পর্ব এক :
বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষার পরপরেই তূলানামুলক ভাষাতত্বের উপর উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ক্যালেফোর্নিয়ার লস এ্যাঞ্জেলেসের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে দুই বৎসরের স্কলারশীপ পাই । সব ফর্মালিটিস্ কমপ্লিট করতে সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যায়। হাতে বেশি সময় ছিল না। তিন দিন পরেই ফ্লাইট। আমার এই সুখবরটি শুনে যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন তিনি আমার এক স্কুলের শিক্ষক জনাব মোঃ ইদ্রিস আলী। যার বাড়িতে নন্ পেয়িং গেস্ট হিসাবে আমি পাঁচ বছর ছিলাম।
আমার এই শিক্ষক মহোদয়কে এই সুসংবাদ ও তার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য সকালের ট্রেনেই চলে আসি জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে। সেখান থেকে যমুনার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে আড়াই মাইল দূরে উল্লা নামে একটি গ্রামে চলে যাই। নদীর পাড় ঘেসেই মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি। পথে আসছিলাম আর ভাবছিলাম, এই মাষ্টার মশাই ছাড়া এ জগতে আমার আর কেউ নেই। আমি যখন এখানে পৌঁছি, তখন বিকাল হয়ে যায়। বাড়ি পৌঁছে মাষ্টার মশাইকে সব কথা বললাম। এও বললাম কাল প্রত্যুষেই আমি চলে যাব।
এখানে এই নদীর কূলে একাকী কত মময় কাটিয়েছি। ভাটির স্রোতের টানে মাঝি মাল্লারদের কত গান শুনেছি। যমুনার জলে কত যে গা ভিজিয়েছি। এই বাড়ির পূর্ব পাশে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে যমুনা নদী। খুব ইচ্ছা হলো, আরেকবার সব ঘুরে ঘুরে দেখতে। সারা বিকেল একাকী নদীর কুল ধরে হাঁটলাম। নির্জন নদীর পাড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম অনেক কথা, মাস্টার মশাইয়ের কথা, ওনার স্ত্রীর কথা, তাদের কিশোরী মেয়ে শিউলীর কথা। আমি যখন প্রথম এই বাড়িতে আসি। তখন শিউলীর বয়স ছিল নয় দশ বছর। এখন চৌদ্দ পনরো হবে। অস্টম ক্লাশ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আমাকে এই বালিকা আনেক সেবা করেছে। অনেক যত্ন সহকারে খাবার খেতে দিয়েছে। জ্বর আসলে মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছে।
নদীর কূল থেকে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে মাস্টার মশাইয়ের কাছে বসে কথা বলছিলাম- উনি বলছিল– ”আমার শরীরটা ভালো যাইতেছে না। কোনো ঔষুধ পত্র কাজে আসিতেছে না। যে কোনো সময় ইহলোক ত্যাগ করিতে পারি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল শিউলীর সহিত তোমাকে বিবাহ দিতে। তুমি কাল প্রত্যুষে চলিয়া যাইবে। তুমি যদি রাজি হও, তাহা হইলে আজ রাতেই তোমাদের বিবাহের ব্যবস্থা করিতাম।’
এই পরিবারের কাছে, এই মাস্টার মশাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋন আছে। এরা আমার মতো একজন অনাথকে অনেক স্নেহ করেছে। আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। নিজেরা কষ্ট করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছে। আমি বেশি কিছু ভাবলাম না। বললাম- বিবাহের ব্যবস্থা করেন।
মেয়েটির গায়ে কোনো হলুদ দেওয়া হলো না। দূর্বা চন্দন ভিজিয়ে গোসল করানো হলো না। নতুন কোনো শাড়ি পরানো হলো না। হাতে মেহেদী দিল না। মুখে কেউ আলপনা আঁকল না, পায়ে আলতা মেখে দিল না। বুকে লাগানো হলো না কোনো সুগন্ধী। আমারও তাই। কোনো শেরোয়ানী পরলাম না। পাঞ্জাবীও পরলাম না। সানাই বাজল না। মসজিদের মৌলভী সাহেবকে ডেকে এনে ইসলামী নিয়মে আমাদের বিবাহ পড়ানো হলো।
সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল না। তারাগুলি জ্বলছিল নিষ্প্রভ হয়ে। রাতের যমুনায় কুলুকুলু শব্দ হচ্ছিল। বাইরে ছিল ঝিঁঝি পোকাদের গান। নীরব নিস্তব্ধ রাত্রি যেন চাপা কান্নায় গুমরিয়ে কাঁদছিল। দেখলাম শিউলী ওর মায়ের পুরানো একটি শাড়ী পরে চৌকির এক কোনে ঘোমটা টেনে বসে আছে। ভাবলাম, কাল প্রত্যুষেই চলে যাব। এই সরলা বালিকাকে আজ রাতের বঞ্চনায় রেখে কি লাভ ? কাছে যেয়ে বললাম-
আমি: তুমি কি খুশি ?
শিউলী: হে।
আমি : কাল সকালে চলে যাব। কষ্ট পাবে না ?
শিউলী : হে।
আমি: আমাকে মনে রাখবে না ?
