আকাশ প্রদীপ জ্বলছে
তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবেমাত্র স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেছি। কোথাও কোনও চাকুরি হয় নাই। হলেই থাকি। আমার এক পরিচিত বন্ধুর রেফারেন্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের গবেষণা কাজে সহায়তা করার জন্য সাময়িক ভাবে তাঁর ওখানে যোগ দেই। বান্দরবানের শঙ্খ নদীর তীরে বসবাসরত মানুষদের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জীবন ধারার উপর উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। আমাকে এ কাজের জন্য ওখানে এক মাসের মতো থাকতে হবে।
আমি চলে যাই বান্দরবানে। ছিমছাম ছোট এই পাহাড়ি শহরের একটি পুঞ্জিতে এক বৃদ্ধার বাড়িতে এক মাসের জন্য একটি রুম ভাড়া নেই। বৃদ্ধার দশ বারো বছরের একটি নাতি ছাড়া আর কেউ ছিল না। স্বামী আগেই গত হয়েছিল। ছেলে, ছেলে বউ দুজনেরই অকাল মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র নাতিকে নিয়েই সে এই বাড়িতে থাকে। আমি এখানে নিজেই টুকটাক রান্না করে খেতাম। আবার মাঝে মাঝে রাস্তার উপরে কুসুমেন্দু মং এর পাতার ছাউনির হোটেলেও খেতাম।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা উচ্ছল ছলছল এক তরুণ। হঠাৎ এমন নৈসর্গিক জায়গা পেয়ে উচ্ছসিত হয়ে যাই। পাহাড়, বনরাজি, মানুষ আর নদীর কাছে আমার সকল বিমুগ্ধতা বিলিয়ে দেই। প্রথম দিনই আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই শঙ্খ নদীর তীর ধরে পাইনছড়াতে। আঁকাবাঁকা সর্পিল বনপথ ধরে যখন একাকী চলছিলাম, দেখি লালচে একটি ভালুক হাঁটছে শঙ্খ নদীর তীর ধরে। আবার দেখি একটি গয়াল বন থেকে বের হয়ে নদীতে জল খেতে যাচ্ছে। পথের পাশে নাগলিঙ্গম গাছে কতগুলো হনুমান এ ভাল ও ডালে লাফালাফি করছে। এসবই দেখে আমি মুগ্ধ হই। চলতে চলতে পথে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি আকাশের নীল। অরণ্য, পাহাড়,পাখপাখালি, নদী, জীবজন্তু — এসব দেখার মুগ্ধতা নিয়েই আমি এই বনভূমিতে কাজ করতে থাকি।
আমার উদ্দেশ্যই ছিল এখানকার মানুষদের জীবন যাত্রাকে দেখা, তাদের জীবন আচার, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব পর্যবেক্ষণ করা। এই এলাকা বা পুঞ্জীটি ছিল মারমা উপজাতীয় প্রধান। আমি দেখছিলাম এইসব মানুষদেরই জীবন। তাদের প্রতিদিনের হাসি কান্না সুখ দুঃখ। এদের সাথে কথা বলে আমার প্রশ্ন সম্পর্কিত উত্তরগুলো টুকে নিতাম নির্দিষ্ট প্রশ্নমালায়।
একদিন পানছড়াতে যাব বলে শঙ্খ নদীর পাড়ের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে পথে পা আমার থেমে যায়। হঠাৎ কেন এই পথের মাঝে থেমে যাওয়া? জলের দিকে তাকিয়ে দেখি তীব্র স্রোত বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সেই নিঝুম নিরালায় মন আমার উদাস হয়ে উঠল। বাসা থেকে চলে এসেছি তখন অনেকটা দূর। ভাবনায় কিছু স্বপ্নের মৃত্যু হতে দেখলাম। মন খারাপ হয়ে গেল। পথ চলতে আর মন চাইল না। মনে হচ্ছিল, যে মায়াবি চোখ আমি দেখে এসেছিলাম ঘর থেকে বের হওয়ার সময়। সেই মলিন চোখ কি কাঁদছে কারোর জন্য? মন চাইল, ফিরে যাই ঘরের দিকেই। দেখি গিয়ে ঐ মেয়েটিকে আবার।
