ঘুমিয়েছিলাম কতোক্ষণ মনে নেই।
মনে হলো মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কে যেন দু’বার ডাকল, আপা। আপা।
– কে? ভয়ার্তস্বরে প্রশ্ন করলাম।
– আমি।কান্নার মতো এক কিশোরী কণ্ঠ।
– আমি কে? তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন?
-কন্ঠটা আমার পরিচিত। স্মৃতিটা হাতড়ে ফিরছি। না, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। মাথায় আসছে না কিন্তু মনে আছে।
-আপা আমি শান্তা।
-শান্তা? কোন শান্তা?
-আপনার ছাত্রী ছিলাম।
হঠাৎ মনে পড়ল এক চঞ্চল বালিকার মুখ। তিন চার বছর আগে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো।
স্কুলের যে কোন অনুষ্ঠানে সবার আগে থাকতো। চড়ুই পাখির মতো উড়ে উড়ে চলতো।
কতোদিন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বকেছি। লাফিয়ে লাফিয়ে চলতো বলে।
-এই শান্তা, এভাবে এক সিঁড়ি বাদ দিয়ে লাফিয়ে চলছিস কেন? পা না ভাঙ্গলে শান্তি হচ্ছে না?
-সেই স্বভাবসুলভ হাসি। আমি তো এভাবেই চলি আপা।
বর্ষার এক দুপুরে মেয়েগুলোর মন ছিল না ক্লাসে।
ঝুম বৃষ্টি বাইরে।
এমন ঝুম বৃষ্টিতে শৈশবে কতো ভিজেছি।
ছেলেমেয়ে একসাথে পড়তাম আমরা।
বৃষ্টি শুরু হলে শিক্ষক কিছুতেই ক্লাসে ধরে রাখতে পারতেন না। ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ নেই। হৈ হৈ করতে করতে দে ছুট স্কুলের মাঠে।
ওরা আমাদের সময়ের চেয়ে ভালো। ওদের ইচ্ছে করছে ভিজতে বুঝতে পারছি কিন্তু আমাকে ফেলে কেউ ক্লাস ছেড়ে চলে যাচ্ছে না।
-বললাম, চল আমরা মনে মনে বৃষ্টিতে ভিজি।
সবাই আনন্দ ধ্বনিতে ক্লাস মুখরিত করে মেডিটেশনের ভঙ্গিতে বসল।
প্রায়ই মনে মনে এমন খেলা চলে। হারিয়ে যাওয়ার অনুশীলন চলে। তাই নিঃশ্বাস নেয়া এবং ছাড়া বুঝিয়ে বলতে হলো না। ওরা আমার বলার আগেই প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে সোজা হয়ে বসল।
-বললাম, মনে করো নদীর তীরে খোলা এক বিশাল মাঠ। সে মাঠে সবাই মিলে দৌড়াচ্ছ।
বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা পানি মেখে সবাই একাকার।
কেউ বকা দিচ্ছে না।
দৌড়াও, বল খেলো, হা- ডু-ডু খেলো। যেমন খুশি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খেলো।
বৃষ্টিস্নান শেষে একসাথে হর্ষ ধ্বনিতে সবাই চোখ খুললো।
নগর জীবনে মাঝেমাঝেই এভাবে ক্লাসে আমরা হারিয়ে যাই প্রকৃতির মাঝে।
বৃষ্টি তখনও শেষ হয়নি।
মেয়েগুলোকে বললাম, এবার বড় হয়ে কে, কী হতে চাও সেটা লেখ। কেন হতে চাও সেটাও লিখতে হবে।
সবাই অতি উৎসাহ নিয়ে লিখতে বসে গেল তাদের ভবিষ্যৎ পেশা।
লেখা শেষে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম খাতাগুলো।
এক দশক আগেও শিশুরা বড় হয়ে শিক্ষক হবে এমন কথা লিখতো না কিন্তু কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ করছি অনেকেই শিক্ষক হবার বাসনা ব্যক্ত করছে।
যদিও তারা লিখেছে শিশুদের পড়াতে ভালো লাগে তাই শিক্ষক হতে চায় কিন্তু ভাবসাব দেখলে মনে হবে লাঠি হাতে কর্তৃত্ব দেখানোই আসল উদ্দেশ্য।
বিভিন্ন বিচিত্র ইচ্ছার কথা পড়লাম। শান্তার লেখা পড়ে আমি তো অবাক।
শান্তা লিখেছে, “বড় হয়ে আমি ডাক্তার হবো।
আপনি তখন অনেক বুড়ো হয়ে যাবেন।ডাক্তারকে দেখে আপনি তো টাশকি খাইবেন। কারণ আপনি তো জানতেন না আপনার ছাত্রীই ডাক্তার।
আমি আপনার ভিজিট নেবো না।”
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, শুধু আমার চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার হতে চাস্?
উত্তরে শান্তা বললো, না, সবারই চিকিৎসা করবো। তবে, আপনার চিকিৎসার জন্য টাকা নেবো না।
ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম।
ক্লাস থেকে বের হবার সময় শান্তার মাথায় হাত রাখলাম। অকারণেই চোখ দুটো ভিজে উঠলো।
মনে মনে বললাম, তোর ইচ্ছা পূর্ণ হোক।
সেই শান্তা।
আমি কি আবেগ প্রবণ হয়ে গেলাম?
আশ্চর্য! আমি দাঁড়িয়ে আছি বিশাল একটা মাঠে। চাঁদের আলো এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
-আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম, শান্তা। তোকে দেখতে পারছি না কেন?
– আমায় তো আলোতে দেখতে পারা যায় না।
– কেন?
