পিঁপড়ের ছোট্ট গর্ত দিয়ে দূরবিন চোখে তাকাচ্ছিল মাইশা। বেশ শুনশান চারদিক। আক্রমণ করার তেমন কেউ নেই। বুট জুতার শব্দ নেই। বন্দুক তাক করা নেই। সে চিৎকার করার জন্য বেরিয়ে আসে। দেখতে সুন্দরী তরুণী, পিটপিট চোখ, উচ্ছ্বল হাসিটাও তীর্যকভাবে শোভা ছড়ানো। কন্ঠে জোর দেয়। ডাক তোলে,
– আসো হে খাম্বারা, আসো।
হয়তো তার মামুলি ডাকের জন্য কেউ আসে না। কেউ শোনে না। তবুও শঙ্কিত হৃদয়ে ভয়, দুরুদুরু কাঁপছিল ঠোঁট, কণ্ঠে জড়তা। তবুও ডাকে। নয়া দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে নিধুয়া পাথারে প্রথম যেমন আজান দেয় কোনো মুসলমান, তেমনি সে শোর তোলে আগাম পয়গামের। আশপাশে দেখে। হৃদয়ে ভয় তখনও কাটেনি বলে সাহস সঞ্চয় করে সে। চিৎকার দেয়।
জন্মের পরই কন্যাশিশু যেমন প্রথম অস্তিত্ব জানান দেয়, তেমনিভাবে জানাতে থাকে, জোরে।
– সুন্দরী মাইশা তোমাদের জন্য প্রস্তুত। আসো হে আমার খাম্বারা।
খাম্বার খুটির জোর বেশ পাকাপোক্ত, তারা বেশ ক্ষমতাধর। তাদের বাবা বা বাব-দাদারা সমাজ স্বীকৃত। এবং সে জানে, এই রকম শিক্ষিত খাম্বারা চতুর আর শক্তিশালী। আর তাদের অবস্থান অলি গলির সবখানে ওঁৎ পেতে দাঁড়ানো। আর তারা দ্রুতই ঘটনাকে পাল্টে ফেলতে পারে। তাই সে সজাগ হয়, তাদের নাম মুখে নেয় না। নাম না নিলেও, চুপ থাকে না। ক্রমশ নিজেকে বের করে গলা বাড়িয়ে দেয়। এই নিস্তব্ধতার সময়ে, যখন মেউ কথা বলতেই চায় না, আস্তে আস্তে গলার স্বর চড়া করে।
– আসো…
নরম গাল চোয়াল দ্রোহে কাঁপে। চোখ স্থির হয়।ইস্পাতের মতন শক্ত হয় চিকণ, ফর্সা লম্বা হাত। এবার সে সাহস যুগিয়েছে দিলের ভেতর। এবার সে গলা থামায় না।
আগেও সে এভাবেই ডেকেছে, ব্যর্থ হয়েছে। আর সে ব্যর্থ হতে চায় না। এবার গলাটাকে বেশ সুরেলা করে, চোয়াল বাঁকা করে, জিহবাকে বিকৃত করে নানান সুরে, নানান রঙে ঢঙেই সে ডাকে। নিত্যনতুন এমন সব পরিভাষায় সে চেষ্টা করে যে একসময় নিজের কণ্ঠ নিজেই চিনতে পারে না। মূলত যা সে বলতে চায় তা যেন প্রকাশই করতে পারছিল না। আসল কথাটা বলাই হচ্ছিল না। আহবান বা নিবেদনের ভাষা ব্যক্ত হচ্ছিল না। লাল হচ্ছিল সুন্দরী মাইশার গাল নাক মুখ। নিতম্ব থম ধরছিল। হৃদয়ের ব্যথা তখনো কণ্ঠে এসে ভাষা ফোঁটাতে পারেনি। আত্মার সাথে তার চাওয়া পাওয়া তখনো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় নি। যেন ফারাক থেকে গেছে সাড়া শরীরের সাথে ভাষার একিভূতি। তাই সে এবার মনে একাগ্রতা আনে। মন থেকে চায়। চোখ মুদে থম ধরে, যতক্ষণ তার সমস্ত অস্তিত্ব ভাষা হয়ে না ওঠে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে শব্দে পরিণত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত একমনে, ধীরে তালে বারবার ডাকতে থাকে। অনেকটা গম্ভিরভাবে, গ্রিবা বাঁকা করে, ভ্রুক্ষেপহীন সে ডাকে।
– হে আমার খাম্বারা, আসো। আমাকে তুলে নিয়ে যাও। হে আমার খাম্বার বাবারা।
দাঁত চিবিয়েই বলে সে শেষের কথাগুলো। আর এতে তার মনে হয় দাঁতের পেশি এবার তার জীবনের দাহন বুঝে ফেলেছে।
কিন্তু পাশেই ছিল তার বাবা আমান। বিরক্তি নিয়ে মাথা লটপটিয়ে বলে, কিছুই হচ্ছেনা তোর! ভালো করে মন দে! সেও যেন যুগযুগের শব্দ তোলার কাজে এখানে আছে। সে প্রচণ্ড চিৎকার করে।
– থাম! ধমক দিয়ে মেয়েকে থামিয়ে দেয় আমান। কাছে ডেকে বসায়। পানি খেতে দেয়। তারপর বোঝাতে থাকে,
