সন্ধ্যার মেঘমল্লার

মন্দিরে পূজা দিতে আসত সে। মন্দিরে এই আসা যাওয়ার মাঝে আর পথ চলতে চলতে পথের উপর তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।

সময়টা ছিল ১৯১১ ইংরেজি পরবর্তী কাল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর রেল বিভাগে আমার সহকারী টিকেট মাস্টার হিসাবে চাকুরি হয়। পোস্টিং হয় রাজবাড়ির গোয়ালন্দ ঘাট স্টেশনে।

একদিন এক হেমন্তের সকালে রানাঘাট জংশন থেকে একটি শাটল ট্রেনে করে প্রথমে কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনে আসি। পরে ওখান থেকে আর একটি লোকাল ট্রেনে করে সোজা গোয়ালন্দ ঘাট। আমার জীবনে প্রথম বিদেশ বিভূঁইয়ে আসা। এর আগে শুধু কলিকাতা পর্যন্ত গিয়েছি। আসার সময় মাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না! মা আমার কান্না দেখে বলেই ফেলেছিল — ‘তোমার চাকুরি করার দরকার নাই।’ কিন্তু বাবা ছিল নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত চাকুরিতে যোগদান করতেই হল।

স্টেশনে কর্মচারিদের থাকার কোনো আবাসস্থল ছিলনা। সেটশন মাস্টার মশাই তার এক পরিচিত পুরোহিতকে বলে স্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে পদ্মা তীরবর্তী একটি গ্রামের মন্দিরের অব্যবহৃত একটি ছোট্ট ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। রান্না বান্না নিজেকে করেই খেতে হবে।

স্টেশন থেকে পদ্মার তীর ধরে মেঠোপথে গ্রামটিতে যেতে হয়। রাস্তার দুপাশে আম কাঁঠালের বাগান। ঘন গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকে। আবার কখনো খোলা ফসলের মাঠ। সরিষা,কলাই, আখ আর আমন ধানের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আবার পদ্মার তীর ধরে ছোট ছোট গ্রাম। জেলে পাড়া, কুমার পাড়া, মালো পাড়া, ছুতার বাড়ি। এইসবের ভিতর দিয়েই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরের ঐ বাড়িটায়।

পুরোহিত মশাই আমার নাম ধাম জিজ্ঞাসা করলেন।
বললাম, নাম– শ্রী অরুণ চন্দ্র বসাক। সাকিন– মায়াপুর, নদীয়া।

পুরোহিত মশাই একটু করুণা করলেন। খুবই অভুক্ত ছিলাম। তিনি এইবেলায় নিরামিষ দিয়ে ভাত খাওয়ালেন। একটা মাটির ভাতের পাতিল ও একটি তরকারির পাতিল দিলেন। একটি মাটির কড়াইও দিলেন। মা আসার সময়ে বেডিং এ কাঁথা বালিশ দিয়েছিলেন। খুলে দেখলাম- একটি এ্যালুমিনিয়ামের প্লেট, একটি পিতলের গ্লাস, একটি চামচ ও লবনদানি দিয়ে দিয়েছেন।

মাটির ঘর। উপরে ছোনের চালা। ভিতরে একটি পুরাতন কাঠের চোকি পাতা আছে। এক কোণে মাটির হেঁসেল। কিছু পাট শোলা ও ঘসি রয়েছে। আমি কাঁথা বিছিয়ে নেই চোকিতে। খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিছানায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নেই। কখন ঘুমিয়ে যাই জানতে পারিনি।

সন্ধ্যায় মন্দিরের শঙ্খধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে যায়। জেগে দেখি- ঘর ভর্তি অন্ধকার। বিছানা থেকে উঠে হেঁটে মন্দিরের দিকে চলে যাই। একজন সেবকের কাছ থেকে একটি কেরোসিনের কুপী ও দেয়াশলাই চেয়ে নেই। ঘরে এসে নিজেই সন্ধ্যাবাতি জ্বালাই। এই সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়েই একজন বিশ একুশ বছরের একাকী তরুণের সংসার যাত্রা শুরু হল।

প্রতিদিন স্টেশনে যাই। স্টেশন থেকে আবার এই মন্দির সংলগ্ন মাটির ঘরে ফিরে আসি। পথে যেতে আসতে কত বাড়ি দেখি। কত মানুষ, কত বৃক্ষের ছায়াতল দিয়ে কত পথ হাঁটি। কত পাখির ডাক শুনি। কখনো পথ চলতে চলতে মায়াপুরের কথা মনে পড়ত। মনে পড়ত মার কথা।

