ইডিয়ট
একদিন অফিসের ঠিকানায় একটি চিঠি পাই। খামের উপর হাতের লেখা দেখে চিনতে পারিনি — চিঠিটি কে পাঠিয়েছে। খাম খুলে চিঠিটা পড়তে থাকি ।
কল্যাণীয়ষু রঞ্জন,
জানিনা তুমি কেমন আছো? অনেক কষ্ট করে তোমার ঠিকানা আমি যোগাড় করে এই পত্রখানা লিখছি। অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, এই ঠিকানায় তুমি চিঠি পাবে কিনা? তবুও লিখলাম।
কতগুলো বছর চলে গেছে। তোমার সাথে আমার দেখা নেই। হিসাব করে দেখলাম পঁয়ত্রিশ বছর। এই পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তোমাকে দেখি না।
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ঠিকানা দিলাম। সময় করে যদি একবার আসতে খুব খুশি হতাম। ভালো থেকো।
ইতি — নীলোৎসী।
নীলোৎসী ছিল আমার সহপাঠী। ওর পুরো নাম কাজী নাদিরা বেগম। ক্লাসের সবচেয়ে রূপবতী মেয়ে ছিল সে। তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের ছাত্রী ছিল। ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইত। আবৃত্তি, বিতর্ক, নাচও করত। ক্লাসের এক ডজন ছেলের মতো আমিও তার এক তরফা প্রেমিক ছিলাম।
আমিও আবৃত্তি করতাম, বিতর্কে অংশ নিতাম , সৌখিনভাবে নাটকেও অভিনয় করতাম। আমাকে তাই নীলোৎসী একটু পাত্তা দিত। অন্য ছেলেদের চেয়ে আমার সাথে সে বেশিই মিশত। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনো দিন সাহস করে নীলোৎসীকে বলিনি — ”তোমাকে আমার ভালো লাগে”। আর — ”তোমাকে আমি ভালোবাসি” এই কথা বলা তো অনেক দূরের আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার মতো ছিল । তাই ঐ ছায়াপথে কখনও হাঁটতাম না। ‘
নীলোৎসী ছিল অভিজাত পরিবারের মেয়ে। ঐ সময়ে সে গাড়িতে করে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করত। প্রতিদিন এক একটা নতুন জামা পরত। বেশির ভাগ সময় ব্যান্ড দিয়ে চুল বেঁধে খোলা চুলগুলো পিছনে ঝুলিয়ে রাখত। কোরিডোর দিয়ে যখন হীল জুতা পরে খটখট করে হাঁটত তখন চুলগুলো হাওয়ায় উড়ত।
সে যাই হোক — আমিই ওর ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। ক্লাস অবসরে আমার সাথেই ও কথা বলত। ক্যান্টিনে যেয়ে মাঝে মাঝে সিঙারা চা খেতাম। এই পর্যন্তই।
একদিন সেমিনার রুমের সামনে কোরিডোরে দাঁড়িয়ে নীলোৎসীকে বলেছিলাম — “তুমি নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, নীলের সাথে মিলিয়ে চুড়ি, মালা, চুলের ক্লীপ পরে একদিন ক্লাসে আসবে। তোমাকে আশ্চর্য রকম রূপবতী লাগবে। এই রূপে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।” নীলোৎসী হঠাৎ এই কথা শুনে বিস্ময় চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলেছিল — ‘আচ্ছা, নীল শাড়ি, নীল টিপ পরে আসব একদিন।’
নীলোৎসী নীল শাড়ি পরে আর ক্লাসে আসেনি। কারণ, এর পরপরই বাবা মার পছন্দ মতো একটি অপরিচিত ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়। নীলোৎসী ছিল বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে ভুল করে নাই। ওর স্বামী ছিল বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের পুরো পরিবার ছিল প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তশালী। বিয়ের পর নীলোৎসী আর ইউনিভার্সিটিতে আসেনি। দেখাও হয়নি আর কোনদিন। ওর সাথে কোনো যোগাযোগও হয়নি আর।
নীলোৎসীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। কোনো কিছু ভালো লাগত না। ক্লাসে পড়ায় মন বসত না। সহপাঠীদের সাথে ভালোভাবে কথা বলতাম না। নিজের কাছে মনে হতো — “আমি মনে হয় নীলোৎসীকে ভুল করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।” আমার এই মনমরা ও উদাস অবস্থা দেখে সহপাঠীরা পরিহাস করে বলত — “তুই একটা ইডিয়ট। কোনো একটা মেয়ের একটু কথা বলাকে, একটু মেলামেশাকে, একটু বন্ধুত্বকে মনে করেছিস প্রেম। তুই নির্বোধ ছাড়া আর কিছু না ! ”