– আগে হৃদয় থেকে অনুভব কর। অনুভব হাজারো শব্দের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা এমনই শক্তিশালী জিনিস যা হারালে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা হারানোর থেকেও ক্ষতির। বলতে পারিস, শুধু তুই না, তোর পুরো জাতিকেই ধংস করে দেয়। তোকে বুঝতে হবে কি কারণে এ চিৎকার। সেই চৌদ্দ বছরের স্মৃতিটাকে চোখের সামনে তুলে নে। তোর নিষ্পাপ বড় বোনের লাশ চোখের সামনে দাঁড়ানো। তুই বিমর্ষ হয়ে দেখছিস আর ভেঙে পড়ছিস। বুক ফেঁড়ে মাতাল হয়ে দুনিয়াটা সাবার করতে চাইছিস। কিন্তু কিছুই করার ক্ষমতা নাই তোর। অনুভূতির প্রতিটি রন্ধ্রে তোকে অনুভব করতে হবে কেনো প্রয়োজন এতটা চিৎকার করা আহ্বানের, বিশেষ করে ক্ষমতাবান খাম্বাদের প্রতি কেনো এতোটা উতালা হতে হবে। বুঝতে হবে, অস্তিত্বের ঠিক কোন জায়গাটা তোর জাগরণের টিউনিং পয়েন্ট। বুঝেছিস?
মাইশা সামান্য মাথা দোলায়। বাবার কথায় সম্মতি দেয়। ঝিম মেরে ধ্যানমগ্ন থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে আবার শুরু করে।
তবুও আকৃষ্ঠ করার মতো আহ্বান এবারো হয়ে উঠল না। বরং তার চিৎকার হলো কানফাটা আর্তনাদের মতো, কর্কশ আর অর্থহীন। যেন চিকণ গলায় ক্যা ক্যা করে কাঁদছে।
মেয়ের এই প্যানপ্যানানি একেবারেই পছন্দ করে না আমান। ধমকে দিয়ে ওঠে, খবরদার এরম মিউ মিউ করে কাঁদবিনা। চিৎকার দে। গলাটা ছেড়ে চিৎকার দে। চোখ মোছ। দেখে শেখ কিভাবে আমি হাক দেই। বলেই সে হাক দেয়,
– কই হে-এ এ এ, আসো হে আমার ক্ষমতা-ধর-রা আ আ আ…
কেঁপে কেঁপে তরঙ্গায়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল আমানের শব্দগুলো। গাছে কুজনরত পাখিরা পর্যন্ত তরাক তাকাল। যেন কান পর্যন্ত ঝমঝম করছে। মাইশার মনে হলো, চোখ বুঝে শুনলে এই হাক যেন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় শোনা যাবে। এর অনুরণন প্রবাহমান কালের ভেতরে মিশে গিয়ে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে। মাইশা আপ্লুত হয়ে চোখ বুঁজে নিল। অনুধাবন করতে থাকল, শব্দে শব্দে কিভাবে মানুষ তার অত্বিত্বের ভেতর পয়দা হতে থাকে।
ধূমপান করা পোড় খাওয়া গলা আমানের। আশি বছরি বাঁজখাই মানুষ। ভাঁজ খাওয়া মোটা হাড়ের মানুষ। অভিজ্ঞ আর ঝাঁঝালো দৃষ্টি। বিচক্ষণতায় ভরা মানুষটার কোঠরাগত চোখ চোঁয়ালে শকুন দৃষ্টি দিয়ে কারো দিকে নজর দিলে ভেতরের নাড়ী-নক্ষত্র পড়ে ফেলতে পারে। হয়তো এ কারণে মানুষ তার ধারে কাছে ঘেষে না।
শুধু মেয়ে সেই চোখের ভাষা পড়তে পারে। মাইশা আস্তে চোখ খুলে বাবার দিকে স্থির তাকিয়ে দৃষ্টির উত্তাপ পড়ে নেয়। এরপরই হিম্মদ নিয়ে কর্কশ গলায় ডাক দেয়,
– আসো ও ও
যতক্ষণ পর্যন্ত তার গলাকে কিছুটা উচ্চে নিতে না পারল, ততক্ষণ সে নিজের একগুয়ে জেদের ভেতরে প্রবেশ করতে লাগল দেয়াল ধরে চিৎকার দিতে দিতে। গলাটাও খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল ক্রমাগত। এভাবে চিৎকার তোলার পরই সে কিছুটা সফলতার আলো দেখতে পেল। আর সেই সফলতা পরিপূর্ণ হতে থাকল তখনই, যখন দেখতে পেল চৌদ্দ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যে চোখ তার বড় বোনকে হত্যা করে ফেলেছিল প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে, দেখল সেই লোলুপ চোখগুলো পাজরোগাড়ির জানালা দিয়ে তার দিকে থির তাকিয়ে আছে।
এরপরই সে বেরিয়ে এলো জড়তার খোলস থেকে। হাতে নিল কয়েকটা কাঠের টুকরো। বাবাকে বলল, চলো!