সত্যি সত্যি ফিরে এলাম বাড়ির দিকে। কাঠের দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো যে মেয়েটিকে দেখে গিয়েছিলাম, সে তখন আর সেখানে দাঁড়ানো নেই। আমি চলে আসি আমার রুমে। ঢাকা থেকে আসার সময় কিছু বই নিয়ে এসেছিলাম। সেই বইগুলো থেকে পড়ছিলাম যাযাবরের দৃষ্টিপাত। পড়তে পড়তে যেখানে শেষ করেছিলাম, সেখান থেকে পড়া শুরু করি — ‘পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মুর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। তাদের , ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণখণ্ডে উত্কীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা ।’
পড়তে পড়তে বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। সারা দিনের কোনও ক্লান্তি ছিল না আজ। তবুও ঘুমালাম। জীবনের শুরুতে নাকি মানুষ বেশি করে স্বপ্ন দেখে। ঘুম ভাঙ্গার পর আজ কোনওই আফসোস নেই আমার। কোনও স্বপ্ন আসেনি আজ। আমি তো দেখতে পারতাম, পাশের বাসার ঐ মারমা মেয়েটিকে। ঐ যে তার দুঃখি দুঃখি চোখ, পরনে ছিল সাদা কালো চেকের থামি। বুকে বাঁধা ছিল রাংপাই। বয়স তার মধ্য তিরিশ। সে চেয়ে দেখে নীরব নির্ঝরে দুরের পাহাড়ের ঝর্ণাধারা। কখনও দেখে কি সে ধূসর মেঘ পাহাড়ের গায়ে। আমি প্রথম দেখায় বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ের চোখের ভিতর শঙ্খ নদীর নিস্তব্ধ জল ভরে আছে।
বাইরে বের হবো বলে আজ বিকেলে পরিপাটি করা কাপড়চোপড় পরি। রুম থেকে বেরুনোর সময় বৃদ্ধা আমাকে বলছিল — তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছেনা তো?
আমি : না মাসি।
মাসি : কোনও কিছু অসুবিধা হলে বলবে আমাকে।
আমি : আচ্ছা। বলব।
এই বৃদ্ধাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, তার মুখে দেখেছিলাম আমার মায়ের প্রতিরূপ। যে কয়টি দিন ছিলাম এখানে সে জানতে পারেনি, তাকে দেখতে লাগে আমার মায়ের মতোন।
ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখন এই শৈল শহরে সন্ধ্যা নামছিল। বনে বনে পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। অস্তমিত সূর্যের বিচ্ছুরিত লাল আভা পাহাড়ের উপর দিয়ে, বৃক্ষ রাজির ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম। স্বর্গীয় এই সন্ধ্যা আলোয় খুব ইচ্ছা হলো ঐ মেয়ের মুখখানি দেখবার। আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলাম তাই ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সৌভাগ্য যেন ঈশ্বর আমাকেই দিল। সে দাঁড়িয়ে আছে আমারই পথের দিকে। কেন যেন কষ্ট পেলাম তাকে দেখে । আজকের এই সন্ধ্যার মেঘমালা তার মুখের গভীর দুঃখ ছায়াকে একটুও সরাতে পারেনি।
শহরের উঁচুনিচু পথ ধরে একাকী হাঁটছিলাম। মনটি কেমন যেন উড়ো উড়ো লাগছিল। দেখি এক জায়গায় একটি ইস্কন মন্দিরে কীর্তন হচ্ছে । অনেকগুলো নারী পুরুষ বসে শুনছে সে গান। আমি ওদের মাঝে গিয়ে বসে পড়ি। সন্নাসী জাতীয় কয়েক লোক গাইছিল তখন–
‘অঙ্গ পুলকিত, মরম সহিত, অঝরে নয়ন ঝরে।
বুঝি অনুমানি, কালা রূপ খানি,
তোমারে করিয়া ভোরে।।
দেখি নানা দশা, অঙ্গ যে বিবশা,
নাহত এত বড় ভারে।।
কিছুক্ষণ কীর্তন শুনে চলে যাই কুসুমেন্দুর হোটেলে। কুসুমেন্দুকে বলি : আজ তোমার মেনু কি?