আমারও তাই মনে হয়েছে — আমি সত্যি একটা ইডিয়ট। একটা মায়া লাগা ঘোর, একটা মিছে স্বপ্ন দেখা, একটা অবাস্তব চাওয়া — আর না পাওয়ার বেদনায় নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিলাম। ভুলে যেতে চাইলাম সব মিছে মায়া, মিছে স্বপ্ন। ভুলেও গেলাম। আমি যে একটা ইডিয়ট ছিলাম, এই ভেবে নিজেকে মনে মনে তিরস্কারও করলাম।
তারপর চলে গেছে পঁয়ত্রিশ বছর। নীলোৎসী কোথায় থাকে, কেমন আছে, কী করে কিছুই খোঁজ খবর জানতাম না।
আজ এত বছর পর সেই বিস্মৃত হয়ে যাওয়া নিলোৎসীর চিঠি পেলাম। কেমন যেন লাগছে আমার। একবার মনে হলো — কেন যাব? যেতে বলল দেখেই যেতে হবে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, নীলোৎসী আমার কিছু না হোক, সে তো আমার সহপাঠী ছিল। এই একটি দায় তো আমার চিরকালের হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, নীলোৎসীকে দেখতে যাব। ওকে তাই একটা চিঠি লিখলাম —
কল্যাণীয়াসু নীলোৎসী,
আমি আগামী ২৭ আশ্বিন, বৃহস্পতিবার তোমার ওখানে আসছি। আমি এখান থেকে ভোরে রওনা হবো। রাস্তায় কোনো অসুবিধা না হলে তোমার ওখানে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব। আমাকে আবার ঐদিন বিকালেই চলে আসতে হবে।
আমি যে তোমার ওখানে যাচ্ছি, এই কথা আমার স্ত্রীকে বলছি না। তুমি আমার কেউ না, তুমি আমার কিছু ছিলে না, তারপরও তোমার কাছে যাচ্ছি একথা শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে। একটু মিথ্যা না হয় বললাম ওকে। বলব, একটা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি, আজই ফিরে আসব।
ভালো থেকো তুমি।
ইতি — রঞ্জন।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে একটি পাবলিক বাসে উঠে টাংগাইলের মধুপুর রওনা হই । মধুপুর গড় এলাকাতে একটি বাংলো বাড়িতে নীলোৎসী থাকে। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম — সেই কতকাল পড়ে নীলোৎসীকে দেখতে পাব। নীলোৎসী চিরকাল মানুষের কাছে থেকে ওর রূপের প্রসংশা কুড়িয়েছে। একটু ভয় লাগছিল — এক সময়ের এই মানস প্রতিমাটি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যায়নি? মুখে কপোলে পড়েনি বলিরেখা? আবার ভাবলাম, দেবীরা কখনও বুড়ী হয় না, ওরা চিরকাল চির যৌবনা থাকে ।
একসময় মধুপুর যেয়ে বাসটি পৌঁছে। আমি বাস থেকে নেমে একটি চার দোকানে চা খেতে খেতে নিলোৎসীর বাড়িতে ষাওয়ার পথটি দোকানদারের কাছে থেকে জেনে নেই। দোকানদার বলছিল, আপনি একটি টমটম নিয়ে যেতে পারেন, কিংবা রিকশায়। আমি একটি টমটম নিয়েই নিলোৎসীর বাড়ির দিকে যেতে থাকি ।
এলাকাটি সম্পূর্ণ গড় এলাকা। আমি যে রাস্তা দিয়ে টনটমে করে যাচ্ছিলাম, তার একপাশে বিস্তীর্ণ শাল, গজারি, গামারী, মেহগনি, জারুল গাছের বন। বনের ফাঁকেে ফাঁকে ছোট বড়ো মাটির টিলা আছে, দেখতে অনেকটা মালভূমির মতো লাগছিল। রাস্তার আরেক পাশে সমতল ফসলের ক্ষেত।
কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি একতলা বাংলো বাড়ি দেখতে পাই। বাড়িটার একদম কাছে গেলে গেটে একটি নাম ফলক দেখা গেল। ফলকে লেখা আছে — ‘নীলোৎসী’। বুঝতে পারলাম এটাই নীলোৎসীর বাড়ি। আমি টমটম থেকে নেমে পড়ি।
গেটের কাছে একজন দারোয়ানকে দেখতে পাই। এই বাড়ি যে নীলোৎসীর বাড়ি এটা জেনেও দাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করি, এটা কি মিসেস নাদিরা বেগমের বাড়ি?