– আসো আমার সাথে আসো।
মেয়ের দৃষ্টি হয়েছে আগুণ। এমন তেজ এই প্রথম দেখতে পেল আমান। কম্পমাণ শরীর হয়েছে শব্দ। সে যেন ফেঁটেচৌচির হয়ে ছড়িয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু আমান তবুও মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করল না। যদিও পাজেরোতে লুকিয়ে যাওয়া চোখ তখন নিরাপদে চলে গেছে, তবুও তারা হেঁটে চৌরাস্তা মোড়ে এসে থামল। এরপর শুরু করল মঞ্চ বানানোর কাজ।
মাইশা বাবার হাতে কাঠ তুলে দিল। হাতে ছিল হাতুড়ি আর পেরেক। লেগে পড়ল বাবার সাথে মঞ্চ বানানোর কাজে। হাতের কাছে যা পেল তাই দিয়ে শুরু করল। আর বলতে লাগল,
– কই গেলে? আসো আমার খাম্বারা।
– দেখ চৌদ্দ বছর আগে বিবস্ত্র তোর বোন নিস্তেজ পড়ে আছে। আমান গলা লাগালো।
– আমি দেখছি নিরাপত্তা বিধান করা পাঁজরের বন্দী চোখ।
তারপর ফিসফিস করে বাবাকে বলল,
– সে ফিরে এসেছে।
– তারা সব সময় থাকে। পাপের বিষে ফঁণা তোলা সাপের দেহে দুধেলা আবরণ পরিধান করে আসে। একশ হাজার ভিমরুল কিলবিল করে সারা শরীরে হুল ফোঁটায়।
মাথা ঝাটকা দিয়ে সে আবার বলে ওঠো, সবাই আসো। আমাকেও তুলে নিয়ে যাও হে খাম্বা- রা।
কেবল সকাল। পাশেই তার শিকারি ছাগল কখন এসে বসে পড়েছে। কান ঢাকা। কাঠে হাতুরি পেটানোর কানফাঁটা শব্দ হচ্ছিল। তারই ফাঁকে সুন্দরী মাইশার এমন চিৎকার করা আহবান। সেই আহ্বান হারিয়ে যাচ্ছিল থেকে থেকে। সে ছাগলের চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝাপড়া করে নিয়ে কিছুটা বিরাম নিয়ে আরো জোরে আওয়াজ তুলছিল যাতে গমগম করছিল চারপাশ। যেন তার বাবার হাতুড়ি আঘাতের শব্দকেও তার আওয়াজ ছড়িয়ে দিতে পারে।
ভোরের সূর্যের নয়া আলোর মতো শীতসকালের শব্দগুলো কুয়াশায় ধাক্কা খেতে খেতে আশপাশের বাড়ির জানালা দিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়ছে। পুরো সপ্তাহ শীতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার পর আজই প্রথম সূর্যটা কুয়াশায় গোসল করে এসেছে। নাপাক গোসলের পরে চুল শুকানো কিশোরির আলুথালু চুলের মতো ঝরঝরে আলোরশ্মি মৃদু দুলছে, ভাসমান শব্দের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে। সবকিছুই বাড়িয়ে দিয়েছে মাইশার মনের শক্তি। মনের ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে নিয়ে সে আরো জোরসে চিৎকার মারে। যাতে গোটা মহাবিশ্ব গমগম করে তার চিৎকারে, যাতে প্রতি জনের কানে তার দাওয়াতটা পৌছে যায়। আর সবাই তাকে লুটে নিতে হামলে পড়ে।
– আমাকে তুলে নিতে আসো-ও-ও। হে আমার খাম্বার বাবা-রা রা
সুন্দরীদের তুলে নেয়ার জন্য এভাবে আহ্বান করার প্রয়োজন পরে না। বিশেষ করে যাদের সৌন্দর্যের ক্ষমতা নাকি গোটা সমাজটাকে লুটেরা বানায়। লোলুপ আর ক্ষামশ করা ক্ষমতার নখর যখন তীব্রতরো হয়। কিন্তু সে জানে, এমন তীব্রতরো নখরের আগায় শব্দের আলো জ্বালাতে এমনই হতে হবে। যে চেনে ব্যথা, যে অন্তরের দহন চিনে ভাষা তুলতে পারে তার এই আহ্বান ভেতর থেকে পয়দা করাটা জরুরি। যেমনটা তার বাবা করে। তাই একসাথেই চিৎকার করে তারা একই জায়গা থেকে। যুগপদ ভাবে। একই আওয়াজ তোলে সেই হাতুড়ির আঘাতে আর মাইশার কণ্ঠ থেকে।