– আমি কালো হয়ে গেছি। কয়লা হয়ে গেছি।
– দূর বোকা। কয়লা হবি কেন? তুই কি কাঠ?
– বাবা রিক্সা চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করল।কিস্তির টাকা, বাবার ঔষধ, ছোট ভাইসহ চারজন মানুষের খাবার, ঘরভাড়া এতো খরচ কোথা থেকে আসবে? তাই তো মা – মেয়ে মিলে কারখানায় কাজ নিলাম। সকালে যাই, রাতে আসি। সারাদিন কাজ করি।
কাজ করি আর ভাবি একদিন এ অবস্থা থাকবে না।
বাবা ভালো হয়ে কাজে যাবে।আমি আবার স্কুলে যাবো।
– এইটুকু বয়সে তোকে কাজে নিল? শিশুশ্রম হলো না?
হঠাৎ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল শান্তা।
— বিদ্রুপের স্বরে বলল, শিশুশ্রম?
পেটে ভাত না থাকলে বইয়ের পড়া সব মিথ্যা হয়ে যায়।
যারা শিশুশ্রম নিষিদ্ধ বলে তারা কি আমায় ভাত দেয়?
দিনের পর দিন আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে খেতে ছোট ভাইটা ভাত সামনে নিয়ে মাছের জন্য কাঁদে তখন কি কেউ মাছ কিনে দেয়?
— আমি তোদের অবস্থা জানতাম না।
– আপনি তো জানেন খালি লেখাপড়ার কথা।মানুষের জীবনের কথা, অভাবের কথা জানবেন ক্যামনে?
– তুই এভাবে রেগে যাচ্ছিস কেন?
-রাগবো না তো কী করবো? একটা জুস কারখানার মেয়েকে আপনি ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখান। আপনি জানতেন না, আমাদের মত পরিবারের মেয়েদের শেষ পরিণতি কী?
– আমি শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বপ্নের বীজ বপন করাই আমার কাজ।
– এই দেশে যারা লুটেরা, চোর, দুর্নীতিবাজ তাদের কি কোন শিক্ষক ছিল না?
-আমি অতো কিছু জানি না। তোর কী হয়েছে আমায় বল। ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এতো সুন্দর শুদ্ধ উচ্চারণ কবে শিখলি?
– আগুনে পুড়তে পুড়তে শিখছি।
– আঁতকে উঠি আমি। সে কি! আগুনে পুড়বি কেন?
– গরীবের ঘরে জন্ম। জন্ম থেকেই পুড়তে থাকি আমরা।
– অনেক বড় হয়ে গেছিস শান্তা।এতো কথা কবে শিখলি?
-মরার পর।
– আবোল তাবোল কথা বলছিস কেন?
-সকালবেলা বাবাকে ঔষধ খাইয়ে ছোট ভাইটাকে বললাম, বাবার খেয়াল রাখিস।
তারপর মা মেয়ে চলে গেলাম কাজে।
কারখানার গেট দিয়ে ঢুকবার সময় মা হোঁটচ খেলো।বললাম, মা, একটু থেমে ওঠো।
দু’ জনের কাজ দুই ফ্লোরে।
প্রতিদিনের মতো কাজ করছিলাম। হঠাৎ শুনি চিৎকার। আগুন! আগুন!
-আমার নিচের ফ্লোরেই মা কাজ করে।দৌড়ে নামতে গেলাম। সিঁড়ির কাছে ধোঁয়া। সব অন্ধকার। ছাদে যাবো। তালা বন্ধ।
জাহান্নামের আগুন তার জিহ্বা বের করে আসতে শুরু করল।বাঁচার জন্য সে কি আকুতি, চিৎকার।
ধোঁয়ায় বন্ধ হওয়া নিঃশ্বাস। একঘর মানুষ ছুটে আসা আগুনে ঝলসে ঝলসে কাবাব হওয়া। কয়লা হওয়া।
আমি ভয়ে কাঁপছি। আতংকিত স্বরে বললাম, এসব কী বলছিস?
আমরা যখন পুড়ে পুড়ে কয়লা হচ্ছিলাম তখন অপরপ্রান্তে হিসাব হচ্ছিল — তদন্ত কমিটি গঠনের, লাশ গুমের, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক, শোক প্রকাশের ভাষা নির্বাচন আরো কতো কি।
এ সব কে বলেছে তোকে?
এটাই তো হয়। মরে গিয়ে কতো কিছু বুঝলাম।
তাজরীন, রানা প্লাজা সব ভুলে গেলেন?
খোলা মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম আমি আর শান্তা। যদিও শান্তার মাথায় ঘোমটা থাকার কারণে মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না।
দিগন্তের পশ্চিম থেকে অসংখ্য পোড়া মানুষের চিৎকার কানে আসতে লাগল।
শান্তা আচমকা মাথার ঘোমটা ফেলে আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল।
কি বিভৎস মুখ! আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম আর্তচিৎকার করে।
শান্তা বলল, ওরা চলে আসছে সময় নেই। কথা দিন, আর কখনো শিশুদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবেন না।
শান্তা দু হাতে আমার গলা চেপে ধরার ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে লাগল।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। চারিদিকে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। অসংখ্য ঝলসে যাওয়া পোড়া মুখ।
আমি পালাতে চেষ্টা করছি। পা সরছে না। ভয়ে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
-কী হয়েছে তোমার? এই তুমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছো?
আমি চোখ মেলে তাকাই।
মাথার কাছে ভয়ার্ত কয়েকটি মুখ। সন্তান আর তাদের বাবা।
আমি উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাই চারিদিকে।
কানে বাজছে — কথা দিন, আর কখনো মিথ্যে স্বপ্ন দেখাবেন না শিশুদের।