আমার ঘরটি মন্দির থেকে সামান্য দূরে পথের ধারে। ঘরের পাশ দিয়ে লোকজন হেঁটে মন্দিরে আসা যাওয়া করে । ঠিক একটু পরেই পুকুর। পুকুর পাড় জুড়ে আম কাঁঠাল বেল লিচু ও জাম গাছ বেষ্টিত। ঘাটও আছে। পরিস্কার জল। এই পুকুরে কেউ স্নান করে না। সারা গায়ের মানুষ এর জল খাওয়ার জল হিসাবে ব্যবহার করে।

সেদিন ছিল ছুটির দিন। ঘরে বসে বসে বাবার কাছে পত্র লিখলাম —
পরম পূজনীয় বাবা,
পত্রে আমার প্রণাম জানিবেন। মাকেও প্রণাম জানাইবেন। পর সমাচার এই যে, আমি এখানে ভালোভাবে পৌঁছিয়াছি। এখানে এক মন্দিরের পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হইয়াছে। আমার একটুও ভালো লাগে না। নিজেকে রান্না করিয়া খাইতে হয়। মার কথা খুব মনে পড়ে।

আমার আরও কিছু চাকুরির দরখাস্ত ও ইন্টারভিউ দেওয়া আছে। যদি কোনো খবর হয় সত্বর জানাইবেন।আমার জন্য আশীর্বাদ করিবেন। ঠাকুর সবার মঙ্গল করুক।
ইতি — আপনার স্নেহের অরুণ।

সন্ধ্যায় ঘরের ছোট্ট কাঠের জানালাটি খুলে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, কয়েকজন মহিলা মন্দিরের দিকে আসছে। তখন শঙ্খধবনি বেজে উঠেছে। আমার ঘরের পাশ দিয়ে তারা হেঁটে চলে গেল মন্দিরে। একজন শুধু জানালার কাছে থেমে গেল।

সে ছিল একজন বিধবা রমণী। আমার দিকে তাকিয়ে সে বলছিল —
‘আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি প্রতিদিন হেঁটে যাও, আমাদের বাড়ির আঙিনার পাশ দিয়ে। আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখি। তুমি আমাকে দেখতে পাও না।’ এই কথা বলে, রমণীটি মন্দিরের দিকে চলে গেল।

আমি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অন্ধকার হয়ে ঘরটি আঁধার হয়ে আসছিল। কেরোসিনের শিখাটি জ্বালিয়ে নেই । বিছানায় শুয়ে শুয়ে আলো আঁধারে ঐ রমণীর দেহ রূপটি দেখছিলাম– সুশ্রী গৌড় বর্ণ, হাত দুটি অনাবৃত অনন্ত শাঁখাহীন। সকালের কমলা রোদ্দুর ছিল গায়ে। পরনের শাড়ি রজনীগন্ধার মতো সূচি শুভ্র। তার নির্মল রূপ সন্ধ্যার সৌন্দর্যকে সীমারেখা টেনে দিয়েছে।

হৃদয়ের রক্তের স্পন্দন কেমন যেন থেমে থেমে আসছিল। আমি নিশ্চুপ হয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে রইলাম।

পরের দিন পরিচিত পথ দিয়ে স্টেশনে না যেয়ে পদ্নার পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। নদীর জল স্রোতের টানে ধেয়ে চলছিল। স্রোতের উজান বেয়ে গুণ টেনে মাঝিরা নৌকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত নদীর উপর আকাশ জুড়ে ছিল নীল মেঘ। মেঘগুলো কখনো দেখতে লাগছিল ধূসর, পরেই আবার কালো হয়ে উঠতে লাগল।

কালকের সেই বিষণ্ণ সন্ধ্যার একটি মুখ এই স্রোতের টানে, ঐ মেঘের ভিতর ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। সবকিছুর ভিতর কেমন বিলুপ্তপ্রায় অন্ধকার আম কাঁঠালের ঘন অরণ্যের ভিতর হারিয়ে যাছিল সেই অপূর্ব সুন্দর নিষ্পাপ মুখখানি।

বিকালে মন্দিরে ফিরছিলাম চেনা পথ ধরে। আম কাঁঠাল আর শুপারি গাছের সারি ঘেরা মালো বাড়ির কাছে আসতেই কালকের সেই রমণী হঠাৎ আমার পথের পাশে এসে দাঁড়ায়, একটি খাবারের টোপলা আমার হাতে দিয়ে বলে — এখানে খেজুর গুরের সন্দেশ ও নারিকেলের নাড়ু আছে। ‘ তুমি এগুলো খুব পছন্দ করতে, তুমি খেয়ে নিও।’ এ কথা বলেই সে বাড়ির ভিতর চলে যায়।

বাকী পথটুকু আসতে আসতে আসতে ভাবলাম, আমি যে খেজুর গুরের সন্দেশ আর নারিকেলের নাড়ু পছন্দ করি, তা উনি জানল কী ভাবে?