জানালা খুলে দেখছিল কেউ কেউ, মোড়ের গোল চত্তরে সুন্দরী মাইশা ঘুরে ঘুরে চিৎকার দিচ্ছে আর এক একটা কাঠ তুলে বাবাকে দিচ্ছে আর তার বাবা মঞ্চ বানাতে কাঠগুলো সাজিয়ে নিয়ে পেরেক ঠুকছে। তারা কাজটা এতোটাই মগ্ন হয়ে করছে যে আশপাশের আর কারো দিকেই তাকাচ্ছে না। কেউ ডাকলেও শুনছে না। যেন কোনো মহৎ লক্ষ্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একনাগাড়ে আপন মনে তারা কাজ করছে আর চিৎকার দিচ্ছে ভ্রুক্ষেপহীন এবং বেপরোয়াভাবে।
রক্তমাখা দাঁতেমুখে বেজি যেমন জীবিত সাপকে কামড়ে খেতে থাকে, তেমনিভাবে ভেতরের জড়তাময় সাপকে কামড়ে কেটে টুকরো করে মাইশা চিৎকার দিতে দিতে মুখচোখ লাল করে ফেলে। এতে তার গলার পেশি হয়েছে ফোলা ফোলা। ফর্সা কান হয়েছে গরম লাল। চোখগুলো হয়েছে স্রোতের ধারের মতো অস্থির। কারণ তাকে সময় আর হাতুড়ি পেটানোর শব্দকেও অতিক্রম করে চিৎকার দিতে হচ্ছিল।
বাবা আমান থেকে থেকেই শেখাচ্ছিল, কিভাবে একপশলা বাতাস দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বুকের ভেতরে একেবারে নাভী পর্যন্ত টান দিয়ে দমবন্ধ করে নিতে হয়। তারপর শরীরের পেশী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শব্দের কুহক তৈরি করে তীরের ফলার মতো মাপমতো ছাড়তে হয় গলা চিকণ করে। পুরোটা একটা লাফিয়ে ওঠা জিন্দা হিম্মদ। এটা জিন্দেগীর এমন এক দশা, যেখানে যৌবনের তাগড়া তাগদ আকাশ ফেঁড়ে আছড়ে পড়ে। আর তখনই পয়দা হয় শ্বাসকে আর শব্দকে যুগপদ বন্দি করে রাখা এমনতরো ভাষা, যে ভাষার দম লক্ষ্যবস্তুতে কাঁপতে কাঁপতে আঘাত হানতে পারে। এভাবে চিৎকার করাটা ব্যাপক শক্তির ব্যাপার। হিংস্র পশুশক্তি এটা নয়। এই শক্তি হচ্ছে বধির এক অনুভূতির। সেই অনুভূতি নিয়ে মাইশা সারা শরীর শক্ত করে মুখের ভেতর দমভরা বাতাস ভরে নেয়, একেবারে ফুসফুসে নিয়ে দেহের ওম জড়ো করে জোর শক্তি দিয়ে পেট এবং মুখের সমস্ত পেশী কাজে লাগিয়ে বলতে থাকে,
– আসো হে আমার ক্ষমতাধররা আ আ আ
যেন ডাহুক পাখির মতো অনর্গল ডাকছে আর বলছে সে, আসো হে আমার খাম্বার বাবা রা, বাবার বাবা রা।
আরো জোরে, আরো জোরে চিৎকার তুলে বলছে, আ-মা-কে তু-লে নি-তে আ-সো-ও-ও-ও।
গা ঘামছে। প্রায় অর্ধনগ্ন হয়নি তখনো, গায়ের চাদর শরীর থেকে নামিয়ে ফেলেছে কিছুটা। শব্দ তোলার আয়োজন করা, শব্দ তোলা এবং শব্দের ঘাত সহ্য করা কম কথা নয়। রোদ লেগে চিকচিক করছে দেহ, প্রতিবার সে জায়গা বদল করছে আর কাপড় নামিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, কেউ কি আছো হে আমার …, তখনই হাতুড়ি পেটানো শব্দ শুরু হয়।
শুধু ছাগলটা মঞ্চের নিচে বসে জাবর কাটছিল। লম্বা কান ঢাকা যাতে কোনো শব্দই কানে না ঢোকে। সে মুখ তুলে চেয়ে থাকছিল আপেল চিবাতে চিবাতে। দাঁত তার কিড়মিড় করছিল। আর সেই ছাগলের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করছিল মাইশা।
