# ছোটগল্প –
আঁধারের গান
সেদিন দুপুরের পর থেকেই মনটা ভালো লাগছিল না। কেন যে ভালো লাগছিল না, তারও কোনো কারণ নেই। অকারণে মন খারাপ করে থাকাটা নাকি ফ্যাসানের পর্যায়ে পড়ে। কৈশরে একবার এমন ফ্যাসান করে আমি ও আমার বাল্যবন্ধু মুকুল পাকা ধানক্ষেতের পাশে মেঠোপথের ঘাসের উপরে চৈত্রের তপ্ত রোদের নীচে তিন ঘন্টা শুয়ে থেকেছিলাম। উদ্দেশ্য কিছুই না। পাগলামি। ফ্যাসান। অনেক বছর পরে একবার বাড়িতে গেলে মুকুলের সাথে আমার দেখা হলে ওকে বলি, তোর কী সেই রোদ্রে পোড়ার কথা মনে আছে?
— আছে।
— আবার ইচ্ছা হয়?
— হয়।
মুকুল এখন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের অনেক বড়ো কর্মকর্তা।
বারান্দায় যেয়ে বেতের ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে থাকি। কত আবোল তাবোল কথা ভাবনায় চলে আসে। আহা,, সৃষ্টিকর্তা যদি আর একবার পুণর্জন্ম হওয়ার চাঞ্চ দিত। জন্মটা তাহলে কোথায় নিতাম! পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা নাকি আছে। বইয়ে পড়েছি। কত ভূসর্গ,, কত নয়নাভিরাম পাহাড়ের পাদদেশ, কত সুন্দর নদীর কুলে গ্রাম, কত শিল্পিত কারুকার্যময় শহর। সৃষ্টিকর্তাকে বলে কয়ে সেখানে জন্ম নিতাম না হয়। কিন্তু নাহ্, ঐসব স্থানে নয়। জন্ম নিতাম আবার পল্লীর নিবিড় সবুজ সেই কুসুমপুর গ্রামে। আমাদের সেই টিনের চালা ঘরে, হেমন্তের আবছায়া সন্ধ্যা রাত্রিতে। একে একে জ্বলে উঠবে আকাশে সব তারা। ঝিঁঝি পোকার নিভু নিভু আলো জ্বলবে। অদূরে সেদিনও কুলকুল করে বয়ে যাবে যমুনার স্বচ্ছ জল।
কিছু সময় আসে খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। যারা সিগারেট খায় তারাই বোঝে ব্যাপারটা। ডাক্তারের মানা আছে সিগারেট খেতে। আর আমার সিগারেট না খেতে দেওয়ার যম হচ্ছে আমার স্ত্রী। থাক্ সেই সব দুঃখের কথা। কখন অপরাহ্ণ হয়ে এল, কখন বাঁশঝাড়ের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এসে মুখের উপর পড়েছে বুঝতে পারিনি। ট্রাউজার পরে, টি সার্ট গায়ে দিয়ে, পায়ে চপ্পল পরে ঘর থেকে বের হই। স্ত্রী বলছিল — কোথায় যাও?
— স্টেশনের দিক থেকে একটু হেঁটে আসি।
— এই অসময়ে?
— যার কোনো কাজ নেই তার আবার কিসের সময় অসময়?
আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। দেখলাম, কথা বেশি বাড়াল না।
পথের উপরে বিপ্লবের চা’র দোকান। উল্টা পাল্টা গান বাজছে। বিপ্লব জানে, আমি এইসব গান পছন্দ করি না। আমাকে দেখে ও গান বাজানো বন্ধ করে দেয়। আমি বসি চা’র দোকানে। বিপ্লব বলছিল — মামা, ‘ওয়ান টাইম’ কাপে চা দেই?
— দাও।
— মামা, গান বাজাবো?
— বাজাও।
— লালন, না আয়নাল বয়াতি?
— কোনোটাই না।
— তাইলে কী বাজাবো?
— লতা।
‘বরষে ঘন সারি রাত সঙ্গ শো যাও’
চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই বিমান বন্দর স্টেশনে। লম্বা প্লাটফরমের উত্তর দিকের শেষ মাথায় বসার বেঞ্চ গুলো সাধারণত খালি থাকে। আমি ওখানে গেলে যে বেঞ্চে বসে থাকি — আজ দেখি ‘ বাউডান্ডা’ টাইপের এক লোক ব্যাগ মাথার নীচে দিয়ে সেখানে শুয়ে আছে। দেখে মনে হলো, লোকটা এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল, মাত্রই সে জেগে উঠল। আমি বেঞ্চের কাছে যেতেই সে শোয়া থেকে উঠে বসল।
আমি ওনাকে বলি — ভাইজান আমি একটু বসি?
