বিগলিত জোছনা
একটি ব্যবসায়িক কাজ সেরে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকা ফিরছিলাম । আখাউড়া জংশনে এসে ট্রেনটি যে থেমে রইল, ঢাকার দিকে আর আসছিল না। জানা গেল ভৈরব ব্রিজের কাছে লাইনের রিপিয়ারিং-এর কাজ চলছে। ট্রেন ছাড়তে এক-দুই ঘণ্টা দেরি হবে।
আমি কামরা থেকে নেমে প্লাটফর্মের উপর হাঁটতে থাকি এলমেল। একসময় হেঁটে পূর্ব দিকে শেষ মাথা পর্যন্ত চলে যাই। সেখানে একটি টং চার দোকান দেখতে পাই। কাঠের বেঞ্চটা খালি। কেউ নেই। আমি ওখানে বসে চা খেতে থাকি। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরাই। ঠিক তখনই একটি লোক এসে বেঞ্চে বসে। সেও চার অর্ডার দেয়। লোকটি আমাকেও চা অফার করে। আমি বলি, খেয়েছি। ধন্যবাদ।
লোকটিও সিগারেট খায়। আমাকেও সিগারেট অফার করে। আমি এবার সিগারেট নেই। যদিও একটু আগে একটি খেয়ে শেষ করেছি। সিগারেট পরপর তিন-চারটা স্টিক পর্যন্ত খাওয়া যায়। এইরকম এর আগে বহু খেয়েছি।
লোকটা আগ বাড়িয়ে একটু বেশি কথাই বলছিল। সে বলছিল — আপনার বাড়ি কোথায়? কী করেন? বললাম — ময়মনসিংহের গৌরিপুর। ব্যবসা করি। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করেনি ওনার বাড়ি কোথায়? তবুও জেনেছিলাম — ওনার বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন।
আমাকে বলছিল — আপনি বিয়ে করেছেন কোথায়? বললাম — ময়মনসিংহ শহরে। বলছিল — আপনার স্ত্রীর নাম কী? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম — আফসানা মরিয়ম।
লোকটার সাথে প্রায় আধাঘন্টা এলমেল বিভিন্ন কথা হয়। ইতোমধ্যে ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। হয়তো লাইনের রিপিয়ারিং কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি লোকটিকে বললাম — আপনি কোথায় নামবেন?
উনি বললেন — ভৈরব জংশন ।
প্লাটফর্মের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উনি যে কথাটি বললেন — আপনার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। আমি থাকি– অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটিতে। এদেশে আর কখনও আসব না। বাবা-মার কবর জিয়ারত করতে এসেছিলাম। বাকী জীবনকাল ওখানেই ঐ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ইয়ারা নদীর পাড়ে নির্জন কুটিরে কাটিয়ে দেব।
আমি বললাম — আপনি তো বিয়ে করেননি এখনও। কোনও বন্ধন নেই আপনার। যখন তখন এ দেশে আসতে পারেন তো ।
— নাহ্, আসব না আর।