প্রথমে পৃথিবীর সমস্ত খাম্বার উদ্দেশ্যে মাইশার চিৎকার ছিল। কিন্তু পরে বুঝতে পারে, খাম্বার খুঁটি বড়ই পাকাপোক্ত, শক্তি ক্ষমতায় পাকা আর মজবুত। আরো ভয়ানক হচ্ছে তারা অনূভুতিহীন।মূলত এমন খাম্বাদের উদ্দেশ্যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, শুরুটা সেখানেই প্রয়োজন। তাই কৌশলটা পাল্টিয়ে ফেলে সে পরিধানের কাপড় আরো নিচে নামিয়ে খুঁটির উদ্দেশ্যে আহ্বান করে, একই কথায়, একই ভাষায়, একই ভাবে লাজ-লজ্জার তোয়াক্কা না করে প্রচার করে, প্রোলোভনও দেয় আরো খানিকটা অর্ধনগ্ন হতে হতে।
– আমাকে লুট করে যাও। কেউ কি আছো ওহে আমার খাম্বার বাবারা, প্রকাশ্য দিবালোকে লুট করতে পারো।
আবার কাঠে পেরেক ঠোকার শব্দ আসে। আবার থেমে যায়। আবার শোনা যায় সেই ডাক,
– আপনারা কেউ কি শুনছেন? ওহে আমার…
দু’হাতে শক্ত করে কাঠের খুঁটি ধরে খানিকটা উঁচু আর শক্ত পাটাতনে দাঁড়ায় মাইশা তার পায়ের নড়বড়ে অবস্থাটা পরিত্যাগ করে। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়েই আকাশ পানে মুখ তুলে জোরসে চিৎকার করে।
– আ-সে-ন। এসে রেপ করে যান হে আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর খাম্বারা। খাম্বার বাব দাদা সন্তানেরা। বিশ্বাস ক-রেন, এক্কেবারেই আনকোরা আ-মি-ই-ই।
গলার স্বর থেমে যাওয়ার খানিক বিরতিও হয়নি তখন, কাঠে পেরেক ঠোকরানোর শব্দ থেমে যায়নি, ওমনি বয়ষ্ক বাবার গলা যুগপৎ ভেসে আসে।
– মাইশা, সে পবিত্র মেয়ে আমার। এক্কেবারেই পবিত্র। বিবি মরিয়মও জানেন, হে আমার ক্ষমতাধর খাম্বারা, আপনারা আসেন।
– হ্যা হ্যা আসেন।
ঝাকড়া চুলের বুড়ো আমানের চিৎকারের পর পরই মাইশা কোরাস তোলে। আর সে থেমে গেলেই সাথে সাথে বলে ওঠে বুড়ো,
– হ্যা আসেন। প্রকাশ্য দিবালোকে আমার মেয়েকে লুট করে যান।
– এসে রেপ করে যান। আমরা নিশ্চুপই থেকে যাব। আমার বাপেও আওয়াজ করবে না কোনো।
– হ্যা আমরা কেউ কোনো কথাই বলব না আর। যেমন আমাদের লম্বা কান-ঢাকা রাম ছাগলের মতো।
আবার কাঠে পেরেক ঠোকানোর শব্দ আসে। থেকে থেকে। কখনো আপনি করে, কখনো তুমি করে ডাকে অনর্গল। আহ্বান ও কষাঘাত পরষ্পর মিলে চারদিকে ছড়িয়ে যায়, যেতে থাকে। এক কথা।
একটা তাল-লয় তৈরি হয়। একটা সুর বা একটা কথা। লোকেরা দেখছে কেউ কেউ।
মঞ্চ বানানোর কাজ করছিল বুড়ো আমান। ঠক, ঠক ঠক ঠক ঠক, ঠোক্লোস। আরেকটা পেরেক তুলে নিল। কাজে নিগুঢ় মনোনিবেশ। আবারো ঠক, ঠক ঠক ঠক ঠক ঠককস। আবার চিৎকার।
তাঁর মাথার চুল হাতুড়ি পেটানোর তালে তালে দুলছে। তার মেয়ের চিৎকারের সাথে সাথে দুলছে। পাশেই তাঁর মেয়ে মাইশা কাঠ তুলে তুলে বাপের কাজে সহযোগিতা করছে। মঞ্চ বানানোর কাজে মহাব্যস্ত তারা। তারই ফাঁকে যেমন কোরাস তুলে মোটাগাছ কাটা লোকেরা ব্যস্ত থাকে, তেমনি ব্যস্ত থেকে চিৎকার করছে যেন মজবুত আর সঠিক করে মস্তকাজ করার উদ্দেশ্যে জুতমতো লেগে পড়েছে তারা। তাদের কোরাস আর কাজ একই সূত্রে শক্তপোক্ত গাঁথুনির দ্বারা জড়িয়ে একে অপরকে পূর্ণ করছে। তারা থামছে, চিৎকার দিচ্ছে আর কাঠ সাজিয়ে পেরেক ঠুকছে। কথা আর শব্দ মিলেমিশে একই কাজ করছে। যেন শব্দ বা আহ্বানের পৃথক কোনো অর্থ নেই। মূলত অনর্গল একই ভাষায় তাদের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যর সাথে। তারা পেরেক ঠুকছে কিংবা বলছে, একই কথা।
