- গুড ইভিনিং আঙ্কেল
আমার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই একদিন আমাকে অনুরোধ করে বলেছিল — তোমার যদি কোনও অসুবিধা না থাকে, বিকাল এবং সন্ধ্যা রাত্রিতে তুমি তো ফ্রী-ই থাকো, তা হাতিরপুলে আমার এক আত্মীয়ের একটি বাচ্চা মেয়েকে বাসায় গিয়ে তুমি কী একটু পড়াতে পারবে? মেয়েটি ক্লাস ওয়ানে পড়ে। এ জন্য তুমি ভালো সম্মানীও পাবে।
একটি বাচ্চা মেয়েকে পড়াতে হবে। শুনে খুব ভালো লাগল……. আমারও তো একলা সময় গুলো ভালো কাটতে পারে। আমি তার প্রস্তাবে বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে যাই।
একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার সেই সিনিয়র ভাইটির সাথে হল থেকে হেঁটে হেঁটে চলে যাই হাতিরপুলের সেই বাড়িতে। মেয়েটির বাবা মা বললেন কিছু অদ্ভুত কথা — তাদের মেয়েটির সাথে রোজ সন্ধ্যাবেলা অন্ততঃ এক দেড়ঘন্টা এসে গল্প করতে হবে । গল্পের ছলে একটু পড়িয়ে দিলে হবে। মেয়েটির নাম সঞ্চিতা।
সঞ্চিতা খুব একলা মেয়ে। বাবা মা দুজনে চাকরি করেন। অফিস থেকে ফিরে সঞ্চিতার অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না দুজনেই। ক্লান্ত লাগে। যেমন, হাতি কালো কেন ? আল্লাহকে দেখতে পাই না কেন ? সুমীর মা অত খেতে পারে কি করে? আমার একটি ছোট্ট ভাই নেই কেন? এ একেবারেই যেন রবি ঠাকুরের কাবুলিওয়ালার মিনির ডুপ্লিকেট ।
সঞ্চিতা বলছিল, তুমি কাল থেকে আসবে তো আঙ্কেল?
সঞ্চিতার মা বলে উঠলেন — তুমি নয় সঞ্চিতা, আপনি বলো ওনাকে। সম্মান করে কথা বলতে হয়।
সঞ্চিতা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে……..
আমি সঞ্চিতাকে একটু কাছে ডেকে পাশে বসাই। ওকে বলি — ঠিক আছে, তুমি যা কিছু আমাকে ডেকো এবং বোলো।
এরপর প্রায়ই সন্ধ্যাবেলায় আমি সঞ্চিতাকে পড়াতে যাই, কিংবা ওর সাথে গল্প করতে যাই। সঞ্চিতা রূপকথা শুনতে খুব পছন্দ করত। রোজই কিছু না কিছু আবদার থাকে সঞ্চিতার। ‘আঙ্কেল তুমি সেই মুনিয়া পাখির গল্পটা আরেকবার বলো।’
আমি সঞ্চিতাকে মুনিয়া পাখির গল্প শোনাই—
‘একবার সৃষ্টিকর্তা ঠিক করলেন , সব পাখিদের মনের মতো রং করে দেবেন গায়ে। যে যেমন চাইবে সেরকম রং করা হবে। আবদার মতন, কাককে কালো, বককে সাদা, টিয়াকে সবুজ, ময়ূরকে নীল …. এরকম করে দিচ্ছিলেন। মুনিয়া বারবার ওড়াউড়ি করে দেখছিল আর কত বাকি ? তার লাইন শেষের দিকে। মুনিয়া পাখি ছিল সঞ্চিতার মতো চঞ্চল । ছটফট করতে করতে আবার উড়ে গেল আকাশে । ভাবল একটু ঘুরে আবার আসবে। তারপর ….. তারপর যখন এল তখন দেখল আর কোনই রং নেই। সব পাখিরাই রং পেয়ে গেছে। অল্প একটু রংয়ের ছিটে চারিদিকে পড়ে ছিল। সৃষ্টিকর্তা তাই পাখির পেটের দিকে আর পালকের দিকে একটু একটু রং দিয়ে দিলেন। তাতেও মুনিয়া খুশি। দেখে সে বেশ সুন্দর লাগছে।’
আমি যেন ওকে বেশি করে সুন্দর সুন্দর রূপকথার গল্প শোনাই এ জন্য সে আমাকে প্রায়ই খুশি করত। ক্যাডবেরী চকলেট আমি যে খুব পছন্দ করতাম। এই কথাও জেনে গিয়েছিল সঞ্চিতা। সঞ্চিতা ওর নিজের চকলেটগুলো আমাকে চুপিচুপি খেতে দিত। তাছাড়া, বাগান থেকে ফুল, ঝাউপাতা ছিঁড়ে রাখত আমার জন্য। আমার হাতের মুঠোর ভিতরে ফুল গুঁজে দিয়ে বলত — ‘গুড ইভিনিং আঙ্কেল।’
দিনে দিনে আমি আর সঞ্চিতা কেমন যেন সন্ধ্যাবেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাই। কী এক অদ্ভূত টানে হেঁটে হেঁটে প্রতি সন্ধ্যায় চলে যেতাম। ছোট ভাই-বোনহীন এই শহরে সঞ্চিতাকে খুব আপন করে নেই। আমি সঞ্চিতার ভিতরেও আমার প্রতি একটি নিগুঢ় টান দেখতে পাই। এমন করেই চলে গেল দুই বছর। সঞ্চিতা এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী।
গরমের ছুটিতে সেইবার বাড়িতে চলে আসি। দুই মাস ক্লাস হবে না। বাড়িতে এসে কেমন খালি খালি লাগছিল। মনে হচ্ছিল কী যেন একটি রূপার ছোট্ট পুতুল ঢাকায় ফেলে রেখে এসেছি। সেই পুতুলটি মুনিয়া পাখির মতো। ফুল বাগানের ডালে বিষণ্ন হয়ে হয়ত সে বসে আছে।
ইতোমধ্যে আমার গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হয়ে যায়। আমি ঢাকা চলে আসি। এসেই সন্ধ্যাবেলায় হল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সঞ্চিতাদের বাসায় চলে যাই। বাসায় ঢুকতেই দারোয়ান বলে ওঠে — ‘সঞ্চিতা’রা আর এখানে থাকে না। ওর বাবা মা দু’জনেরই বদলি হয়ে গেছে। ওরা এখন চট্টগ্রামে থাকে।’
মনটা খুবই বিষণ্ন হলো। হাত পা চলছিল না। তবুও আলোছায়ার পথ ধরে হলে চলে আসি।
কয়েকদিন ঠিকমতো ক্লাশে যেতে পারিনি। বালিশে মুখ গুঁজে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম। একটা বাৎসল্য প্রেম এত কষ্ট দেয়, এ বেদনা জীবনে প্রথম বুঝতে পারলাম। মানুষকে ভুলে থাকা যায়, মানুষের মায়া মমতাকে ভুলে থাকা যায় না।
তারপর চলে গেছে তেত্রিশ বছর।
জীবনের মোড়ে মোড়ে কতো কিছু হলো। কতো মানুষ এল। বিয়ে করলাম। আমাদের ঘরেও সঞ্চিতার মতো মেয়ে এল। কিন্তু কবেকার সেই ছোট্ট একটি বালিকা অন্তরের এক কোণে ঠাঁই করে নিয়েছিল। তাকে ভুলতে পারলাম না। ওকে প্রায়শ মনে পড়ত। যে নিতান্তই ক্ষণকালের জন্য ছিল। সেই বহু বিস্মৃত নিষ্পাপ মুখখানি মনে পড়ে বিচলিত হয়ে উঠতাম। না জানি কোথায় সে এখন কতো বড়ো হয়ে আছে! অতটুকুন মেয়ে কী আমাকে মনে রেখেছে?
একদিন অনেকটা আলস্যে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করে করে দেখছিলাম। হঠাৎ কোনো এক সঞ্চিতার একটি স্টাটাস চোখে পড়ল —
‘ আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের বাসা ছিল ঢাকার হাতিরপুলে। কবি জসীম উদ্দিন হল থেকে একটি ছেলে এসে আমাকে পড়াত। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। তাকে আমি আঙ্কেল ডাকতাম। নাম রঞ্জন রহমান। কেউ কী তাঁর কোনও খোঁজ দিতে পারেন?’
হঠাৎ কোনও বড় পাওয়ার আনন্দে কেঁপে উঠল অন্তরআত্মা। বহুদিনের লুপ্ত হয়ে থাকা স্নেহের ফল্গুধারা আজও দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল।
~ কোয়েল তালুকদার