যাবার বেলায় উনি আমাকে একটি অনুরোধ করলেন। বললেন — আপনি একবার হলেও আপনার স্ত্রীকে নিয়ে কোন শীত মৌসুমে সিলেটের জাফলং এ বেড়াতে যাবেন। ওখানে পিয়াইন নদীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর, বালি আর নুড়ির উপর দিয়ে হাঁটবেন। দেখবেন পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলধারা। কী অদ্ভুত রূপালী রং তার ! যদি আপনার স্ত্রী পা ফসকে পড়ে যায়, আপনি ওনার হাতটি ধরবেন। আর সময়টা যেন হয় পূর্ণিমা তিথি। রাতের নিরিবিলিতে দেখতে পাবেন সেখানে — দূরে পাহাড়ের গায়ে অপরূপ চাঁদের আলোর বন্যা বইছে। শুনবেন কান পেতে — পাহাড় আর রাত্রি কীভাবে কথা বলে। রাতের নির্জনতায় আরও শুনবেন ঝর্নার জলপতনের শব্দ! আপনি একা শুনবেন না, আপনার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে শুনবেন। বুঝতে পারবেন — এমন একটি রাত পেলে সারা জীবনকালে আর কোনকিছু পেতে ইচ্ছে করবে না। মানুষের জীবনে কিছু আনন্দময় ক্ষণ আসে, তা ক্ষুদ্র সময়ের জন্য হলেও সারাজীবনকাল চিত্তকে সেই মধুক্ষণ রোমন্থন করে সুখ-আনন্দে ভরে রাখা যায়।
এবার কেন জানি ভদ্রলোকটি সম্বন্ধে আরও বেশি কিছু জানতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু হাতে সময় ছিল না। উনি দ্রুত হেঁটে গিয়ে ওনার কামরায় গিয়ে উঠে পড়লেন। শেষ মুহূর্তে শুধু ওনার নামটি জেনেছিলাম – মনজুর হোসেন খোকন।
*** *** *** ***
বছরখানেক পর ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে আমাকে সিলেট যেতে হয়। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম- আমার সাথে সিলেট যেতে। ও প্রথমে রাজি হলো না। পরে আমার অনুরোধে রাজি হয়। তখন ছিল পৌষের শীতের সময়। পঞ্জিকা খুলে দেখলাম চাঁদের শুক্ল পক্ষ। ত্রয়োদশী হবে। আমরা রাতের ট্রেনে সিলেট চলে যাই। ঢাকা থেকেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। সিলেট শহরে একরাত থাকি। ব্যাবসায়িক কাজ সেরে পরের দিন জাফলং চলে যাই। সিলেটে আমার ব্যবসায়িক বন্ধু আগে থেকেই গোয়াইনঘাটের তামাবিলে যাবার জন্য একটি গাড়ি ও ডাকবাংলোতে থাকার জন্য রুম ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
ভোরেই আমাদের গাড়িটি সিলেট শহর থেকে জাফলং-এর উদ্দেশ্যে বের হয়। পথের ধারে বন-বনানী ও অজস্র বৃক্ষের সমারোহ। রাস্তাটি উঁচুনিচু টিলা ও ছোট ছোট পাহাড়ি ঢালু ধরনের। খুব ভালো লাগছিল জার্নিটা। অনেক দিন পর মনে হলো আমরা দুজন নতুন করে মধুচন্দ্রিমায় ছুটেছি। গাড়ির চালক একটি গান ছেড়েছে–
গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর হলো না
মরমে রাঙ্গা পাখি উড়ে সে গেলো নাকি
সে কথা জানা হলো না।
আমরা দুপুরের অনেক আগেই ডাকবাংলোতে যেয়ে পৌঁছি। বাংলাটি উঁচু একটি টিলার উপর অবস্থিত। বাংলো থেকে ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের জৈন্তা পাহাড় দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে থেকে ঝর্নার জল গড়িয়ে পড়ছে। নীচে নদীটা অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না। আমার সকল আকুতি এই নদীটি ঘিরে। কখন দেখব ওকে! কখন দেখব ওর রুপোলী জল!
ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে। আমি ওনাকে বললাম, আমরা একরাতই এখানে থাকব। এখানেই খাব। আপনি সেইভাবেই সব ব্যবস্থা করবেন।
পড়ন্ত বিকালে আমরা পিয়াইন নদীর তীরে চলে যাই। আফসানা একটি নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে। ম্যাচিং করে কপালের টিপ, পাথর বসানো দুল, হাতের চুড়ি, গলার মালা, চুলের ক্লীপ, নীল জুতো, লিপস্টিক ও নোখে নেইলপালিশ পরে। কী যে অপরূপ লাগছিল ওকে। হেনকালে যদি চণ্ডীদাসের দেখা মিলতো, তবে নতুন করে তিনি পদ লিখতেন — চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিতে মোর।
এর আগে কত মধুময় ক্ষণে কত দেখেছি ওকে, কিন্তু আজকের এই পিয়াইন নদীর তীরে ওকে এমন রূপে দেখব, তা ভাবিনি কখনও। ও যেন হেম-কান্তি ও নীলকান্তিতে আচ্ছাদিত এক মনময়ূরী! খোঁপায় নীল অপরাজিতার গুচ্ছ, আধ-কপালের চন্দনবিন্দুতে আফসান মিশানো! গলায় খাসিয়া এক মেয়ের কাছে থেকে নিয়ে পরেছে বনফুলের মালা। এ যেন চিরপিপাসিত কোনও প্রকৃতি-পুরুষের সাথে তার আনন্দময় মিলন হবে আজ।
আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে নদীর পাথুরে চরের দিকে চলে যাই। সিলিকন বালির সাথে হাজার হাজার ছোট বড় বিভিন্ন রঙিন পাথরে ভরে আছে। পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জল! আফসানা জুতো খুলে ব্যাগে রাখে। আমার জুতোও খুলে ফেলি। পাথর, বালি ও নুড়ির উপর দিয়ে, জলে পা ভিজিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটার সময় হঠাৎ পা ফসকে আফসানা পাথরের উপর পড়ে যায়। আমি খেয়াল করিনি। আমাকে অবশ্য খোকন সাহেব সতর্ক করে দিয়েছিল ওর হাতটি ধরে রাখতে। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম হাতটি ধরতে ।
আফসানা পায়ে বেশ ব্যথা পায়। আমি ওর হাতটি ধরি। ও খুব মনখারাপ করে বলছিল — ভেবেছিলাম, তুমি আমার হাত ধরে থাকবে ! তা ধরে রাখনি। তুমি এমনই উদাসীন আমার উপর! অন্য কেউ হলে ঠিকই আমার হাত ধরে রাখতো।
আমি আফসানার হাত ধরে আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে উঠে আসি। পিয়াইন নদীতে আর বেড়ানো হলো না। আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে আসি।
আফসানা পায়ে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছিল। বাংলোর কেয়ারটেকার আমির আলীকে দিয়ে ফার্মেসী থেকে অয়েন্টমেন্ট ও ব্যথার ঔষধ আনিয়ে নেই। সারা বিকাল ও সন্ধ্যায় কোথাও আর যাওয়া হলো না। বাংলোতেই সন্ধ্যা নামে। এবং রাত হয়। পিছনে সুপারি ও নারিকেল গাছে অজস্র বাদুড়ের কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অদূরে খাসিয়া পুঞ্জিতে মিটমিট করে জ্বলে থাকা আলোগুলো একে একে একসময় নিভে যায়।
আমির আলী আমাদের রাতের খাবার খাওয়ায়ে চলে যায় বাংলোর পিছনে ওর থাকার ঘরটিতে। যাবার সময় বারান্দায় দুটো চেয়ার পেতে রেখে যায় এবং বলে যায় — আপনারা যদি রাতে এখানে বসতে চান তবে বসতে পারবেন।
সন্ধ্যার পর থেকে দুজন খাটের উপরই শুয়ে বসে ছিলাম। একসময় রাত অনেক হয়ে যায়। চোখে কারোরই ঘুম আসছিল না। আফসানা কেমন চুপচাপ ছিল । তেমন কোনও কথা বলছিল না। আমি ওকে বলি– চলো একটু বাইরে যাই। বাইরের রাত দেখি। আফসানা বললো – চলো।
আমি আফসানাকে পাজরে জড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় চলে যাই। দরজা খুলেই দূরে দেখতে পাই পাহাড়ের উপর প্রকাণ্ড একটি চাঁদ উঠেছে। এমন রাক্ষুসে চাঁদ এর আগে কখনও দেখিনি। কমলা রঙের জোছনায় ভেসে গেছে পাহাড়ের শরীর, গাছগাছালি ও বনবৃক্ষ। বিগলিত জোছনার রোশনি আমাদের চোখে মুখে এসে লাগে। হঠাৎ কেমন এক অদ্ভুত জগৎ তৈরি হলো। নিস্তব্ধতার ভিতর ঝর্নার জলপতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জলের শব্দ, রাতের শব্দ, আঁধারের শব্দ, জোছনার ধারা — সব মিলে এক মায়াবী আবেশে ভরে উঠলো মন। তখন পাহাড় আর আকাশ পেরিয়ে ম্লান লালিমা মুছে গেছে আধো অন্ধকারে। সব লালিমা বিস্তৃত কালো রঙা গালিচা হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
আফসানা বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। ও কেমন যেন আরও চুপ হয়ে গেল। আমার মতো বিস্ময় ওর ভিতর নেই। মনে হলো এইরকম বিস্ময়কর দৃশ্য এর আগে ও দেখেছে। আমি আফসানাকে ডাকি- এই। ও বলে– জী, বলো।
— এই চাঁদ এই জোছনা, দূরের ঐ পাহাড় ও নক্ষত্ররাজি তোমার ভালো লাগছে না?
