নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে যেদিন আমি চলে আসি, উঠোনে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল — ‘কয়েক দিনের জন্য হলেও তোমার কাছে আমাকে একবার নিয়ে যেও। আমি তোমার ঘরটি গুছিয়ে দিয়ে আসব।’ আমি কিছু বলিনি। একটি টিনের বাক্স হাতে করে হাঁটতে হাঁটতে স্টীমার ঘাটের দিকে চলে এসেছিলাম। বয়রা ঘাট থেকে ভেঁপু বাজিয়ে স্টীমার ছেড়ে আসে। আমি অন্ধকারে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে যমুনার জলে তার বিষণ্ণ চোখের ছায়া খুঁজেছিলাম। তার চোখ দেখতে পাইনি সেদিন। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ভিতরে শুধু তার কান্না শুনেছিলাম।
মাসখানেক পর পরমাপত্নী রনিজাকে একটি পত্র লিখি।
কল্যাণীয়াষু,
বাড়বকুণ্ডে একটি চটকলে অস্থায়ী চাকুরী পাইয়াছি। বেতন খুবই সামান্য। চটকল থেকে দূরে পাহাড়ি টিলার ঢালে ছোট একটি টিনের কামরা ভাড়া নিয়াছি। কাঠের চৌকি কিনিয়াছি। চৌকির উপরে তোমার দেওয়া কাঁথা বিছাইয়া নিয়াছি। হাঁড়ি পাতিলও কিনিয়াছি। আমি নিজেই রান্না করিয়া খাই।
তোমাকে খুব মনে পড়ে। আমি সামনের মাসে বেতন পাইয়া বাড়িতে যাইব, এবং তোমাকে কয়েক দিনের জন্য এখানে লইয়া আসিব। আমি যেখানে থাকি — সেখান হইতে সাগর দেখা যায়। তুমি এখানে যখন আসিবে, তখন তোমাকে লইয়া সাগর পাড়ে বেড়াইতে যাইব। শরীরের প্রতি খেয়াল রাখিও। ইতি — তোমার রঞ্জন।
পরের মাসে আমি রনিজাকে এখানে নিয়ে আসি। একমাস সে থাকবে। তারপর ওকে আবার আমাদের কুসুমপুর গ্রামে রেখে আসব। আমার ছোট্ট ঘর রনিজার কী আর গোছাবার আছে? আমিই গুছিয়ে নিয়েছি। ছোট্ট একজনের চৌকি। থাকি দুইজনে। পাশাপাশি শুইলে রনিজার নিঃশ্বাস লাগে আমার চোখে মুখে। গায়ের সাথে গা ঠেসাঠেসি হয়ে থাকে। ঘুম আসে না। রনিজাকে বলি– ‘আমার ঘুমাইতে অসুবিধা হইতেছে।’
রনিজা আমার বুকে মাথা রেখে করুণ করে বলে— ‘একটি মাস না হয় ঠিকমতো ঘুমালে না। তোমার বুকের ভিতর আমি মুখ লুকিয়ে রাখি। আমার বুক ছুঁয়ে থাকে তোমার শরীরের সাথে। আমার কী যে শান্তি লাগে। আমার এমন ঘুমহীন হয়ে সারা জীবন থাকতে ইচ্ছা করে।’
আমি মনে মনে একটু বিরক্ত হই। বুঝতে দিই না ওকে। সারাদিনের চটকলে পরিশ্রমের ক্লান্তি থাকে। অবসাদ আসে শরীরে। ঘুম আসে চোখে। রনিজার চোখ দুটো আমার চোখের সাথে লেগে থাকে। আমি দেখি ওর বিষণ্ণ চোখ। কী যে মায়া লাগে। ঐ চোখের দিকে চেয়ে থাকলে, ঘুমের চোখে আর ঘুম আসে না।
দিনগুলি আমার চলছিল ভালোই। আমার রান্না করতে হয় না, কাপড় ধুতে হয় না। নিজ হাতে মশারি টানাতে হয় না। একদিন রনিজা বলছিল — ‘আমি তোমার এখানে এলাম। আর তুমি কি না একদিনও ছুটি পেলে না। ছুটির দিনে ওভার টাইম করো। রাতে ফেরো। তুমি পত্রে লিখেছিলে– আমাকে সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে। কই, নিয়ে গেলে না তো? আমাকে নিয়ে যাবে গো! সমুদ্র দেখাতে?’ আমি রনিজাকে সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় পাইনি।
খুব তাড়াতাড়ি দিন গুলো শেষ হয়ে যায়। সেদিন ছিল আমার এই টিনের ঘরে রনিজার শেষ রাত। ছোট চৌকিতে দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। আজও ওর নিঃশ্বাস লাগছিল আমার চোখে মুখে। আজকের নিঃশ্বাসের বেগটা একটু বেশি মনে হচ্ছিল। রনিজা দুঃখ করে বলছিল — ‘এরপর থেকে তোমার আর ঘুমুতে অসুবিধা হবে না। আমি চলে যাব, থাকব না। তোমার সুন্দর ঘুম হবে।’
পরের দিনই বাড়বকুণ্ড স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠি। কত স্টেশন পার হই। কত রেলপথ। ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলতে থাকে। তারপর যমুনা নদী পারি দেই স্টীমারে। কত জল ঠেলে স্টীমার চলে আসে। বয়রা ঘাট থেকে কত মাঠ, কত মেঠো পথ পেরিয়ে রনিজাকে আমি কুসুমপুর গ্রামে রেখে আসি।
বাড়বকুণ্ডে আমার এই ছোট্ট টিনের কামরায় এখন একাই থাকি। সারা বিছানা জুড়ে কী সুন্দর আরামে শুয়ে থাকি। চোখে ভাল ঘুম আসার কথা। কিন্তু ঘুম আসে না। বালিশ থেকে ওর চুলের গন্ধ পাই। কভারে কাজলের দাগ। ওর চোখের অশ্রুর ফোঁটাগুলোও কাজলের দাগের সাথে মিশে আছে। আলো নিভিয়ে দিই। জানালা দিয়ে অন্ধকারে দূরের পাহাড় দেখি। নির্জন আকাশে দেখতে পাই নির্জিব তারা। ঘুম আসে না। রাত ফুরিয়ে যায়।
ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে দূরের সমুদ্র দেখতে পাই। কানে বাজে একটি আক্ষেপ। ‘আমাকে তুমি সমুদ্র দেখাতে নিয়ে গেলে না।’ যদি কখনও আবার রনিজাকে এখানে নিয়ে আসি, ওকে নিয়ে সত্যি একদিন সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে নিয়ে যাব।
তারপর এই বাড়বকুন্ডে কত রোদ্দুর উঠেছে। কত বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির মেঘে অন্ধকার হয়ে এসেছে পাহাড়ী টিলার আঙিনায়। অবহিত শরীরের ঝিমন্ত ঘুম ছড়িয়ে পড়েছে বিছানার উপরে। আবার নোনা ধরা জানালার লোহার শিক ছুঁয়ে কখনও ঢুকে পড়েছে হুহু বাতাসের মন খারাপিয়া বিবাগী স্পর্শ।
বাড়বকুন্ডে এরপর যতদিন ছিলাম, আমি কখনই আর ঠিক মত ঘুমুতে পারিনি।
~ কোয়েল তালুকদার