— জ্বী। আপনার নাম কী? কোথা থেকে এসেছেন?
— আমার নাম রঞ্জন রহমান। ঢাকা থেকে এসেছি।
— ভিতরে আসুন। ম্যাডাম আপনার কথা আমাকে বলে রেখেছেন। বলেছে, ঢাকা থেকে আমার একজন মেহমান আসবে, তার নাম রঞ্জন রহমান।
দাড়োয়ান সোজা আমাকে বাংলোর ভিতরে নিয়ে যায়। ভিতর থেকে একজন পরিচারিকা বের হয়। দারোয়ান পরিচারিকাকে বলে, ইনি ম্যাডামের মেহমান। ড্রইংরুমে ওনাকে বসতে দাও। এবং ম্যাডামকে যেয়ে বলো — উনি চলে এসেছেন।
পরিচারিকা আমাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে চলে যায়। একটু পর ফিরে এসে বলে — ম্যাডাম আপনাকে ভিতরে যেতে বলেছে। উনি ওপাশে বারান্দায় বসে আছেন।
ভিতরে যেতে একটু দ্বিধাই করছিলাম। একটু শঙ্কাও লাগছিল , কোনো বিপদে পড়ব না তো ! এ কী সত্যি নীলোৎসী? নাকি অন্য কেউ? তবুও দুরু দুরু পায়ে ভিতরে বারান্দার দিকে চলে যাই। বারান্দাটির চারিদিকে গ্রিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে ওপাশে শাল গজারির নিবিড় বন। আসন্ন দুপুরের তপ্ত সূর্যের আলো ঝরে পড়ছে বনের পাতার ফাঁক দিয়ে। কিচিরমিচির করছে বনের পাখিরা। দেখি, একটি হুইল চেয়ারে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আমার আসার পথপানে করে বসে আছে। মুখখানি শুকনো এবং বিষণ্ণ সুন্দর। আমি চিনতে পারলাম, এই নীলোৎসী। আমাকে দেখে সে স্মিত হেসে বলে — ‘তুমি এসেছ রঞ্জন!’ পাশে একটা চেয়ার আগে থেকেই রাখা ছিল। আমাকে সেই চেয়ারটা দেখিয়ে বলল — তুমি এখানেই বসো।
নীলোৎসীর চেহারা আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার চোখে আঁটকে ছিল। একটি প্রস্ফুটিত ফুলের মতো চেহারা ছিল ওর। আজ ওকে দেখে আমার মনটা হুহু করে উঠল। এই সেই নীলোৎসী যে কী না একসময় শত তরুনের হৃদয় কাঁপাত ! সেই নীলোৎসী এত রোগক্লিষ্ট, এত মলিন হয়ে গেছে।
এত ভগ্ন শরীর নিয়েও সে আজ হালকা নীল রঙের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি পরে আছে। মুখে কোনো প্রসাধন করেনি। হাতে নীল পাথর বসানো চুড়ি পরেছে কেবল। আমার মনে পড়ে গেল– সেই কবে একদিন ইউনিভার্সিটির কোরিডোরে দাঁড়িয়ে ওকে বলেছিলাম —- তুমি একদিন নীল শাড়ি পরে ক্লাসে আসবে। নীলোৎসী বলেছিল — “আসব পরে একদিন।” কিন্তু নীলোৎসী আর নীল শাড়ি পরে আসতে পারেনি।
আজ কী আমাকে দেওয়া ওর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল?
খুব বেদনা ভরে নীলোৎসী আমাকে বলছিল —
তুমি কেমন আছো রঞ্জন? বললাম — আমি ভালো আছি।
— মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?
— তোমাকে দেখার পরই হয়ত এমনটা হয়েছে আমার। তোমাকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেছি আমি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। তোমার কী হয়েছে নীলোৎসী?
— লিভার সিরোসিস। লিভার গলে পঁচে গেছে। দুইবার স্ট্রোকও করেছে। তারপর থেকে প্যারালাইজডৃ হয়ে গেছি। হাসপাতালে ছিলাম অনেক দিন। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে — বাড়িতেই বিশ্রামে থাকেন। মাঝে মাঝে টাংগাইল থেকে ডাক্তার ডেকে এনে ফলোআপ করিয়ে নেই।
— তোমার স্বামী ও ছেলেমেয়ে কোথায়? কাইকে যে দেখছি না।
— স্বামী গত বছর মারা গেছেন। এক ছেলে এক মেয়ে দুজনেই বিদেশে থাকে। মেয়ে কানাডাতে আর ছেলে আমেরিকায়। দেশে ওরা কেউই আসে না। মেয়েটা একটু খোঁজ খবর রাখে। ছেলেটি একদম না। মনে হয় ওরা ওদের মন থেকে শিকড় উপড়ে ফেলেছে।
নীলোৎসী বলছিল — থাক ঐসব কথা। তোমার বউ কেমন আছে?
— ভালো আছে।
— খুব সুন্দরীী মেয়ে বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই।
— হুম। তোমার মতোই দেখতে।
— কী নাম ওর?
— মায়া।
— মায়াবতী নিশ্চয়ই?
— হুম।
— ছেলেমেয়ে কজন?
— এক ছেলে দুই মেয়ে।
— ছেলেটা দেখতে নিশ্চয়ই তোমার মতো হয়েছে?
— হুম।
— মেয়ে দুটো কার মতো?
— মায়ের মতো।
আমি নীলোৎসীকে বললাম, তা এই বন নির্জনে কেন আছ? শহর ছেড়ে এত দূরে?
— আমার স্বামী বন বিভাগেই চাকুরি করত। দেশের কত বনারণ্যে ঘুরেছি, থেকেছি। এখানে এই মধুপুর রেঞ্জেও ওর পোস্টিং ছিল। ও এই জায়গাটা খুব পছন্দ করেছিল। পেনশনের টাকা থেকে এই জায়গাটা কিনে এই কাঠের বাংলাটা তৈরি করেছিল। বলেছিল — আমাদের শেষ জীবনটা এই বনকুঞ্জেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা আর কাটাতে পারল কই? আমাকে একা করে ফেলে রেখে বিধাতা ওকে আমার কাছে থেকে নিয়ে গেল। এখন তো আমি নিজেই মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
আমি বললাম — জায়গাটা খুবই সুন্দর। একপাশে ঘন অরণ্য, আরেকপাশে ফসলের মাঠ। ছোট্ট সুন্দর একটি পুকুরও দেখলাম । পুকুর ভর্তি নীলপদ্ম ভরে আছে । সম্মুখে বাগান দেখলাম, রঙ্গন,জবা, চেরী , গোলাপ, বেলী ফুল সব ফুটে আছে।
নীলোৎসী বলছিল — পত্রে তুমি লিখেছ, আজই বিকেলে তুমি চলে যাবে। যদি তুমি থাকতে তাহলে বুঝতে পারতে এখানে কী সুন্দর রাত্রি নামে। সন্ধ্যার পরপরই আস্তে আস্তে পাখিদের কলকাকলি থেমে যায়। তারপর রাত নামতে থাকে। শাল গজারি মেহগনি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যায়। দূরে অজস্র নক্ষত্রবীথি। ঝোপে ঝাড়ে জোনাক জ্বলে। জ্যোৎসায় ভাসে বন প্রান্তর। ফুলের সুবাসে ভরে থাকে এই বারান্দা, চাঁদের আলোর রশনি এসে আমার চোখে মুখে লাগে। আমার কী যে ভালো লাগে তখন। আমি কান পেতে থাকি। কার যেন দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পাই। মনে হয় কেউ যেন হেঁটে হেঁটে আমার দিকে আসছে। আসলে কেউ আসে না। সবই ভ্রম!
