সৈত প্রবাহ
শীতের মৃদু বাতাস বইছে বারান্দায়। ভয়ানক এক মোহগ্রস্ততা পেয়ে বসেছে মেয়েটিকে। জাদুকরী এক জোড়া চোখ এখনো তার শরীর ও মনে ক্যামন যেন একটা বিষাদ গ্রস্ততা তৈরী করে রেখেছে – যা তাকে পরিবার, বন্ধু-সজন, কর্ম সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলেছে। বাতাসের তীব্রতা হাড়ে লাগার মতো। কিন্তু আজ ক্যামন যেন সে মৎসকামী করে তুলেছে। মূহুর্তের একটা দৃষ্টি মানুষকে বিস্তৃতির এতো অতলে ঠেলে দিতে পারে তা তার মতো অভিজ্ঞতা না থাকলে কোন মানুষের পক্ষে বুঝা অসম্ভব!
হ্যা। মেয়েটা ভাবছে বহু বছর আগের কোন একটা দিনের কথা। এমনি একটা হিমশীতল মন্ত্রমুগ্ধ সন্ধ্যা। কফি হাউজোর এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা সে যুবক – যার চাহনিতে তার আকাশ ভেঙে পড়েছে তারই পায়ের তলার মাটিতে। যেন সে দুলছে মহাশুন্যেের বায়বীয় পৃথিবীতে। তার চারিদিকে যেন আগুন জ্বলতে জ্বলতে এক সময় জাহান্নামের মত মনে হয়। সে আর বসে থাকতে পারে না। ছুটে যায় যুবকের চলে যাওয়া পথের দিকে।
আজও এমন সৈত প্রবাহ এলে সে আর ঘরে থাকতে পারে না। ছুটে যায় কফি হাউজের শেষ টেবিলে। শীতে যখন হিম শীতল প্রবাহে মনুষ্য প্রজাতি ঘরের চার দেয়ালে ঢুকে যায় উষ্ণতার লোভে। মেয়েটা তখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। উষ্ণতায় তার শরীর কাঁপতে থাকে। কি এক ভয়ানক দাবানল জ্বলতে থাকে তার পৃথিবী জুড়ে। সে ছুটে যায় শহরের শেষ রাস্তা পর্যন্ত।
ছেলে বন্ধুর এতো এতো চেষ্টা তার সব স্মৃতিকে ম্লান করে দেয়। কিছুদিন সে ভুলে থাকে। কিন্তু আবার যখন সৈত প্রবাহ নামে পৃথিবীতে তখনই আগুন জ্বলে উঠে তার মনের গহীনে। অফিস, রাস্তা, ঘর, বারান্দা, লেকের ধার, একাকী পার্ক বা সিনেমা থিয়েটারে, এখনো খুঁজে চলেছে মেয়েটি। সে খুঁজতে থাকে জাদুকরী যুবকের সেই চাহনি। কিন্তু হায় কোথাও মিলে না।
হঠাৎ এক শীতের সকালে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ পড়ে ঝাঁকড়া চুলের এক যুবকের দিকে। লাল চাদর, দাঁড়ি গোপে ঢেকে থাকা মুখ মন্ডল। যুবক হাঁটছে ভয়ানক গতিতে। মেয়েটা তার পিছু পিছু। তার মনে হয় কফি হাউজের সেই যুবক – যাকে সে খুঁজছে জনম জনম ধরে। মেয়েটা শুধু সেই চোখ জোড়া খুঁজছে। কিন্তু পেছন থেকে তার চোখ দেখা যায় না। মেয়েটা তার হাঁটার গতির সাথে পেরে উঠে না। তার মনে হয় রাস্তায় কোন মানুষ নাই। ফুটপাত ধরে যতদূর চোখ যায় ততদুর আগুন জ্বলছে। সে যুবককে তাড়া করার চেষ্টা করে চলেছে কত কাল ধরে সে নিজেও জানে না।
এক সময় তার মনে হয় যুবক নিজের পেছনে মেয়েটার উপস্থিতি টের পেয়ে চলার গতি প্রতিনিয়ত বাড়িয়েই চলছে। মেয়েটাও ছুটছে দিগভ্রান্তের মত। রাস্তার পর রাস্তা। পুটপাতের পর ফুটপাত। শহরের পর শহর। কিন্তু সেই চোখ ধরা দেয় না। হঠাৎ মেয়েটা চমকে উঠে থমকে দাঁড়ায়। মাঝ রাস্তায় একটা ট্রাক এসে চাপা দেয় সেই যুবককে। ঠিক তখনই তার ঘোর কাটে। মৃদু বাতাস। বারান্দায় ধাউ ধাউ করে জ্বলছে আগুন। সে যেন পিউমাসের মতো ভাসছে অথৈ সাগরে। সৈত প্রবাহ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন। সে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। বিকল হয়ে যায় তার সব অনুভূতির যন্ত্র।