— ভালো লাগছে।
— তবে এমন মনখারাপ করে আছো কেন?
— কই না তো!
আফসানা আমাকে বলে — আমি কী তোমার কাঁধের উপর একটু মাথা রাখতে পারি?
বললাম — রাখো।
আফসানা আমার কাঁধের উপর ওর মাথা রাখে। এবং বলে — আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
বললাম — কেন?
আফসানা ওর একটি হাত আমার হাতটিকে শক্ত করে ধরে বলে — এমন রাত, এমন জোছনা, এমন আলো আঁধার যদি চিরকালের জন্য চির আঁধার হয়ে যায়! যদি তোমাকেও আমি হারিয়ে ফেলি?
দেখি– আফসানা কাঁদছে। বললাম — কেন এমন ভয় তোমার? কেন তুমি কাঁদছ?
আফসানা বলে — আজ এই রাতের নির্জনতার সামনে বসে — তোমাকে কোনও মিথ্যা বলতে পারব না৷ আজ থেকে নয় বছর আগে একটি উন্মূল তরুণ এই জায়গায় এমনই পাহাড়ের পাদদেশে, এমনই চাঁদের রাতে আমাকে বলেছিল — আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তাকে আমি প্রত্যাখান করেছিলাম। ছেলেটি আমার সহপাঠী ছিল। ভালো গান গাইতো। গানও লিখতো। সুরও দিতো। ছেলেটির নাম ছিল মনজুর হোসেন খোকন। সেইবার ময়মনসিংহ আমাদের কলেজ থেকে একদল ছাত্র ছাত্রী শিক্ষাসফরে এই জাফলং-এ এসেছিলাম।
আমি বললাম — তো কী হয়েছে? এমন ঘটনা অনেক মানুষের জীবনেই আছে। তোমারও যেমন আছে, আমারও আছে। এই সমস্ত ঘটনাগুলো আমাদের সংসার জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলে না। আমরা আমাদের প্রতিদিনের ঘর সংসার করে য়াই সুন্দর মতো। তবে মাঝে মাঝে তাদের কথা মনে পড়ে হৃদয় যে উদ্বেলিত হয়না, তা নয়। কখনও কখনও অশ্রুও ঝরে পড়ে। কিন্তু তাতে সংসারে অমঙ্গলের ছায়া পড়ে না একটুও।
আমি আফসানাকে বলি — তারপর কী হয়েছিল?
— ছেলেটি তারপর আর কখনও কলেজে আসে নাই। সেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল — ওর আর খবর পাইনি। আমিও কোনো খবর নিইনি। ওকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ এই রাত, এই চাঁদ, দূরের ঐ পাহাড়, পাথুরের পিয়াইন নদী, ঐ ঝর্নার জল, তারার এই আকাশ দেখে ওকে খুব মনে পড়ছিল । তুমি বিশ্বাস করো– মনে হয়েছিল ঠিকই। তা চোখের জল ঝরিয়ে শেষ করে দিয়েছি। আর কান্না হবে না।
আমরা পিয়াইন নদীর তীরে সেই দিনের সেই রাত, সেই চাঁদ, পাহাড়ের গায়ে সেই জোছনার সৌন্দর্যকে ব্যর্থ হতে দিইনি। আমরা ভেসেছিলাম বিগলিত জোছনায়। আমরা মিশেছিলাম শুভ্র স্বেদে ভালোবেসে অপার মাধুরিতে।
— কোয়েল তালুকদার