দেখি শিউলী অঝোর ধারায় কাঁদছে। ঘোমটা খুলে ওর মুখখানি দেখলাম। কেরোসিনের শিখার আলো এসে মুখে পড়েছে। এর আগেও এই বালিকাকে অনেক দেখেছি। চন্দ্রালোকের সকল মাধূর্য আজ যেন মুখে লেগে আছে। ওর চোখে জল, তারপরেও আলপনাহীন মুখখানি হিরন্ময় লাগছিল। ওকে বুকে টেনে নেই।
সকালবেলা যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন শিউলী বলেছিল – ‘আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না।’
পর্ব দুই :
থাই এয়ারওয়েজের বিমানটি লস এ্যাঞ্জেলেসের লাক্স এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল গ্রামের্সি প্লেসের একটি হোস্টেলে। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই সেখানে। অচেনা শহর, কোনো সজ্জন নেই। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে রিপোর্ট করি। ঠিক তৃতীয় দিনে ওয়েস্টার্ন বেলভিউতে রোড ক্রসিংএর সময় একটি লরি আমাকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দেয়। যখন আমার জ্ঞান ফেরে দেখি একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। শুনেছি আমি নাকি একমাস অজ্ঞান ছিলাম। বেশ স্মৃতিভ্রম হয়ে গিয়েছিল। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়। বাম পায়ের হাড় ভেঙ্গে যায়।
হাসপাতালে আমাকে একটানা এক বৎসর চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমার স্কলারশীপ প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে যায়। হাসপাতালে মেক্সিক্যান বংশোদ্ভূত এক নার্স আমাকে নিবিড়ভাবে সেবা করে। সে ছিল পঞ্চাশোর্ধ এক বিধবা মহিলা, নাম রেবেকা উইন্টার। যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়, এই রেবেকা উইন্টারই তার বাসায় নিয়ে যায়। সে আমাকে তার বাসায় রেখে সেবা করে। আমাকে ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হতো। রেবেকা তার সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ আমার চিকিৎসার পিছনে খরচ করে।
আমার পুরোপুরি স্মূতি ফিরে পেতে তিন বছর লেগে যায়। আসার পর থেকে বাংলাদেশের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমি স্মরণে আনতে পারি নাই — মাস্টারমশাইয়ের কথা, শিউলীর কথা।
একদিন গীর্জায় গিয়ে খ্রীষ্ট ধর্ম মোতাবেক রেবেকাকে বিয়ে করি। আরো তিন বছর চলে যায় পঙ্গুত্ব অবস্থায়। ইতোমধ্যে রেবেকা ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজেকে নিঃস্ব ও একাকী লাগছিল। ভাবলাম, আর কার জন্য এদেশে থাকব ? রেবেকাই নেই। আমি দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
পর্ব তিন. :
ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমে কেমন যেন উদাস লাগছিল। এই শহরে একজন আপন মানুষ নেই যে সেখানে গিয়ে উঠব। পল্টনে একটি হোটেলে যেয়ে উঠি। ভাবলাম কাল সকালবেলাতেই মাস্টার মশাইয়ের ওখানে চলে যাব। ট্রেন চলছে জগন্নাথগঞ্জের ঘাটের দিকে। কামড়ার মধ্যে বসে ভাবছিলাম– শিউলী কি আমার কথা মনে রেখেছে ? শিউলী কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে ? শিউলী কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে ?’ ট্রেন জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যেয়ে থামে। যমুনার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে উল্লা গ্রামের দিকে চলতে থাকি।
তখন বিকাল হয়ে গিয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছতেই দেখি কাঁঠাল গাছের তলায় একটি বালিকা দু’টি ছাগল ছানাকে কাঠালপাতা খাওয়াচ্ছে। পরনে তার সালোয়ার কামিজ। দেখতে একদম শিউলীর মতো। আমাকে দেখে বালিকা থমকে দাঁড়িয়ে যায়। আমি বিস্ময়ে দেখছিলাম– সেই শিউলীর চোখ, শিউলীর চুল, শিউলীর নাক, সেই চাহনি, সেই রকমই মুখের মায়া ! আমি ওর কাছে যেয়ে বলি–‘ তোমার নাম কি ? মেয়েটি বলে- ‘রূপালী’। বলি -‘তোমার মায়ের নাম কি ?’ ও বলে- ‘শিউলী বেগম।’ আমার চোখ ছল ছল হয়ে ওঠে। ওকে বলি- ‘তোমার বাবার নাম কি ?’ রূপালী তখন আমার নাম বলে। রূপালীকে বলি–‘তোমার মা কোথায় ?’ বাড়ির ভিটার পিয়ারা গাছের তলা দেখিয়ে বলে- ‘ঐখানে মাটির নীচে শুয়ে আছে।’
আমাদের কথাগুলো শুনছিল বারান্দায় বসে থাকা এক অন্ধ বৃদ্ধা। উনি মাস্টার মশাইয়ের স্ত্রী। সে আমার কন্ঠ শুনে চিনতে পারে। রূপালীকে ডেকে বলে – ‘রূপা, তুই চিনতে পারছিস না ? উনি তোর বাবা।’ আমি রূপালীকে বলি– ‘মামনি আমার হাত ধরো, চলো ঐ পিয়ারা গাছের তলায়। তোমার মায়ের আত্মার শান্তির জন্য এসো আমরা প্রার্থনা করি।’
~ কোয়েল তালুকদার