মাধবী এসেছিল
দক্ষিণ দুয়ারে বসেছিলাম এক শরৎ সন্ধ্যায়। চোখের সামনে রাত নামতে থাকে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। এমন করে একসাথে এত তারা দেখিনি কখনও। এ যেন ‘হীরা মুক্তা মানিক্যের ঘটা, যেন ইন্দজাল ইন্দ্রধনুর ছ্বটা।’
যেখানে বসেছিলাম পাশেই ছিল হাস্নাহেনার ঝাড়। কে যেন পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল সুবাস নিয়ে। এ কোন্ দিগবালিকা। যাকে আমি দেখেছিলাম আমার প্রথম স্বপ্ন প্রহরে। হাস্নাহেনার সকল মাধুরী সে ছড়িয়ে রেখে গেল চারদিকে। দূর থেকে নয়, কাছে যেয়ে তাকে চিনলাম, এ যে আমার সেই মাধবী।
সন্ধ্যাও উতলা হয় তার নীল শাড়ির হাওয়ার টানে
বাতাসে বাজে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ
পাখিদের গান সব থেমে গেছে রাতের আঁধারে
ভালোবাসার সুর খুঁজি মাধবীর বুকের খাঁজে
আমি তার চোখের দিকে চেয়ে থাকি
আমি তার মুখচ্ছবিতে দেখি জীবনের ছবি।
চারুকলা কলেজের আর্ট গ্যালারিতে সেবার শিল্পী শাহাবুদ্দীনের একক চিত্র প্রদর্শনী চলছিল। একদিন বিকেলে ইউনিভার্সিটির হল থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম এই প্রদর্শনী দেখতে। গ্যালারিতে শাহাবুদ্দিনের শিল্প কর্মগুলো দেখতে দেখতে একটি ছবির দিকে আমার চোখ আটকে যায়। এটি ছিল একটি পেইন্টিং। একজন রমণীর বিমূর্ত ছবি। মেয়েটির মুখ দেখা যায় না। শুধু পিছনের প্রোফাইল। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক সৈন্য কর্তৃক ধর্ষিতা এক রমণীর ছবি।
চারুকলার গ্যালারিতে ছবি দেখতে দেখতে একটি মেয়ে আমার মতোই থমকে দাঁড়ায় এসে এই ছবিটির পাশে। সেও চেয়ে দেখছিল শাহাবুদ্দীনের শিল্প কর্মটি। মেয়েটিকে একটু দেখলাম। কি অদ্ভুত সুন্দরে ছেয়ে আছে ওর শরীরে। ঈশ্বর কখন কাকে তৈরি করে তার উদাস মুহূর্তে, শিল্পীর মুগ্ধ করা কালির অাঁচরে। কেউ বলতে পারে না। গ্যালারির শেষ ছবিটি দেখে আমি যখন বাইরে মন্তব়্য খাতার পাশে এসে দাঁড়াই। দেখি, সেই মেয়েটিও সন্তর্পণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কমেন্ট বুকে লিখেছিলাম — ”আমাদের নেই পাবলো পিকাসো, আমাদের নেই ভিনসেন্ট ভ্যানগগ, কিংবা যামিনী রায়। আমাদের আছে জয়নুল, আমাদের আছে শাহাবুদ্দিন, আছে সুলতান। এনসাইক্লোপিডিয়া ঘাঁটতে যেয়ে একদিন বিস্ময় চোখে দেখেছিলাম এ্যামেদিও মদিজিয়ালিনীর ‘Nude sitting on a Divan’ তার চেয়ে বড়ো বিস্ময়ে আজ দেখলাম, শাহাবুদ্দিনের নান্দনিক শিল্পকর্ম গুলি।” তারপর নীচে আমার নাম ও ঠিকানা লিখি।
আমি কমেন্ট টেবিল ছেড়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি চারুকলার বারান্দা ধরে সামনের দিকে। মেয়েটি কমেন্ট টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, কি হয়ত লিখতে চেয়েছিল, কিন্তু লিখেনি। সে দ্রুত আমার পাশে চলে আসে। এবং বলে — ‘ আপনাকে আমি খুঁজছি অনেকদিন ধরে। ‘
আমি : আমাকে আপনি জানেন কিভাবে?
মেয়েটি : আপনি জানেন না, কিভাবে আপনাকে আমি জানতে পারি? সেই কবে থেকে আপনাকে চিনি আপনার কবিতায়। কত ছন্দ মিলিয়েছি আপনার গানের কথার সাথে। সেই থেকে বড়ো ইচ্ছা ছিল আপনাকে একবার দেখার। আজ আপনাকে দেখলাম।
আমি : আপনার নাম কি?
মেয়েটি : মাধবী।
এখান থেকে শুরু মাধবী পর্ব আমার জীবনে। নারিন্দা ওদের বাড়ি। সে ছিল হোম ইকোনোমিক্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। মাধবীকে ভালো লাগত আমার! মাথা ভর্তি কালো চুল! যার হাসিতে ভূবন জুড়ে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ত। চোখ ছিল পদ্মরাগের সৌন্দর্যের মতো মায়া ভরা। হঠাৎ অপলকে চোখ বিঁধে যেত সুরভিত বুকের খাঁজে। পদাবলীর ছন্দের মতো ছোট ছোট পা উঠিয়ে সে হাঁটত। ভ্রু যুগলের মধ্যিখানে অপরাজিতা রঙের টিপ্ পরত। হেনা স্যারের কবিতায় পড়েছিলাম — কমলা কোয়ার মতো তার ঠোঁট। কেমন যেন মাধুকরী রূপ ছিল মাধবীর।
আমার প্রথম স্বপ্ন গাঁথা মাধবী। একদিন রাত্রে পূরবীর দ্বারে বসেছিলাম বিহঙ্গের মতো আকাশের পানে —
সেখানে ধ্রুবতারা ছিল না, নিথর আঁধারে বসে ভাবনাগুলো ছিল আমার। ভাবছিলাম একি হচ্ছে জীবনের। প্রেম আমার। বিষণ্নতাও আমার। বিপণ্নতা যা আসে তাও আমার। যদি পরাজয় হয় ভালোবাসা — সেই গ্লানিও আমার। আমি মনে মনে মাধবীকে বলি –‘তুমি রাখো নাই কোনো সীমানা, নীল আকাশ আর নীলিমা তুমি এক করে দিলে।’
সলিমুল্লাহ হলের সামনের রাস্তার ফুটপাত ধরে রেইন ট্রির ছায়াতল দিয়ে হাঁটছিলাম আমি আর মাধবী। সেদিন দুপুরে বসন্তের রুক্ষ বাতাস ছিল। ভ্রান্ত নাকি উদ্ভ্রান্ত লাগছিল নিজকে, জানিনা। মাধবী বলছিল — ‘চলো যেয়ে বসে থাকি, অন্য কোনো ছায়াতলে।’ আমি বললাম, আমার খুব খিদে লেগেছে। আগে খাব।
মাধবী : তুমি যে খাবে, তোমার পকেট তো রেসকোর্স ময়দান।
আমি : তোমার অঞ্চলে বাঁধা আছে দৌলত।
মাধবী : তো কোথায় যাবে ?
আমি : মেডিক্যাল ক্যান্টিনে।
সেদিনের সেই বিকেল কেটেছিল রমনার নাগলিঙ্গমের ছায়াতলে। এক দুই তিন চার করে মুহূর্তগুলো পার হচ্ছিল লেকের ছোট ছোট ঢেউ তুলে। মাধবীর হাত নিয়ে নোখের গোলাপি রং তুলে ফেলেছিলাম আমার নোখের খোঁচায়। ওকে বলি, একদিন আফসানা লাগিয়ে আসো শাড়ির আঁচলে, একদিন হাতে পরবে রেশমি চূড়ি। একদিন দেবে চোখে কাজল। আর একদিন পরবে কাঁঠালি চাঁপার মালা তোমার খোঁপায়। মাধবী সেদিন মাথা নেড়ে আর মুখে হ্যাঁ বলে সম্মতি দিচ্ছিল আমার সব কথার। সন্ধ্যা নেমে আসছিল তখন। মাধবীর কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে বলছিলাম —
আমার দিনলিপিতে তোমার ছায়া পড়ে থাকে। মগ্ন চৈতণ্যে তোমার রহস্য জড়িয়ে থাকে। বেলাশেষের ভালোবাসা মিলিয়ে যায় সূবর্ণরেখায়। তোমাকে নিয়ে উৎসব করব, তাই যোগাড় করি কড়ি। নীলকন্ঠ পাখি উড়ে ধূসর আকাশে। তুমি অন্তবিহীন ভালোবাসা আমার। কখনোই তুমি অসম্পূর্ণ নও। তুমি অচেনা কোনো দেবীও নও! তুমি সত্যিই আমার মাধবী।
জায়গাটা যদি হয় রবীন্দ্র সরোবর! এর চেয়ে সুন্দর জায়গা ঢাকা শহরে সে সময়ে ছিল না। নীলক্ষেত থেকে রিক্সা নিয়ে আমরা চলে যাই মিরপুর রোড ধরে কলাবাগান। কাঁলাচাঁদ রেস্টুরেন্টে গরম সিঙ্গারা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। কিছু কথা থাকে জলকে স্বাক্ষী রেখে বলতে হয়। বৃক্ষও শোনে এ কথা। সেদিন ছিল চৈত্রের দুপুর। মাথার উপর কড়ই গাছের ছায়া। বিপন্ন বসন্ত বাতাসে ঝিরিঝিরি মরা পাতা ঝরে পড়ছে। আজ কথা ছিল মাধবী মন ভালো করে দেবে । কথা ছিল আজ প্রাণ ভরে গান শুনব পাখিদের।
কোনো পাখি সেদিন গান করেনি উদাসী দুপুরে। পাড়ের দূর্বা ঘাস তপ্ত রোদে পুড়ে খাক হয়ে আছে। একটি পানকৌড়িও সেদিন জলে ভাসেনি। এইসব বিযণ্নতা নিয়েই মুখোমুখি বসে আছি আমরা দুইজন। আমিই মন ভালো করে দিতে চাই মাধবীর। জলকে সামনে রেখে মাধবীকে বলি —
‘বাড়িতে মা’র কাছে চিঠি লিখেছি। মা আসছেন। বড়ো বোন, দুলাভাই যাবে তোমাদের বাড়ি। তোমাকে দেখবে। তোমাকে আমার বউ করে ঘরে আনার সব কথা পাকাপাকি করে আসবে। ‘
সন্ধ্যা পর্যন্ত সেদিন রবীন্দ্র সরোবরে ছিলাম। আজও মাধবীর হাত কাছে টেনে ওর নোখের গোলাপী নেইল পালিশ মুছে দিচ্ছিলাম। মাথার একগুচ্ছ চুল নাকের কাছে টেনে এনে গন্ধ নেই। ওর কানের কাছে মুখ রেখে কানে কানে বলি —
” সবচেয়ে সুন্দর লাল কাতান শাড়িটি তোমার জন্য কেনা হবে। টিকলি, কানের দুল, গলার হার, আর হাতের চুড়িও বানানো হবে। কপাল জুড়ে আঁকবে আলপনা। হাতে পরবে মেহেদী, পায়ে মাখবে আলতা। জরোয়া জরানো থাকবে সারা গায়ে। খোঁপায় পরবে কাঁঠালি চাঁপার মালা। কি, বউ হয়ে তুমি আসবে না ঘরে? ‘
তখন ছিল সন্ধ্যার আলো আঁধার। মাধবী কোনো কথা বলল না। হয়ত তার কন্ঠ রোধ হয়ে এসেছিল। সে শুধু আমার বুকে মাথা রেখে অঝোর ধারায় কেঁদেছিল।
নাহ্, মাধবী আর আমার ঘরে বউ হয়ে আসেনি। পরে জেনেছি, সে ছিল বিবাহিতা।
এই পৃথিবীতে একজনই কি মাধবী থাকে ? দক্ষিণ দুয়ারে বসেছিলাম এক শরৎ সন্ধ্যায়। চোখের সামনে রাত নামতে থাকে । আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, আকাশ ভরা তারা। যেখানে বসেছিলাম পাশেই ছিল হাস্নাহেনার ঝাড়। কে যেন পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। এ কোন্ দিগবালিকা। দূর থেকে নয়, কাছে যেয়ে তাকে চিনতে পারি — ‘এও একজন মাধবী, আমার মায়াবতী, আমার অনঙ্গ বউ।’
~ কোয়েল তালুকদার