সাতসকালে চিৎকার শুনে লোকেরা মহাবিরক্ত। যেন তাদের মাথায় ঠুকছে পেরেকগুলো। বিশেষ করে নোংরা শব্দগুলোর ধারালো পেরেক তাদের মাথা এবং হৃদয় ভেদ করে যাচ্ছে। তারা কেউ কেউ বেরিয়ে এলো বাঁধা দিবে বলে। কারণ তাদের মগজে শব্দগুলো বেশি হানা দিচ্ছে।
কিন্তু তারা শব্দ তুলছে ভ্রুক্ষেপহীন এবং বেপরোয়াভাবে।
আবারো একটা কাঠের টুকরো টেনে মাইশা তার বাপের হাতে দিল। তার বাবা কাঠের ওপর কাঠ জুতমতো বসিয়ে কাগজের ঠোঙ্গা থেকে বাম হাতে একটা পেরেক তুলে নিয়ে ডান হাতের পেশিবহুল শক্তির জোরে হাতুড়ি পেটাতে লাগল।
– ঠক, ঠক ঠক ঠক ঠক ঠককস।
– হে আমার …, আপনারা আসেন আর আমাকে রেপ করে যান।
নিস্তদ্ধ, হাতুড়ি বা কণ্ঠ।
মাইশা আরো একটি কাঠ নিয়ে আধা তৈরি মঞ্চে উঠে আবারো আকাশ পানে মুখ করে দু’হাতের তালু দিয়ে মাইক বানিয়ে শব্দ ছড়াতে প্রস্তুতি নিল, যেমন তার বাবা দেখিয়ে দিয়েছেন যাতে মানুষের কান শুধু নয়, মগজ পর্যন্ত ভেদ করে চলে যায়, ঠিক এভাবে,
– আমার মেয়ে ভার্জিন। আপনারা চাইলে আমার স্ত্রীকেও প্রকাশ্যে রেপ করতে পারেন। চলে আসেন, হে আমার …
এতটুকু বলেই সে মেয়ের দিকে তাকায় আর মাইশা সাথে সাথেই সেখান থেকে শুরু করে,
– ক্ষমতাধর খাম্বারা, আসেন।
শব্দগুলোয় যেন আকাশ ফাঁটে। যেন সূঁচ ফোঁটে পেরেকের, মগজে ও আকাশে। বিবেকে তখনো তেমন কথা তোলে না। কেউ কেউ মগজ ফাঁটা উৎসের দিকে তাকায়। কেউ কেউ আসে। কিন্তু খাম্বাদের তবুও দেখা মেলেনা। তাই মাইশার পিতা আরো জোরে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রায় মাতাল হয়ে কখনো কাঠে, কখনো পেরেকে হাতুড়ি পেটাতে থাকে যেন গোটা পৃৃথিবীটাকেই সে এফাঁড় ওফাঁড় করে দিবে।
এই কঠোরাঘাত সহ্য করতে না পেরে অবশেষে বুড়ো আমানের বন্ধু আহসান খুঁড়ে খুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
– কি শুরু করেছ আমান। এসব কিসের পাগলামি তোমার!
ভ্রুক্ষেপহীন আমান। বেপরোয়া। এমনকি তার মেয়ে মাইশা পর্যন্ত কাজের জায়গা থেকে মন সরায় না।
– ছি ছি ছি আমান, আরে পাগলা এদিক আয়। ডাকেন আহসান। ছোট বেলার বন্ধু। বয়সের তুলনায় বেশিই বৃদ্ধ । তবুও তিনি যেন লজ্জায় পড়েছেন।
– আরে শোন রে আমান, দেখ ঐ দিকে, লোকেরা পর্যন্ত দরজা জানালা আটকিয়ে দিয়েছে যাতে বাড়ির বাচ্চারা তোর নোংরা শব্দ না শোনে। এ-কোন পাগলাটে রোগ ধরেছে তোর। থামাও আমান। থামাও ।
কিছুই বলে না আমান। ফিরেও তাকায় না। ছাগলের মতো একই ভাবে তার নিজের কাজ করে।
– আমি জানি এটা বেশি পণ্ডিত, ঘাড় ট্যারা। সে তো সহজে শুনবে না। দেখি কি করা যায়। বলেই আহসান আরো কাছে ভিড়তে থাকেন। অন্তত তার বউকে দিয়ে যদি কিছু করানো যায়। হয়তো তাও হবে না। কারণ একরোখা আমান যখন নিজের কাজে ঢুকে পড়েন, তখন আর দুনিয়াকে পরোয়া করবে না। অথচ যখন গল্প করে, কী আন্তরিক। আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো বন্ধু হয়ে যায়। আর যখন অচেনা হয়ে যায়, লোকটা নিজের জগতে ঢুকে পড়ে। আহসান বুঝতে পেরেছেন, আজকে আমান ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে। তাকে কোনোভাবেই থামানো যাবে না।
