আমরা জোছনা দেখার জন্য প্রায়ই ছুটে যেতাম শান্ত নদীটার পাড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। নদীতে ঠকঠক শব্দ করে চলা ট্রলারের বাতি আবছা দেখে মনে হতো আমাদের পৃথিবীটা থমকে গেছে স্থির নদীর জলের মতো। তার মাঝে উল্কা পাতের মতো একটা আলো হেঁটে চলছে। কখনো কখনো মনে হতো ঘোর অন্ধকারের মাঝে হঠাৎ ডেকে উঠা পাখিটা আমাদের মতো প্রাণের বিচ্ছিন্নতায় কাৎরাচ্ছে।
আমার সাথে থাকা নারীটি কখনোই কোন কিছুতে মাথা ঘামাতো না। শুধু চুপচাপ শুনতো। তার জীবনের একমাত্র ব্রত নাকি আমাকে শুনে যাওয়া। কিন্তু কখনো তার কোন স্বপ্ন ভঙ্গ হলে আমার বুকে মাথা রেখে নিশ্বব্দে কেঁপে কেঁপে চোখ ভিজাতো। আমার শরীর এক বিন্দুও ভিজতো না। আমার তখন মনে হতো আমার জীবনটা এতো ব্যার্থ কেন? তখন বয়স ছিল কম। অল্পতেই সফলতা ব্যার্থতা বিচারে নেমে পড়তাম। নিজের মাঝের কষ্ট আর অভিমানে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতাম।
আমাদের পাশে সব সময়ই একটা জেলে নৌকা বাঁধা থাকতো। কিন্তু আমরা কোনদিন নৌকায় চড়তাম না। তার একসাথে জলে ভাসতে খুব ভয় করতো। তার ধারণা ছিল দুইজন একসাথে যদি ডুবে যাই, আমাদের বাঁচাবে কে? আমার তখন মনে হতো বাঁচা মরা যদি আমার নিজ হাতে থাকতো!
একবার অসম্ভব গরমে ঘরে টিকা যাচ্ছিলো না। বাইরে ঘোর অন্ধকার। ঠিক মাথার উপরের আকাশ দেখে আমি বের হয়ে গেলাম। বাইরে কোথাও ডাকাত পড়েছে। দূরে মানুষের হাঁকডাক শুনা যাচ্ছিলো। আমি একটা গুলির শব্দও শুনতে পেলাম। তবুও পিছপা হতে পারলাম না। কারণ আমি জানতাম সে আসবে। এই নদীর বুকে ছুটে ছুটে আমাকে খুঁজবে। না পেলে হয়তো চলে যাবে। রাগে অভিমানে বেশ কিছুদিন আমার সামনে আসবে না। তার মান ভাঙানো এতো সহজ নয়। আমি জানি, হতে পারে একটা জীবন কেটে যাবে। সেদিন সে আসেনি। সারারাত আমি বসেছিলাম হিজল গাছের ডালে। সে এসেছিল কি না, বা আসলেও আমার সামনে আসেনি কেন জানতাম না।
তার যদি কখনো মন ভালো থাকতো, বিশেষ করে জোছনায়, যখন নদীটা জোয়ারে টইটম্বুর, দুরে যাওয়া লঞ্চগুলো হুইসেল বাজিয়ে চলে যেত, মাঝিরা ছোট্ট নৌকা নিয়ে ভাসতো, আর সে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো। এতো প্রাণ চঞ্চল তাকে উড়তে দেখলে আমার যে কি আনন্দ হতো বলে বুঝানো সম্ভব নয়। আমার তখন মনে হতো পৃথিবীটা এতো বড় কেন? আরও ছোট হলে হয়তো আমার মতো মানুষের হাতে অনেক কিছু ধরে রাখা সম্ভব হতো।
আমার মা প্রায়ই বলতো, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ডাক্তার দেখানো উচিত, নদীর পাড়ে এমন কোন মেয়ে নাই। আমি চিনি তার বাড়িটা, অনেকবার সে আমাকে তার বাড়ি নিয়েও গেছে। কিন্তু মা বিশ্বাস করলো না। একদিন মা সত্যি আমার সাথে যেতে রাজি হলো নদীর কূলে তার বাড়িতে। আমি তো উৎফুল্ল মনে মাকে নিয়ে চললাম। আমি এতোই উৎফুল্ল ছিলাম আজ মায়ের সামনে তাকে হাজির করার একটা সুযোগ পাবো। মায়ের মনে কোন উৎফুল্ল ছিলো না। ছিলো শুধু দুশ্চিন্তা আর শঙ্কা। আমার মনে হল মা আমার খুশিতে জ্বলছে। এমন ভাবতে ভাবতে আমরা নদী পাড়ে চলে এলাম। নদীর পাড় ধরে বহুদূর হেঁটে গেলাম আমরা। কিন্তু তার বাড়িটা আর খুঁজে পেলাম না! আজও খুঁজছি।