— বসেন।
— ভাইজান, আপনি কোথায় যাবেন?
— সিলেট।
— সিলেট আপনার বাড়ি বুঝি?
— না। শাহজালালের দরগায় যাচ্ছি।
— বেশ।
হঠাৎ আমার চোখে পড়ল লোকটার ব্যাগের পাশে হুমায়ুন আহমেদ-এর ‘আধারের গান’ বইটি পড়ে আছে। মনে হলো বইটি পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। লোকটার প্রতি আমার ধারণাটা একটু পাল্টে গেল। আমি ওনাকে বলি — ‘ভাইজান আমি আপনার পরিচয়টা কী একটু জানতে পারি? মানে আপনার বাড়ি কোথায়, আপনার নাম কী, আপনি কী করেন? ‘
— আমার বাড়ি টাংগাইলের মির্জাপুর। নাম মোঃ আবদুল কাদের, আমি কিছু করি না। ঘুরে বেড়াই, খাই, ঘুমাই। তা আপনি কোথায় যাবেন?
— আমি কোথাও যাব না। এই স্টেশনেই এসেছি ঘুরতে।
— আপনার সাকিন কোথায়?
— দক্ষিণখান। এখান থেকে সামান্য দূর। মন খারাপ থাকলে এখানে চলে আসি। এসে এই বেঞ্চের উপর বসে থাকি।
— আপনার কী আজ মন খারাপ?
— জ্বী।
— কী জন্য মন খারাপ?
— তা বলতে পারব না।
— আপনি কী ধূমপান করেন?
— আগে করতাম। এখন করি না। ডাক্তার ও স্ত্রীর মানা আছে।
— একটাও খান না?
— বেশি মন খারাপ থাকলে চুরি করে এক দুইটা খাই।
— এখন একটা খান আমার সাথে।
— আছে?
— আছে।
কাদের আমাকে একটি সিগারেট ওফার করল। আমি সিগারেটটি ঠোঁটে নিলাম। সে গ্যাস লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিল। এবং নিজেও একটা ধরালো।
কাদের সিগারেট টানতে টানতে বলছিল — ভাইসাব, আপনি কী করেন?
— আমি কিছু করি না।
— কিছুই করেন না?
— একটু আধটু লিখি টিখি। আর আমার ছোট মেয়েকে বাংলা পড়াই।
— খুব ভালো।
— আপনি হুমায়ুন আহমেদ- এর বই মনে হয় খুব পছন্দ করেন?
— জ্বী। আপনি তো লেখক মানুষ। তা আমার কিছু জীবনের কথা নিয়ে কিছু লিখেন না?
— আমার কাজই তো মানুযের জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা। তা বলেন, আমি শুনি।
— দাঁড়ান। আমি আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে নেই। আপনি কী আরও একটা খাবেন?
— না। আর খাব না। একটা খেয়েছি। তাই প্রতিশ্রুতি অনেকখানি ভঙ্গ হয়েছে। আর বেশি ভঙ্গ করতে চাই না।
আবদুল কাদের তার জীবন কাহিনি বলতে শুরু করল। আমি ওর জবানেই এখানে লিখলাম। (অবশ্য কিছু পরিমার্জন করেছি। অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ বাদও দিয়েছি। এবং কিছু সংক্ষিপ্ত করেছি।)
আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যায়। আমার বাবা একজন স্কুল মাস্টার ছিলেন। আমার দুই ভাই ছিলাম। আমি ছিলাম ছোট। আমার বড়ো ভাই আমার দশ বছরের বড়ো ছিলেন। মাঝে একটা বোন হয়েছিল সে জন্মের সময় মারা যান।
বড়ো ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কালিয়াকৈরে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কেরাণীর চাকুরি নেয়। আমার পড়াশুনা ও আমাদের সংসার চালানোর দায়িত্ব আমার ভাইটির উপরেই পড়ে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, বাবা মরে যাওয়ার দুই বছর পরে আমার মা’ও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
সংসারে যেহেতু কোনো মেয়ে মানুষ রইল না, তখন আমার ভাইটি বিয়ে করেন। সংসারে ভাবী এসে সংসারের হাল ধরেন। আমার ভাবী আমার থেকে তিন চার বছরের বড়ো ছিলেন। সে আমাকে তার ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। আদর যত্ন করতেন। সে কখনোই আমার মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেয় নাই।