নীলোৎসী বলছিল — কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে গেল। চলো– চারটা ডাল ভাত খেয়ে নেবে।
ও ওর পরিচারিকাকে ডাকতে যাচ্ছিল। আমি বললাম, কী জন্য ডাকছ? নীলোৎসী বলছিল, মেয়েটা এসে আমাাকে একটু ডাইনিং পর্যন্ত নিয়ে যাক।
আমি মেয়েটিকে ডাকতে দিলাম না। আমি নিজেই হুইল চেয়ারের পিছনে যেয়ে দাঁড়াই। এবং চেয়ারটা ধরে ঠেলে নীলোৎসীকে ডাইনিং রুমে নিয়ে আসি। নীলোৎসী হুইল চেয়ারে বসেই আমার সাথে খেতে বসে। কোনো রিচ খাবার নেই। সাদা ভাত, ডাল, ডাটা দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি, উস্তা ভাজা, টাকি মাছ ভর্তা আর কচুর লতি ও কাঁঠালের বিঁচি দিয়ে পুঁটি মাছের তরকারি। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, ও যখন আমার বন্ধু ছিল, তখন আলাপ প্রসঙ্গে নীলোৎসীকে আমার এই পছন্দের খাবারগুলোর কথা প্রায়ই বলতাম। ও কী সেই কথা আজ পর্যন্ত মনে রেখেছে তাহলে?
বিকাল হয়ে যায়। আমি নীলোৎসীকে বলি — আমার চলে যাবার সময় হয়ে গেছে। ও বলছিল — হ্যাঁ, তোমাকে থাকতে বলব না। তোমার মায়াবতীকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। তোমার প্রতি আমার অধিকার সেই কবেই হারিয়েছি। এখন শুধু মিছে মায়াটুুকু ছাড়া কিছু নেই। কয়দিন ধরে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। সেই কত বছর চলে গেছে। কত হাহাকার করেছি তোমাকে একটু দেখবার জন্য। এখন মনে হচ্ছে– মরেও শান্তি পাব। পরপারে তুমিও যখন যাবে তখন তোমাকে ঠিকই চিনে নিতে পারব।
আমি নীলোৎসীর অলক্ষ্যে আমার চশমার ফ্রেমের নীচে আঙুল দিয়ে চোখের কোণটা মুছে নেই। ওকে বললাম — আসি এখন।
নীলোৎসী বলছিল– আমার হুইল চেয়ারটা একটু দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাবে? আমি চেয়ারটি ঠেলে ওকে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাই। নীলোৎসী বলছিল -”আমার হাতটি একটু ধরে দাঁড় করাবে? আমি দরজাটা ধরে দাঁড়াব। দরজায় দাড়িঁয়ে তোমার চলে যাওয়া দেখব।” আমি ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেই। ও কষ্ট করে দরজাটা ধরে থাকে। দেখলাম, ওর হাত পা কাঁপছে ।
নীলোৎসীর হাতটা ভীষণ গরম লাগল, কপাল ছুঁয়ে দেখি — সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমি ওকে বললাম — তোমার তো অনেক জ্বর। এতক্ষণ তুমি কোন্ শক্তিতে বসে আমার সাথে কথা বললে?
নীলোৎসী বলছিল — ও কিছু না। এই রকম জ্বর প্রায়ই হয়। ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়। আর, তোমার হাতটা খুব শীতল ছিল — তপ্ত জ্বর তাতেই চলে যাবে।
আমি নীলোৎসীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। আসতে আসতে মনে হলো, পিছনে তাকিয়ে ওকে আর একবার দেখে নেই । বিদায় নিয়ে কারোর কাছে থেকে চলে আসার সময় নাকি পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। কিন্তু মন মানল না। আমি পিছনে মুখ ঘুরিয়ে নীলোৎসীকে আবার দেখলাম। ও দরজা ধরে আমার দিকে মায়া ভরে তাকিয়ে আছে।
ওর চোখে তখন কী জল ছিল? দূর হতে বোঝা গেল না।
**** ****