কুসুমেন্দু বলে, লইট্টা শুটকি মাছ, আর বন মোড়গের তরকারি। আমি দুটোরই অর্ডার দিই।
একদিন মাসির নাতি বিজুকে ডেকে বলি — বিজু, পাশের বাড়ির ঐ যে মেয়েটা প্রতিদিন একাকী বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে, ওর নাম কি?
বিজু : আনা পিশীর কথা বলছ? উনি আমার সম্পর্কিত পিশী হয়।
আমি : জ্বী বিজু। পুরো নাম বলো।
বিজু : আনাচিং মারমা।
আমি : কি করে সে?
বিজু : কিছু করে না।
আমি : তোমার পিশীর বিয়ে হয়নি?
বিজু : হয়েছিল। পিশু মশাই মারা গেছে অনেক আগে।
পরে মাসির কাছে থেকে জেনেছিলাম, আনাচিং এর বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় মাত্র তিন দিনের জ্বর ভোগের পর তার স্বামী মারা যায়। কোনও বাচ্চা নেই। সেও নাকি দশ বারো বছর হয়ে গেছে। তারপর তার আর বিয়েও হয়নি। মারমাদের গোত্রীয় নিয়ম অনুযায়ী বিধবাদের বিয়ে করার আর অনুমতি নাকি দেওয়া হয় না।
আনাচিং সম্পর্কে আরো কিছু জেনে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি যে, সে তার বৈধব্য জীবনে বাড়ি থেকে কোথাও বের হয় না। কারো সাথে কোনও কথা বলে না। বিশেষ করে পুরষদের সাথে। সে দেখতে ঐ পুঞ্জীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল। কোনও প্রকার সাজহীন মুখ তার বনভূমির নবকিরণের আলোর দ্যূতি ছড়ায় শঙ্খ নদীর পাড়ের আকাশে বাতাসে। সপ্তাহে প্রতি রবিবারে সে একবারই বের হয়, যায় তাজিংডং পাহাড়ের স্বর্ণ মন্দিরে। মহামতি বুদ্ধের স্বর্ণ মূর্তির পাশে বসে থাকে সে এবং ধ্যান করে।
সেদিনের বিকেল ছিল শান্ত ও সৌম্যের। সকাল থেকেই সোনালি রোদ্দুর ঝিলমিল করছিল বনভূমির বৃক্ষ রাজির পাতায় পাতায়। আমার মন বড়ই চঞ্চল হয়ে উঠল। আমি চলে যাই তাজিংডং পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত স্বর্ণ মন্দিরে। মন্দিরের বাইরে নিজ পাদুকা জোড়া রেখে মন্দিরে প্রবেশ করি। দেখি আনাচিং বুদ্ধ মূর্তির পাশে বসে একাগ্রচিত্তে ধ্যান করছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসি এবং ধ্যানে মগ্ন হই। আনা’র ধ্যান করা শেষ হলে তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকাই আনাচিং এর দিকে। হঠাৎ মন্দিরের ভিতরে সমস্ত জপমালা যেন থেমে গেল। কারো মুখে কোনও কথা নেই। কোনও হাসি নেই। বুদ্ধের চোখও যেন বিষণ্ন হয়ে দেখছে আমাদেরকে। আনাচিং এর চোখ দেখে মনে হলো হাজার বছর আগে কপিলাবস্তুুতে কোনও এক আম্রপালি গুমরে গুমরে কেঁদে স্থির করে রেখেছে এই চোখ। মন্দিরে মহামতি বুদ্ধের মূর্তির সামনে ওকে বলতে ইচ্ছা করল, এই চোখে তুমি এত জল ভরে রেখেছ কেন? কিছু জল রেখে দিতে পারো শঙ্খ নদীতে। আর কিছু দিতে পারো আমাকে।
আজ রাতে আর কুসুমেন্দু হোটেলে খেলাম না। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে ঘরে এসে আলো জ্বালাই। মাসি এসে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি খেয়েছ?