আমি যখন বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, তখন আমার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে ছিল নিঃসন্তান। তাদের কোনো ছেলে মেয়ে হয় নাই। তবে জানা গিয়েছিল আমার ভাইয়ের সমস্যার কারণে তাদের কোনো সন্তান হয় নাই।
সবাই ভেবেছিল — আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাবী আমাদের সংসার ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু যায় নাই। আত্মীয় স্বজন সবাই বলেছিল — আমাকে বিয়ে করতে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় নাই। সে বলত, আমি কাদেরকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। ওকে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি এই সংসারে ওর বড়ো বোন হয়ে থাকব। কোথাও যাব না।
তাছাড়া, আমারও মত ছিল না। যাকে নিজের বোনের মতো সেই কিশোর বয়স থেকে দেখে এসেছি, যাকে মায়ের আসলে স্হান দিয়েছি। তাকে কী করে বিয়ে করব? ভাবীর সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাবটা চাপা পড়ে যায়।
এই পর্যন্ত বলে আব্দুল কাদের থেমে গেল। আমি বললাম, তারপর কী হলো বলেন। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে — একটু চা খেতে ইচ্ছা করছে, এবং সিগারেট।
আমি একজন ফ্লাস্কে চা সিগারেট বিক্রেতাকে ডাকলাম। কাদেরকে চা খাওয়ালাম। এবং এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিলাম। সে সিগারেট ধরিয়ে বলে — আপনিও একটা ধরান। বললাম, দেন।
আবদুল কাদের আবার বলতে শুরু করল —
আমিও একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানেে ছোট্ট চাকুরি নেই।
কয়েকমাস কাটছিল ভালোই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আশেপাশের লোকজন নানা গুঞ্জন করতে শুরু করতে লাগল। একই বাড়িতে দুজন যুবক যুবতী থাকি। নানান জন নানা রসালো কথাবার্তা বলতে থাকে। কিন্তু আমার ভাবী ছিল নির্বিকার। সে এইসব কানে তুলত না। আমিও খুব একটা তেয়াক্কা করতাম না। ভাবতাম — নিজে ভালো তো জগৎ ভালো।
কিন্তু প্রকৃতি প্রভাবিত করেছে তার নিজস্ব চিরন্তন নিয়মে। জীবনের অনেক কিছুই এলোমেলো করে দেয় অসম্ভব সুন্দর কিছু প্রকৃতি। প্রকৃতি জীবনকে যেমন সুন্দর করে, মন ভালো করে, তেমনই আবার জীবনকে তছনছ করে দেয়। কালিমাও মেখে দেয় ।
সেদিন ছিল হেমন্তের পূর্ণিমার রাত। আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি। চোখে ঘুম আসছি না। এমন উদাস করা জোছনা রাতে দুচোখ মুূদে ঘুম আসার কথা। কিন্তু ঘুম আসছিল না। আমি জানালা খুলে দেখি — অলৌকিক এক আলোর ভুবন। চারিদিকে মুখর করা জোছনার বন্যায় ভেসে গেছে। আমি দরজা খুলে উঠোনে চলে আসি। কলপারের পাশে হাস্নাহেনার ঝাড় থেকে আকুল করা গন্ধ ভেসে আসছিল। ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনে ভাবী বের হয়ে আসে উঠানে। সে দেখতে পায় — আমি উঠানে ফেলে রাখা একটি পুরানো বেঞ্চের উপর বসে আছি। সে বলে — তুমি এখানে কী করছ?
— ঘুম আসছিল না। তাই এখানে এসে বসে আছি।
ভাবী আমার কাছে এসে বলে — যাও ঘরে যাও।
— তুমি ঘুমাওনি যে!
— ঘুম আসছিল না। জেগে ছিলাম। তোমার বের হয়ে আসার শব্দ শুনে আমিও চলে এলাম।
— ঘুম আসছিল না কেন?