এই অকাল বিধবা মেয়েটির সম্বন্ধে একটু জানবার চেষ্টা করলাম, তার নাম- সন্ধ্যা রাণী। স্বামী — স্বর্গীয় কার্তিক চন্দ্র কৈবর্ত। বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামী কলেরায় মারা যায়। একটা পুত্র সন্তান আছে। সে এখনও শ্বশুর বাড়িতেই থাকে।

পরেরদিন সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যা রাণী মন্দিরে আসে প্রসাদ দিতে। তখন আবছা আলো, আবছা অন্ধকার। আজও সে আমার ঘরের জানালার কাছে এসে থেমে যায়। সে প্রসাদের একটি টোপলা আমার জন্য আলাদা করে এনেছিল। সেটি আমার হাতে দিয়ে বলে — ‘এর ভিতরে মালপোয়া পিঠা, প্যারার ছাতু আর খেজুর গুর আছে। তুমি এগুলো খেও। তুমি মালপোয়া পিঠা খুব পছন্দ করো, তাই নিয়ে এলাম।’

এগুলো দিয়ে সন্ধ্যা রাণী দ্রুত মন্দির ভিতর চলে যায়। চলে যাওয়ার পর ভাবছিলাম, আমি তো মালপোয়া পিঠা খুব পছন্দ করি। মাকে প্রায়ই বলতাম — মালপোয়া পিঠা বানিয়ে দিতে।

তখন অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক। স্টেশন থেকে ফিরে আসতে সন্ধ্যা রাত্রি হয়ে যায়। বেশ শীত, এবং কুয়াশা পড়েছে। রাস্তার পাশের বনফুল, ভাঁট ও কুঁচচন্দনের গন্ধ আসছে। রাস্তা নির্জন, কেউ কোনো দিকে নেই। কৈবর্ত বাড়ির কাছে আসতেই দেখি, লিচু গাছের আড়ালে সন্ধ্যা রাণী দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই আমার হাতে একটি কাঁথা দিয়ে বলল —
‘বেশ শীত পড়েছে। তোমার ঠান্ডা লাগবে। এই কাঁথাটা দিলাম। তুমি গায়ে দিও।’

আমার এখান থেকে স্টেশনে যাওয়ার দুটো পথ। একটি পদ্মার পাড় ধরে, আর একটি গ্রামের ভিতর দিয়ে মাঠ পেড়িয়ে। যখন যেটা মন চায় আমি সেই পথ দিয়েই আসা যাওয়া করতাম। তবে বেশিরভাগ যেতাম পদ্মার কূল ধরে, আর ফিরে আসতাম গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে।
সন্ধ্যা রাণীর বাড়ির কাছে আসলেই মনটা একটু উতলা হয়ে উঠত। ভাবতাম সে হয়ত দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো দিন তার দেখা পেতাম, কোনো কোনো দিন দেখা হত না। বুঝতে পারতাম, বাড়ির লোক কাছাকাছি থাকলে সে পথের পাশে আসত না। হয়ত দূরে আড়াল থেকে আমাকে দেখত।

একবার খুব জ্বর হয় আমার। কয়েকদিন অফিসে যেতে পারি নাই। সন্ধ্যা রাণী হয়ত আমাকে দেখবার জন্য পথের ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আমাকে দেখতে না পেয়ে কারোর কাছ থেকে জানতে পেরেছে আমার জ্বর হয়েছে। একদিন সে মন্দিরে পূজা দেওয়ার নাম করে চলে আসে। তখন কালী সন্ধ্যা। অন্য কারোর অলক্ষ্যে সে আমার ঘরে প্রবেশ করে। সিওরে তখন কেরোসিন শিখা জ্বলছিল। সেই আলোয় আমি সন্ধ্যার মুখখানি দেখতে পেলাম। কেমন বিমর্ষ ও শুকনো সে মুখ! কাঁদিলে চোখের পাতা যেমন ভারী হয়, তেমন তার মুখখানি মলিন হয়ে আছে।

সে কিছু পথ্য এনেছিল। কবিরাজের কাছে থেকে
জ্বরের বটিকাও এনেছে। আমার কপালে সে হাত রাখে। দেখে জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ সে কলসী থেকে বাটিতে জল ঢেলে তার শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমার কপালে জলপটি দিতে
থাকে।