আমি : না।
মাসি : খাবে না?
আমি : না।
একটু পর দেখি, মাসি জুম ফসলের কিছু খাবার থালিতে করে এনে রেখে দিল। বলল — খেয়ে নিও।
মাসির দেওয়া কিছু খাবার খেয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমাবার চেষ্টা করলাম, ঘুম আসে না চোখে। পথে যেতে যেতে দেখেছিলাম আজ কত বৃক্ষের ছায়া এসে পড়েছিল পথে। আনাচিং এর জীবনের এই পথে কোনও বৃক্ষের ছায়া কি আর পড়েনি? আমি তো হতে পারি তার শীতল বৃক্ষের ছায়া! আবার আলো জ্বালিয়ে দেই। আবার বসে থাকি। জানালা খুলে দেখি, দূরের পাহাড়ের গায়ে আঁধার। জীবন এত শূণ্য মনে হয় কেন?
মনে পড়ছিল সেই শিলংয়ে লাবণ্য- অমিতের কথা —
‘আকাশে সোনার রঙের উপরে চুনি গলানো, পান্না গলানো আলোর আভাসগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাতলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে যেখানে দেহ নেই শুধু আনন্দ আছে সেই অমর্ত্য জগতের অব্যক্তধ্বনি আসছে। ‘
আস্তে আস্তে বান্দরবানের দিনগুলি আমার শেষ হয়ে আসে। এরপর একটি রবিবার পেয়েছিলাম স্বর্ণ মন্দিরে যাওয়ার। গিয়েছিলামও কিন্ত দেখা মেলেনি আনাচিং এর। সন্ধ্যার মেঘমালায় কখনও কখনও তার দেখা পেতাম ঐ বাড়ির কাঠের দোতলায়। মাঝে মাঝেই এলোচুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকত সে। পরনে থাকত সাদা থামি আর রাংপাই। কেন জানি মনে হতো, ঐ চোখ খুঁজতো ঝাঁকড়া চুলের কোনও এক তরুণকে। যে তরুণ কখনও বলেনি তাকে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’ কিন্তু তার জন্য কেন অন্তর দাহ হয়। আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায় কাঁচা সোনা। যে সোনা পোড়ানোর দাহে তপ্ত হয়েছিল এক বিধবা আনাচিং এর বৈধব্য মন।
সেদিন ছিল প্রবারণা পূর্ণিমা। আমারও শেষ দিন ছিল বান্দরবানে। প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধ নরনারীরা শুচি শুভ্র হয়। সুন্দর পোশাকে বৌদ্ধ বিহার সমবেত হয়। বুদ্ধকে পূজা দেয়। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এদিন ঘরে ঘরে ভাল রান্না হয়। সন্ধ্যায় হয় ফানুস উড়ানো উৎসব। ফানুস উড়ানোর উদ্দেশ্য হলো আকাশে ভাসমান গৌতমের পবিত্র কেশধাতুকে প্রদীপ দিয়ে বন্দনা করা হয়। আশ্বিনের সেই পূর্ণিমার আকাশে মোহনীয় আকাশ প্রদীপ জ্বলে ওঠে।
মাসি অথবা বিজুর মাধ্যমে আমার চলে যাবার কথা শুনেছিল হয়তো আনাচিং। আজকের এই প্রদীপ জ্বালানো রাতে আনাচিং চেয়েছিল আমাকে। আলো আঁধারের সন্ধ্যায় যখন হাঁটছিলাম ঐ বাড়ির পাশ দিয়ে, হঠাৎ উপর থেকে উড়ে এলো একটি ছিন্ন কাগজ। তাতে লেখা ছিল-‘ তুমি তাজিংডং পাহাড়ে দেবতা পুকুর পারে চলে যেও। ‘
আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার সন্ধ্যা রাত। ফানুস উড়ানোর উৎসব হচ্ছে। আকাশে আকাশে আকাশ প্রদীপ জ্বলছে। উৎসবের এমন রাতে আমি দুরুদুরু পায়ে হাঁটতে থাকি জ্যোৎস্না তলার নীচ দিয়ে উপত্যকার পথ ধরে তাজিংডং পাহাড়ের দিকে। চারদিকে বুঁনো ফুলের গন্ধে উতলা হয়ে আছে বাতাস। জ্যোৎস্নার আলোর ছটা ঝরে পড়ছে পথে পথে। এই স্বর্গীয় মায়াময় পথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই দেবতা পুকুর পাড়ে।
চারদিকে নীরব নির্জন। কোনও মনুষ্য নেই। মনুষ্য কর্তৃক কোনও আলো জ্বালানো নেই। আছে পূর্ণিমার চাঁদ। আর দূরে আকাশ প্রদীপ জ্বলছে। ঠিক পুকুর পাড়ের ওপাশে একটি নারী মূর্তি দেখা গেল। কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি, আনাচিং। আজও পরনে সেই সাদা থামি। আর বুকে বাঁধা রাংপাই। আমি ওর মুখখানির দিকে একবার তাকাই। এই মুখ কত সন্ধ্যার মেঘমালায় দেখেছি দূর থেকে। আজ এই পূর্ণিমার আলোয় দেখছি কাছে থেকে। কি যে ভালো লাগছিল আমার! আনাচিং খুব কাছে এসে আমার বুকে ওর কপাল ঠেকিয়ে বলছিল- আমার জীবনের হাস্নাহেনার সুরভিত দিন কবে ভেসে গেছে।তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে? এই জীবনে তুমি আমাকে পাবে না। দূর থেকে বুঝতে পেরেছি – তুমি প্রতিক্ষণ আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছ মায়াভরে। মুক্ত করে নিতে চেয়েছ আমাকে। এ কোনও দিন সম্ভব নয়। আমার জীবনের সকল অস্তিত্ব থেকে, সকল বাঁধন থেকে, সকল টান থেকে তোমাকে মুক্ত করে নাও। তুমি সুবিমল আকাশে মুক্ত হয়ে বিচরণ করো। তুমি চিরকালের জন্য আকাশের, ঐ আকাশ প্রদীপের মতো ঝলমলে তোমার নবীন জীবন হবে । আমার অস্তিত্ব, আমার প্রেম তোমার কোনও কিছুতে রেখ না। না শরীরে, না মনে।’
আমার বুক থেকে আনাচিং ওর কপাল উঠিয়ে নেয়। দেবতা পুকুর পাড় ধরে সে হেঁটে হেঁটে চলে যায় পাহাড়ের ঢালের দিকে। আমাকে বলে, ‘ তুমি একটু এখানে দাঁড়াও।’ আমি ওর কথায় দাঁড়িয়ে থাকি। বুঁনো ফুলের গন্ধ আর বাতাসে ভেসে আসছিল না। হঠাৎ পূর্ণিমার চাঁদ মেঘে ঢেকে গেল। কেমন যেন আঁধার নেমে এলো চারদিক থেকে। তারপর অন্ধকারে আনাচিংকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাছে গিয়ে দেখি আনাচিং কোথাও নেই। নীচে তাকিয়ে দেখি, গিরি খাদ। খাদের পাশ দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে খরস্রোতা শঙ্খ নদী। দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, আকাশ প্রদীপ জ্বলছে।
~ কোয়েল তালুকদার