— জানি না।
ভাবী আমার হাত ধরে বলে — কাল সকালে তোমাকে উঠতে হবে। অফিসে যেতে হবে। যাও, ঘরে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।
একবার ভাবীর খুব জ্বর হয়েছিল। এত জ্বর যে, ১০৩/৪ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর। তাকে ঔষধপত্র, পথ্য খাওয়ানো হয়। তবুও জ্বর কমছিল না। আমি সারারাত ভাবীর পাশে বসে থাকি। কপালে জলপট্টি দেই। মাথায় পানি দেই। জ্বরের দ্বিতীয় রাতেও ভাবীর পাশে বসে থেকে তাকে সেবা শুশ্রূষা করছিলাম, জলপট্টি দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি নাই। হঠাৎ ভাবীর গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। কপালে হাত দিয়ে দেখি — জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে অজ্ঞান হয়ে আছে। আমি কপালে জলপট্টি ও মাথায় পানি দিতে থাকি। তারপরও জ্বর নামছিল না। সে অজ্ঞান হয়েই আছে। কাপড়ে জল ভিজিয়ে সারা শরীরে স্পঞ্জ করে দেই। এবং আস্তে আস্তে একসময় তার জ্ঞান ফিরে আসে। ভাবী দেখতে পায় তার শরীর শীতল এবং জলে ভিজে আছে। পরনে ব্লাউজ অন্তর্বাস কিছু নেই। সে সলজ্জিত হয়। শরীরে জ্বরের উত্তাপ নেই। তার চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি তখন।
আর একদিনের কথা। তখন বসন্ত সময়। সেদিন হঠাৎ সন্ধ্যারাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। বসন্তের অসময়ের এমন উতল বৃষ্টির সাথে মাতাল হাওয়ায় প্রকৃতিও উতলা হয়ে উঠে। আমি আর ভাবী একই ঘরে খাটের উপর বসে আছি। টিনের চালের উপর ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা ঝমঝম করে ঝরে পড়ছে। এমন বৃষ্টির শব্দে হৃদয় বীণায় তখন অন্য গানের সুর। বিদ্যুৎ চলে যায়। সারা ঘর অদ্ভুত আঁধারে ছেয়ে গেছে। শুধুই আঁধার নয় তখন। তখন আঁধারের গান বাজছিল বৃষ্টি নিশীথে। আমরা পাপ পুণ্য ভুলে যাই। ভাবী কখনো কী বোন হয়? দেবর কখনো কী ভাই হয়? আমরা ভুলে যাই এই সম্পর্ক, এইসব অলিক অনুশাসন। বৃষ্টির সুরে জলের নুপুরে আর আঁধারের গানে আমাদের দুটো প্রাণ একাকার হয়ে যায়।
আবদুল কাদের এই পর্যন্ত বলে আবার থেমে যায়। আমি ওনাকে বলি — থামলেন কেন? বলেন। সে আরও একটি সিগারেট ধরায়। এবং জোরে শ্বাস নিয়ে সিগারেট টানতে থাকে। একটু দম নিয়ে সে বলতে থাকে আবার —
একসময় বৃষ্টি থেমে যায়। আমি চলে যাই আমার ঘরে। সকালে ঘুম ভাঙ্গে একটু দেরিতে। ঘুম থেকে উঠে দেখি — ভাবীর ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে সে নেই। এবং কোথাও সে নেই। লজ্জায় আর গ্লানিতে সে সেই রাত্রিতেই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
আমি আবদুল কাদেরকে বলি — তারপর ওনার আর কোনো খোঁজ পাননি?
— পেয়েছিলাম দশ বছর পর।
— বলুন কী ভাবে?
— একদিন একটা চিঠি পাই। অজ্ঞাত কেউ একজন লিখেছিল। চিঠিটা এইরূপ ছিল —
জনাব,
আমি চট্টগ্রাম থেকে লিখছি। সাহানা নামে কোনো একজন মহিলা সম্ভবত সে আপনার আত্মীয় হয়।সে এতদিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিল। এই মেয়েটি আমাদের বাসায় ঝিয়ের কাজ করত। গত একবছর ধরে তার লিভার সিরোসিস রোগ হয়েছে। আগামী ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার একটি জটিল অপারেশন হবে। সাহানা কেঁদে কেঁদে বলছিল আপনার কথা। সে আপনাকে দেখতে চায়। পারলে আপনি চলে আসবেন।
ইতি — ইকবাল হাসান চৌধুরী।
হাতে সময় ছিল না। তারিখ মিলিয়ে দেখলাম —আগামীকাল সকাল দশটায় অপারেশন। রাতের ট্রেনেই চলে যাই চট্টগ্রামে। হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল এগারোটা বেজে যায়।
হাসপাতালের বারান্দায় দেখি কয়েকজন নারী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ইকবাল সাহেবও ছিলেন। আমি তাকে আমার পরিচয় দেই। ইকবাল সাহেব আমাকে বলেন — সাহানা আপনার কী হয়? আমি বলি — আমার ভাবী হয়।
অপারেশন থিয়েটারে তখন অপারেশন চলছিল। আরও ঘন্টা দেড়েক পরে একজন সহকারী সার্জন বের হয়ে এসে বলেন — আমরা দুঃখিত, রোগিণীকে বাঁচানো গেল না।
আমি ডাক্তার সাহেবকে বলি — ওনার কী জ্ঞান ফিরেছিল না ?
— ফিরেছিল তিরিশ সেকেন্ডের মতো।
— কোনো কথা বলেনি?
— বলেছিল, অস্ফুট স্বরে একটি শব্দ !
— কী সেই শব্দ?
— ‘ কাদের। ‘
কাদের তার জীবনের কাহিনি বলা থামিয়ে দেয়। চেয়েে দেখি — তার চোখে জল।
সিলেট গামী ট্রেনটি ততক্ষণে প্লাটফরমে ঢুকে পড়েছে। সে দ্রুত আমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে গিয়ে ওঠে। বেঞ্চের উপর সে ফেলে রেখে যায় ‘ আধারের গান ‘।
~ কোয়েল তালুকদার