সে সন্ধ্যা রাতে সন্ধ্যা রাণী আমাকে মায়ের মতো সেবা সুশ্রুষা করেছিল।

একদিন অপরাহ্ণে কৈবর্ত বাড়ির পথ ধরে ঘরে ফিরছিলাম। খুব সুনশান নির্জন লাগছিল চারদিক। আমবাগানে পাখিগুলো শ্রান্ত সুরে কিচিরমিচির করে ডাকছিল। মনে হল এই জীবন এমনই স্নিগ্ধ ছায়াশীতল পাখির গানে ভরা, অপরাহ্ণের ঐ পাখির গানের মতো স্নিগ্ধ শান্ত। চারদিকে বৃক্ষের পত্র পল্লবে উপর তখন বিকালের রৌদ্র পড়ে চিকচিক করছিল।

সন্ধ্যা রাণীর বাড়ির কাছে আসতেই আমার দুচোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাকে। দেখলামও, সে অর্ধেক ঘোমটা টেনে পুকুরের চালায় জবা ফুলের ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে কাছে এগিয়ে আসে। ঘোমটা অনাবৃত করে ফেলে। শান্ত মায়াদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আজ এই অপরাহ্ণের আলোয় তার মুখ ঝিকমিক করছিল। ঠোঁট দুটো বিনম্র, কিন্তু কম্পিত।
এমন সুশ্রী মুখশ্রী আমি কখনো দেখিনি। মনে হল তাঁর ডাগর কালো চোখদুটির অন্তরালে অতল দীঘির জল। তার সমস্ত দেহ গড়নে বৈচিত্রে ভরা, সব মিলে সন্ধ্যা রাণীকে অপূর্ব সৌন্দর্য-শোভা-মন্ডিত লাগছিল। খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ ছিলাম।

আমি একটু দ্বিধা করছিলাম, কেউ না আমাদের দেখে ফেলে। সেই বলছিল — ‘কেউ নেই। সবাই গেছে পদ্মায় ইলিশ ধরতে।’
সে আরও বলছিল, তোমাকে আমার মায়া লাগে কেন, জানো?
— না, আমি জানি না।
— তোমার মুখচ্ছবি অবিকল আমার মৃত স্বামীর মতো। তাই তোমাকে আমি চেয়ে দেখি। তোমাকে মায়া করি। তোমাকে সেবা যত্ন করতে ইচ্ছে করে।’
— তোমাকে আমার দিদির মতো লাগছিল। আমার তো কোনো দিদি নাই।
— তা ভাবো। আমি তোমাকে স্বামী দেবতা জ্ঞান করি।
— আমি কী তোমাকে দিদি ডাকব?
— না, তুমি আমাকে ‘সন্ধ্যামণি’ ডাকবে। আমার স্বামী আমাকে এই নামে ডাকত।
— আমি যাই।
— একটু দাঁড়াও।

সন্ধ্যামণি ঘোমটা টেনে আমার কাছে এসে আমাকে প্রণাম করে। আমি বলি– ‘কী করছ তুমি! আমি তোমার চেয়ে বয়সে ছোট। আমার পা ছুঁয়ো না। আমার পাপ হবে।’
— আমি পাপ পূন্য জানি না। আমি জানি তুমি আমার স্বামী।

ঘরে তেমন খাবার ছিল না আজ। খেলামও না কিছু। না খেয়েই শুয়ে পড়ি। ঘুম আসছিল না চোখে। রাত্রি গভীর হতে থাকে। পুকুর পাড়ের আমগাছে বসে প্যাঁচা ডাকছিল অমঙ্গল সুরে । বাইরে ঝিঁঝি পোকাদের ঝিঁঝি শব্দ কেমন ক্রন্দনধ্বনির মতো লাগছিল। আমি যখন সন্ধ্যামণির কাছে থেকে আসি, তখন তার চোখ জলে ভরা ছিল! মনে হয়েছিল কোন্ দেবালয়ের এক নিষ্পাপ দেবীমূর্তি সে। তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারিনি। আমিও অশ্রুসিক্ত ছিলাম।

সকালে পদ্মার কূল ধরে হেঁটে হেঁটে স্টেশনে চলে যাই। আজ পদ্মার জল, মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, নদীর উপর নীল আকাশ, কোনো কিছু ভালো লাগছিল না। বিষণ্ণ চিত্তে অফিসে আসি।

টিকেট ঘরে বসে আছি। আজ যাত্রীদের তেমন ভীড় নেই। দু একটা করে টিকিট বিক্রি হচ্ছিল। কর্মের মধ্যেও বিষণ্ণতা কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না!

