চিরদিনের কিছু নেই
এ জগতে চিরদিনের বলে কিছু নেই। সবই ক্ষণকালের। সবই মায়া। সবই মরীচিকা।
জীবনের এক একাকীত্বের সময়ে মিলা’র সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। কথা বলতে বলতে জেনে গিয়েছিলাম সেও প্রবঞ্চিতাদের একজন ছিল । পৃথিবী তাকেও গ্রহণ করতে চায়নি। আমি দেখেছি, এই জীবন পারাপারের খেয়ায় একই নৌকার যাত্রী হতে হয়েছে আমাকেও বারেবারে। এমনি প্রবঞ্চিত মানুষদের সাথে আমাকেও একই খেয়ায় পাড়ি দিতে হয়েছে।
প্রায়ই মনে হতো, কোনো একটি লোকাল ট্রেনে উঠে চলছি অজানায়। কতো স্টেশনে কতো মানুষ উঠল আর নামল। কোথাও নামা হলো না আমার। শেষ স্টেশনে যেয়ে ট্রেনটি একসময় থেমে যায়। সব মানুষ নেমে গেল। কেউ আর উঠল না। একাকী বসে আছি কামরায়। কেউ বলল না, তুমি নামো। পথ শেষ। সামনে আর পথ নেই।
মিলা আমার পথের সাথী হয়েছিল। সে আমার হাত ধরেছিল পরম বিশ্বাসে। আমারও মনে হয়েছিল, এই হাত ধরেনি জীবনে অন্য কোনো পুরুষের হাত? এই চোখ চেয়ে থাকেনি অন্য কারোর মায়াময় চোখের দিকে অপলক, এই মঞ্জলী ঠোঁট চুম্বন করেনি কোনো অবিশ্বাসী ঠোঁটে। বুকে আঁচর নেই অসভ্য নখের। কোনো বসন্ত বাতাসে এলমেল হয়ে থাকা চুল কেউ যেন পরিপাটি করে দেয়নি কোনদিন!
বনে বনে কত পাখি ডাকতে লাগল। নীল আকাশ ক্ষণে ক্ষণে বদলিয়ে কতো রঙের হলো। বাগানে বাগানে ফুল ফুটে উঠল। যেন মরা গাঙে জোয়ার এল।
মিলার সাথে ছোট ছোট অভিমান হতো, ঝগড়া হতো, খুনসুটি হতো। কত প্রতিশ্রুতি হতো দুজনের মধ্যে। বলতাম, আমার ভূবন থেকে তুমি কখনও চলে যাবে না। মিলা বলত — ‘ঐ যে তুমি বালু নদীর জল দেখছ, ঐ জলের মতো তুমি স্বচ্ছ আমার জীবনে।’ হারানো সুর সিনেমার মতো গীতা দত্ত হয়ে গান গাইত –‘ তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার।’
কোথা থেকে শীতল হাওয়া আসত। মিলার চুল এসে কপালে পড়ত, ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতাম, ‘ওগো তুমি যে আমার। চিরকালের তুমি আমার। চিরদিনের তুমি আমার।’
এই পৃথিবীতে সব কিছু ক্ষণকালের। এই যে বহমান শীতল হাওয়া, এমন করে বইবে না আর কখনও। এই যে সৌরমণ্ডলে এত তারা জ্বলছে, সব তারাই একসাথে কী আর জ্বলে উঠবে কখনও? সব মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে না। তুলো হয়ে উড়ে চলে যায়।
পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের মতো মানুষের মনও বড়ই বিচিত্র। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের মাঝেই কখন আকাশ জুড়ে কালো মেঘ হয়। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামে। চরাচর ভেসে যায় জলে। যে মিলা শক্ত করে আমার হাত ধরে থাকত, সেই হাত কেমন যেন শিথিল হতে থাকে। দিন দিন সে দূরে সরতে থাকে। আমি এসবের কোনো মানেই বুঝতাম না। বুঝতাম না তার দ্বিধা কী ? বুঝতাম না তার প্রেম কী রূপ।
মিলা একদিন বলেছিল, আমাকে তুমি মুক্তি দাও। আমাকে তুমি আর ধরে রেখো না। মায়া কোরো না। আমাকে ঘৃণা দাও।
আমি মানুষের মুক্তির গল্প লিখি। কতো রাত্রি জেগে কতো অসীমে খুঁজি জীবনের জয়গান। কখন যে কোন্ কাহিনী নিজের জীবনের হয়ে যায়। বুঝতে পারি না। আমি মিলাকে মুক্তি দিয়েছিলাম আমার জীবন থেকে। যখন সে এসেছিল জীবনে, তখন তার অতীত নিয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি, আজ যখন চলে যেতে চাইছে, তখনও বলিনি — ‘কোথায় তুমি যাবে? কে তোমার ভালোবাসা।’
মনের ভিতর একটাই প্রতিতী, চিরদিনের বলতে এই জগতে কিছু নেই। হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনা, ঘৃণা ও ভালোবাসা কোনটাই না।
একদিন সব আলো নিভে দিয়ে শুয়ে আছি। হোয়াটসএ্যাপে সংকেত এল — দেখি একটি টেক্সট —
‘ কী! খুব নিঃসঙ্গ লাগছে মনে হয়! আমি জয়িতা, তোমার একাকীত্বে আমাকে চিরদিনের সাথী করে নেবে কী?’
রিপ্লাই দিলাম–
‘ না। নেবো না। এই পৃথিবীতে চিরদিনের বলে কিছু নেই। সব মিথ্যা, সব মায়া মরিচীকা।