ঠিক কাছাকাছিও আসেননি তিনি তখন, শুনতে পান আরেক জনের করুণ আকুতি।
– হায় আল্লাহরে, আমাদের বাঁচান।
ঝাঁকড়া চুলের পাগল আমান মাথা ঝাঁকাচ্ছে। প্রথম যে কাজ হবে যুক্তিতে আটকে দেয়া। আহসান ভাবেন। কিন্তু গোয়ার আমানকে থামানো যাবে না। শুধু তর্ক করবে, পারা যায় না লোকটার সাথে। শুধু খটকা লাগায়, মানুষ যে কেনো তাকে প্রজ্জাবাণ, জ্ঞানী মানুষ বলে তার মাথায় আসে না। জিপসি চেহারার অকুতোভয় দৃষ্টি আমানের। হাড়ে হাড়ে শৈবাল গঁজিয়ে লোমে ভরা আস্ত জন্তুমতো মানুষটা উঁচু টিলার ওপরে বসলে প্রাচীন এক বটবৃক্ষের মতো মনে হয়। সেই মানুষের এমন নির্লজ্জ ঘোষণায় লোকেরা বিব্রত আজ। বিড়বিড় করে, অতিরিক্ত হচ্ছে তার বাড়াবাড়ি। এমনকি তার এই চিৎকার তো কোনোভাবেই মানা যায় না।
– হায় আল্লাহরে, বাঁচান আমাদের।
আবারো আহাজারি শোনা যায়। একদা চৌদ্দ বছর আগে যা শোনা গিয়েছিল। শুধু কান্না নয়, আহাজারি, বেদনা ভরা অসহায় এক নারীর আকুতি, কিংবা আক্ষেপ, হতে পারে চৌদ্দ বছর কোনো নারীর গর্ভাশয়ে উৎগীরণ করার কোনো রক্তের হলি। অনর্গল ঝড়তে থাকে।
– হায় আল্লাহরে, বাঁচান আমাদের। বদ্ধ উন্মাদ হইছে মানুষটা। আমি কি নিয়া বাঁচব। যা আমার গেছে গেছে আমারে আর নিঃস্ব কইরো না খোদা।
কান্না আর আহাজারি আমানের বিচলিত স্ত্রীর গলা থেকে আসে। সে মেয়েকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু মেয়ে মাইশা মায়ের কথা উপেক্ষা করে উন্মাদ বাবার সাথে শামিল হয়েছে।
– তুই ফিরে আয় মা। ঐ গোঁয়াড়, উন্মাদ মানুষটার কথা শুনিস না। শামিল হোস না তার সাথে।
ভ্রুক্ষেপহীন আমান। তার আয়োজনও থামছে না, বেপরোয়া চলছে।
– কি রকম ঘাড় ট্যারা, ঘাউড়া, নির্লজ্জ বেহায়া মানুষটা, আমানের স্ত্রী আক্রোশে হস্তিনি মুরগীর মতো মাথা ঝাপটায় আর বলে, বাঁচান এই মানুষটার হাত থেকে। কাঁদেন আবার, আমাদের বেইজ্জতি করতে চাইছে। প্রকাশ্যে, সবার সামনে ইজ্জত বিলিয়ে দিচ্ছে। বাঁচান আমাদের।
মোছে অশ্রুশূন্য চোখ। বেদনাভরা অসহায় এক আহাজারি নিয়ে বলে, সে নিজেও মরবে, অবশিষ্ট এই মেয়েটাকেও মারবে আর মারবে আমাকেও।
গলা কাঁপে কথা বলতে তার। প্রায় দুইবার তিনবার করে করে সমর্থক শব্দে কথা বলে। যতক্ষণ মনে হয় না শব্দগুলো তার মনের ভাষা বলতে পেরেছে, ততক্ষণ একই কথা ভিন্নভাবে বলে। প্রায় চৌদ্দ বছর এভাবেই কান্না করেছে আর বলছে। একেবারে খারাপ ভাবে, নিকৃষ্ঠভাবে ছেড়ে ফেঁড়ে খেয়েছিল নোংরা পশুরা। খুব বিশ্রী অবস্থা ছিল তার। নপুংশকরা, বিকৃতভাবে দাঁত দিয়ে কামড়ে ছেচড়ে টেনে উল্টেপাল্টে আমারা মেয়েকে হায় খোদা, অবশেষে কেটে টুকরো টুকরো করেছে।
তার ধারণা, চৌদ্দ বছর ধরে বলতে বলতে শব্দগুলো অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। তাই সে আরেকটু বেশিই বলে ফেলে। আর আরেকটু বেশি বলা শব্দগুলো ধরেই ক্ষমতাধররা প্রমান করতে থাকে, এমন কিছুই ঘটেনি সেখানে। যেমন তার মেয়ের পা বুড়ো আঙুলের পা অন্যখানে পাওয়া গেছে। কিন্তু ফরেনসিক রির্পোটে প্রমাণ হয়েছে সেটা অন্য মেয়ের। আর যাকে জানাজা দিয়েছে তার পাদুটো আঙুল সমেত। যারা গোসল দিয়েছিল তারাও দেখেছেন। যে মেয়েকে রেপ করার কথা তারা বলছে, সে এখনো জীবিত আছে। কোনোকিছুই হারায় নি তাদের।আর একারণেই বউয়ের কথা শেষ পর্যন্ত অযথাই হয়েছে। বলতে গেলে মায়াকান্না। কারো কান পর্যন্ত পৌছে নাই, অনুভূতিও জাগায় নি। এমনকি অপরাধিরা কোনো না কোনোভাবেই আইনগুলো ফাঁকফোঁকড় দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। কিন্তু আজ, একটিমাত্র শব্দ পেরেকের সূচ হয়ে কানে হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে। আর এই হুল ফোঁটানোর কাজ করছে যে, সেই মাইশা আর তার বুড়ো বাপ, ঠিক যেভাবে, সেটাও পছন্দ করছেন না তারা।
– এই মানুষটা নিজেকে শেষ করে করে কী এমন শেখাতে চায় আমার জানা নাই।
– তোমার কোনো কিছুই জানতে হবে না। বুঝতে হবে না। শুধু এটা আমি জানি, আমি কিভাবে নিজেকে শেষ করতে পারি।
তিনি কাদছেন, আহাজারি করছেন। বোকার মতো কাজ করো না। এতে কারো কিছুই যায় আসে না।
– সেটা আমিও জানি।
বলেই তিনি পেরেক ঠোঁকা শুরু করেন। ঠক, ঠক ঠক ঠক ঠক ঠককস।
– এই বোকা শেয়ে মাইশা নিজের বোকা একটা গবেট মেয়ে, আপনারা উদ্ধার করুন দয়া করে।
চারদিক থেকে বাড়ির বউ বাচ্চারা পর্যন্ত এবার বেরিয়ে আসতে থাকে। আজ ঘিরে ফেলে পাকড়াও করে উচিৎ একটা শিক্ষা দিতে হবে। আস্ত পুড়িয়েও মারা হবে মোড়ের গোল চত্তরের মঞ্চে সেই মানুষটাকে, আর তার মেয়েকে।
কিন্তু ব্যাপারটা হঠাৎই বদলে যেতে থাকে। আচমকা আসে সেই কান্নার রোল।
– ওভাবে চিৎকার দিওনা, সবাই জানে তোমার ঘরে যুবতী মাইশার মতো সুন্দরী মেয়ে আছে।
– কিন্তু সে একটা বোকা। তার মা বলে। সুন্দরীর কারণেই সে আস্ত গাধা। খুব সহজেই কথার প্যাঁচে প্রলোভনে পড়ে। আরে বোকা মেয়ে, লোভিদের প্রশংসা হলো পাপের বিষ। তারা এই বিষ ঢেলে খেয়ে ফেলবে। আর তোর বাপের কথাও শুনিস না। লোকটা পাগল, তোকে বশ করেছে এবং এ কারণেই বাপের মতো একরোখা জেদি হয়েছিস। লোকটা আস্ত গাধা না হলে নিজের মেয়েকে এভাবে রেপ করতে মানুষজন ডাকে?
বলেই সে চৌদ্দ বছরের কান্না শুরু করে।
আমান এই কান্না সহ্য করে না। একটা কাঠের টুকরো নিয়ে ছুড়ে মারে।
লোকেরা দ্রুত সেখান থেকে তার বউকে সরে নিয়ে যায়। এদিকে আর আনে না।
সেই চৌদ্দ বছর ধরে কাদছে তারা। কাদতে কাদতে নিস্তেজ হয়ে গেছে। সেই কান্না আজ ফেনিয়ে উঠেছে। যেন উন্মাতাল জোয়ারের মতো বুক সমুদ্রের হৃদয় ভেগে দাহন তুলেছে। আর ওদিকে সেই আমান ঘুরে ঘুরে নিরব হয়েছে। আর সে চুপ থাকবে না। বিশেষ করে যখন তার মেয়ে পাশে আছে।
আকাশ থেকে একটা পরি নেমে আসে মঞ্চের ওপর, প্রায় নগ্ন, জোয়ান অফ আর্কের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আর কাপড় খুলতে থাকে থেকে থেকে।
ঘোষণাটা দেয় আমান তার বড় মেয়ে রেপ হওয়ার চৌদ্দ বছর পরে। এরপর চৌদ্দ বছর ধরে সে দ্বারে দ্বারে ঘুরে হেনস্তা হতে হয়েছে। তারা বরং ল্যাংটো করেছে সবার সামনে। নানান প্রশ্ন তুলে বিব্রত করেছে। তখনই সে বুঝতে পারে, ধর্ষকামী মাতালদের অনুভূতির জন্য প্রকাশ্য রেপ এর আহবানই হচ্ছে উত্তম।