ঘুরে ফিরে শুধু সন্ধ্যামণির কথাগুলো কানে বাজছিল।ভাবছিলাম, এ কী করে সম্ভব?

ডাকপিয়ন একটি চিঠি দিয়ে যায়। বাবা লিখেছে —

কল্যাণীয়েষু অরুণ,
স্নেহ নিও। আশা করি ঠাকুরের কৃপায় ভালো আছো। তোমার একটি সুখবর আছে। তহশিলদার পদে আজই তোমার একটি নিয়োগ পত্র পাইলাম। কল্যাণীতে তোমার পোস্টিং। তুমি যদি এখানে যোগদান করতে চাও, পত্রপাঠ তুমি চলিয়া আসিবে। বাড়ির সবাই ভালো আছে।
ইতি — তোমার পিতা।

আমি সাথে সাথে স্টেশন মাস্টারের মাধ্যমে কোলকাতা আঞ্চলিক রেল আধিকারিকের বরাবর পদত্যাগ পত্র জমা দেই। পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত ছুটির দরখাস্ত দেই। বলি, পদত্যাগ পত্র গৃহীত হলে আমাকে পত্র দ্বারা অবগত করবেন।

আমার ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়।

অফিসের যাবতীয় হিসাব নিকাশ ও কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সহকর্মীদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা রাত্রিতেই ঘরে চলে যাই।

মন্দিরে গিয়ে পুরোহিত মহাশয়ের কাছে থেকে বিদায় নেই। এবং বলি আমার নতুন চাকুরি হয়ে যাবার কথা। আরও বলি, আমি প্রত্যুষেই চলিয়া যাইব।

রাতেই বাক্স পেটরা গুছিয়ে রাখি। ভোরে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ভাবলাম, পদ্মার কূল ধরে না যেয়ে আজ গ্রামের মেঠো পথ দিয়েই স্টেশনে যাব। যদি সন্ধ্যামণির একটু দেখা পাই!

কৈবর্ত বাড়ির সামনে গিয়ে পা থেমে যায়। একটু দাঁড়ালাম। চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, কোথাও সন্ধ্যামণি আজ দাঁড়িয়ে নেই। আমগাছের পিছনে, লিচু তলায়, পুকুর পাড়ে জবাফুল ঝাড়ের আড়ালে – কোথাও নেই।অন্য কোনো আড়াল থেকেও সে আমাকে হয়ত দেখছে না! এখন যে অসময়। এই পথ দিয়ে এখন আমার চলে যাবার কথা নয়।

ধীর পায়ে সামনের দিকে এগুতে থাকি। পা কেমন
যেন অসার হয়ে আসছিল। তাল-শুপারি বাগানে বসে আজ কোনো পাখি ডাকল না। চালতা, গাবফুল, ভাঁটফুল, কুচচন্দনের কোনো গন্ধ এল না কোথাও থেকে। আস্তে আস্তে হেঁটে বৃক্ষরাজির ছায়া পেড়িয়ে খোলা প্রান্তরে যেয়ে পৌছলাম।

পূবের সূর্যের রোদ পড়ে ঝলমল করছিল ফসলের ক্ষেত। দূর পদ্মা থেকে বয়ে আসছিল শীতল বাতাস। অসরতা ভেঙে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম স্টেশনের দিকে।

তারপর পঁয়ত্রিশ বছর চলে গেছে।
তারপর জীবনে কত কিছু পেলাম। কত ডিগ্রি নিলাম। কত বড়ো কর্তাব্যক্তি হলাম। কত বড়ো ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলাম। কত শিক্ষিত সে। কত দেশ ঘুরেছি।
কত মানুষ দেখেছি। কত মৌন নদী। কত পর্বতেের গাত্রে দেখেছি কত লতাগুল্ম, পাহাড়ি ফুল। কত পূর্ণিমা রাত্রি উপভোগ করেছি।

সবকিছুর ভিতর একজন অনাদৃত, একজন উপেক্ষিত, একজন দলিত বিধবা মেয়ের মুখ মনে পড়েছে। কত রাশি রাশি আনন্দের মাঝে, সেই কবেকার কতদূরের এক পল্লীবালা অপার্থিব অশ্রু ঝরিয়ে গেছে আমার জীবনের সকল আনন্দ বেদনার উপর।

এখনো কী সন্ধ্যার মেঘমল্লারে সেই অনাদরের সন্ধ্যামণি ফুলটি অশ্রু জলে ভেজে?

~ কোয়েল তালুকদার

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত