দিনটা ছিল ঝড়ের দিন। পরের দিন ঈদ। আমি কানতেছিলাম নতুন জামার জন্য। জামা কিনতে দুইশ টাকা লাগে। সাগরে ছয় নাম্বার সিগনাল চলে তখন। ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়া বাবা রিকশা নিয়া বের হয়। রাস্তায় একটা গাছ পড়ে বাবা মারা যান। আমি প্রথম সাগর পাড়ে যাই বাবার লাশ আনতে।
লোকটা বলে, সো স্যাড, আম সো স্যারি৷
মেয়েটা বলে, ইটস ওকে৷ আমার কি করার আছে তাতে?
তারপর? তুমি কিভাবে এতদূর এলে?
নায়িকা বলে, বাবা চলে যাওয়ার পর আমার মার আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। আমাকে তখন এনজিও স্কুলে ভর্তি করে দেয় আমার নানু। নানু মারা যাওয়ার পর ছোট খালার সাথে ঢাকা চইলা আসি। খালু লোকটা পিশাচ। প্রায়ই আমার গায়ে হাত দিতো। একদিন জোর করে আমার গায়ের উপর উইঠা যায়। এমন সময় খালা এসে তার মাথায় রড দিয়ে বাড়ি মারে। স্পট ডেড! খালার জেল হয়ে যায়। তারপর আমার মা আমাকে নিয়ে যায় খুলনায় তার তৃতীয় স্বামীর কাছে। লোকটা তখন রিটায়ার্ড করে বাড়িতে থাকতো। বয়স ৭০ এর মতো। আমার মায়ের বয়স তখন ত্রিশ কি বা বত্রিশ হবে। উনি আমাকে প্রকৃত আলোর দীক্ষা দিয়েছেন। আমার মাকে তার পেনশনের উত্তরাধিকার করে দেন। স্বর্ত ছিল এই টাকা দিয়ে আমাকে পড়াশোনা করাইতে হবে। তারপর আমরা ঢাকা চলে আসি।
ঢাকায় আসার পর আমি কলেজে ভর্তি হই। তখন আমার মার উপর আরেকজন লোকাল লিডার ফরিদ আঙ্কেলের চোখ পড়ে৷ সেও সম্ভবত মদ খেত। কিন্তু লোকটা কখনোই মাকে কোন বিষয়ে প্রেসার দিতো না। বাজে আচরণ করতো না। শুধু রাস্তায়, হাট-বাজারে বা আমার স্কুলে যাওয়ার সময় খোঁজ খবর নিতো। আর প্রায়ই বলতেন, তোমাদের কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাইও। আমাদের কোন সমস্যা ছিলো না। প্যানশনের টাকায় সাধারণ একটা জীবন, চলে যেত। বিপত্তি ঘটে যখন এক বড় লোকের ছেলে আমাকে পছন্দ করে। সে আমার মায়ের কাছে প্রায়ই বলতো আমাকে বিয়ে দেয়ার কথা৷ আমার মা কমিটেড ছিলেন আমাকে অনেকদূর পড়াশোনা করাবেন। কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই পিছু ছাড়তেছে না। বাধ্য হয়ে আমরা ঐ লোকাল লিডারের কাছে যাই। সে আমাদের তার বাড়ির নিচ তলায় ভাড়া থাকার জন্য অনুরোধ করে। আমাদের আর কোন উপায় ছিলো না। কারণ তার কয়েক মাস পর আমার ইন্টার পরীক্ষা।
নতুন বাসায় উঠার পর ছেলেটা আরও বেশি ক্রেজি হয়ে যায়। সে এবার থ্রেট করতে থাকে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। আমরা বিষয়টা ফরিদ আঙ্কেলকে জানাই। ফরিদ আঙ্কেল বললো আচ্ছা আমি ওকে সাবধান করে দেব। এরপর ডিস্টার্ব করলে আমাকে জানাইও। এরপর কয়েকদিন তাকে আর দেখা গেল না। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে চলতে শুরু করলাম৷ হঠাৎ একদিন আমার স্কুলের সামনে কয়েকটা ছেলে সহ ঐ ছেলেটাকে দেখে আমার মা ফরিদ আঙ্কেলকে ফোন করেন। ফরিদ আঙ্কেলকে ফোন করার পর তিনি গাড়ি ভর্তি ছেলেদের নিয়ে এসে হাজির। লাঠিসোঁটা হাতে এতোগুলা ছেলে দেখে সবাই পালিয়ে যায়। শুধু ওই ছেলেটা একা দাঁড়িয়ে থাকে। ফরিদ আঙ্কেলের ছেলেরা ওকে কোথায় যেন নিয়ে যায়। আর ফরিদ আঙ্কেল বলে তোমাকে আর কোন দিন ডিস্টার্ব করবে না। ছেলেটার ভাগ্যে তারপর কি ঘটেছিল জানি না। তবে তাকে আমি আর কক্ষণো দেখি নাই।
নায়িকার গল্পে মগ্ন হয়ে লোকটা মদ গিলে যাচ্ছে অনবরত। কিন্তু কোন কথা বলছে না। শ্রোতার আগ্রহ না থাকলে গল্প কথক গল্পে মজা পায় না। এই অনিশ্চয়তা থেকে রত্না তার প্রতি মনযোগী হয়। দেখে লোকটা টেবিলে মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছে। মেয়েটা অনেক কষ্ট করে তাকে ধরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তাকে তুলতে যাবে এমন সময় দেখে তার শরীর শক্ত হয়ে আছে। সে চমকে উঠে জোরে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন লাভ হয় না। লোকটা কি মরে গেল নাকি? তখন সে তাড়াতাড়ি রুম সার্ভিসের জন্য বেল চাপতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে রুম সার্ভিসের লোকরা এসে নাড়াচাড়া করার পর বলে, হি ইজ নো মোর। তখনই তারা পুলিসকে ফোন করে। পুলিশ আসার পর প্রথমে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর রত্নাকে নজরবন্দি করে রাখে।
এদিকে বাংলাদেশে নিউজ হয়ে যায়, ব্যাবসায়ী হত্যার জন্য রুপালি পর্দার জনপ্রিয় নায়িকা রত্না এখন আমেরিকান পুলিশের কব্জায়।
একটা ইংরেজি পত্রিকা হেডলাইন করে এভাবে, ক্যাসল গ্রুপ ওউনার কিল্ড ইন হোটেল মিয়ামি, ফিল্ম স্টার রত্না ডিসকোবার্ড ইন হিজ বেড!
মুহুর্তের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে যায় সারা পৃথিবীতে। একমাত্র নিউইয়র্ক টাইমস একটা দায়িত্বশীল নিউজ ছাপে। তারা বলে, ফ্লোরিডা পুলিশ ডিসকোভার্ড বাংলাদেশি বিজনেস ম্যাগনেট’স ডেড বডি এট হেটেল মিয়ামি, উইথ আ ফিল্ম সেলিব্রিটি, ডেথ কজ ডিউ টু একসেসিভ ড্রিংকিল, ফ্লোরিডা পুলিশ।
হোটেল সুইটসের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চেয়ে থাকে নিজের চেহারার দিকে। সে ভাবতে থাকে। সে কি রক্ষা পাবে, সে কি আবার ঘুরে দাড়াতে পারবে ইন্ডাস্ট্রিতে, নাকি হত্যা মামলায় তার ফাঁসি হয়ে যাবে? সে ফোন করতে থাকে অনবরত। পরিচিত কেউই তার ফোন ধরে না। এবার সে নিজ থেকে একটা ড্রিংক নেয়। তার মনে পড়ে তার রিক্সওয়ালা বাবাকে যে তাকে দুইশ টাকার জামা কিনে দিতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। সে আদো বাংলাদেশে ফিরতে পারবে? তার মত টাকার বিনিময়ে ধনীদের সজ্জাসঙ্গী হওয়া মেয়ের পক্ষে কি আসলে কি কেউ দাড়াবে? এমন ভাবতে ভাবতে কত সময় কাটে তার জানা নেই। সন্ধায় সুইসটের কলিংবেল বাজতে থাকে৷ সে দরজা খুলে দেখে ফ্লোরিডা পুলিস। সে এবার নিশ্চিত হয় তাকে এরেস্ট করতে এসেছে। সে বলে, লেট মি এরেঞ্জ মাই ব্যাগ এন ব্যাগেজ।
নো, ইউ আর ফ্রী ম্যাম। উই ফাইন্ড আউট দা ডেথ কজ অব মি. চৌধুরী। ইট’স একসেসিভ ড্রিংকিং। নাউ, ইউ ক্যান গো এনি হোয়ার!
এরপর পুলিশ চলে গেলে মেয়েটা একটা লম্বা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে তাকিয়ে থাকে বিপরীত পাশের আয়নার দিকে। তার ঘোর বা ভয় এখনো কাটে না। আমেরিকান পুলিশের কাছ থেকে সে মুক্তি পেলেও বাংলাদেশে তার কি অবস্থা হবে তা ভাবতে থাকে!