আত্মজ

অগ্রানে ধান কাটার মরসুম চলছে। প্রখর রৌদ্র তাপে ঘাম ঝড়াইয়া নাগরপুষ্কুনির ক্ষেতে কৃষকেরা দিনভর ধান কাটে। সেই সময় কেউ কেউ জোর গলায় গান গায়। দূর থিকা সেই গানের আওয়াজ শোনা যায়। এইরকম রোদমাখা দিনে আচমকা বায়ু কোণে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করলে কৃষকের কপালে ভাজ ফুটে উঠে। বৃষ্টি হইব কিনা তারা বলাবলি করে। প্রকৃতির হঠাৎ পরিবর্তনে বৃষ্টি না হইলেও পরদিন থিকা হিম শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে।

খরতাপ কমে গেলে ধান শুকাইবে না সহজে। তখন কি করা যায় এইসব ভাবতে ভাবতে মোমেনা উঠানের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় হেটে যায় আর ধান জড়ো করে। সারাদিন খাটুনির পরে এখন তার গতর জুড়ে ক্লান্তি নেমে আসার কথা। তারপরে গোসল সেরে ভাত বসাবে। মতিন ফিরা আসলে একসাথে বসে ভাত খাবে। অথচ শীতের আভাস পেয়ে প্রতিদিনকার নিয়মের পরিবর্তন হয়। মোমেনার ক্লান্তি লাগে না অত। পোলার দিকে সে ফিরা চায়। দেখে শোলার মাথায় কয়েক মুঠি ধান বেধে কাধে নিয়া হাটতেছে। বাবাকে দেখে এইরকম শিখেছে। মোমেনার হাসি আসে একবার।

ছোটকালের কথা মনে পড়ে তার। অগ্রানের সন্ধ্যায় ধান কেটে বাজান বিল থিকা বাড়ি ফিরা আসলে খাইতে বসে তারা ভাই বোনেরা হিইহিই করে কাঁপতো। বড় ভাইজানের বয়স তখন আট দশ বছর। সবকিছুতে ওনার আলাদা থাকার স্বভাব আছিল। শীতের দিনে উদাম গায়ে খাইতে বসলে বাবা বলতো, কিরে ফুত, তর কিতা বিজার করে না?

ভাইজান তখন মুখ গম্ভীর করে বলে, আমার অত বিজার করে না। তারপরে খাওয়া শেষ হইলে গায়ে সইর্ষার তেল মেখে সমবয়েসী অন্যদের সাথে পুষ্কুনিতে গোসল করতে যাইত।

কতকিছু আর আগের মতন নাই। ভাইজান বিদেশ থাকেন আট বৎসর হইল। বাজান এখন আর হাঁটতে পারে না। সারাদিন বিছনায় পইড়া থাকে। শীতকালেও আর আগের মতন শীত লাগে না। সারা বৎসরই গরম থাকে। গেল বৎসরে ধান কাটতে গিয়া গরমের তাপে ক্ষেতের লাইলে পইরা মরছে পুবাডির ফিরোজ আলী। এই বৎসরে তাপ আরও বাড়ছে।

ধান জড়ো হইলে বস্তা দিয়া সেইগুলা ঢাইকা রাখা হয়। এইবার ধান হইছে অনেক। মোমেনা ভাবে, পোলাটারে একবার ডাক্তারের কাছে নিতে হইব। মতিন ফিরা আসলে বলবে। এই কথা প্রতি বৎসরই একবার করে তার ভাবনায় আসে কিন্তু ফলন কম হইলে আর বলতে পারে না।

মতিন তখনও বাড়ি ফিরে নাই, একজন আইসা তার খোঁজ করে। কিও মতিন বাই, আইছো নি?

মোমেনা তখন গোসলখানায়। তাই প্রথম ডাকে কোন সাড়া দেয় না। আবার ডাকলে বলে, আফনের বাই বাড়িত নাই।

আইচ্ছা বাবী, মতিন বাই আইলে কইওন কোম্পানি বাইত যাইত। সর্দারে ডাকছে।

আইচ্ছা।

ধান কাটা শেষ হইলে সেই ধান শুকাইয়া গোলায় তোলা হয়। অগ্রানের শেষে পৌষ আসে। ধীরে ধীরে শীত আরও বাড়তে থাকে। এক মাস হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে গেরস্ত বাড়িতেও তেমন আর কোন কাজ থাকে না। মতিন শহরে যাবার প্রস্তুতি নেয়। কয়দিন ধরে বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হয় না। সারারাত শুধু ছটফট করে। যাবার দিনেও মাঝরাতে আবার ঘুম ভাইঙ্গা যায়। “টাইম কয়টা হইল? উঠতে হইব নাকি?” মতিন মনে মনে ভাবে।

মোমেনার দিকে চেয়ে দেখে ছেলেকে এক হাতে ধরে শান্ত ঘুমাইতেছে। মোমেনা জাইগাই ছিল। মতিনের দিকে মাথা উঠাইয়া বলে, “চইলা যাইতাছেন না কিতা? হেরে উঠামু ঘুম থেইকা?”

মতিন গলা ভার করে বলে, “যাইবার আগে কি শান্তিমতন একটু ঘুমাইতেও দিবা না? অহন রাইত একটা বাজে। বেইন্নাবেলা যামু।” মোমেনা কিছু না বলে মাথা নামাইয়া ফেলে। মতিন তার দিকে চাইয়া আবার বলে, “কিয়ের অত টেনশন করো? তোমার ফুতেরে কিতা আমি ফালায় দিয়া আমু ডাহা শহরো?”

“কয়ন ত যা না, নিজেও কোন শহইরা বেডি ফাইয়া যদি আর ফিরা না আসেন।” মোমেনার মুখ অন্ধকারে হাইসা উঠে।

মতিনের তা চোখ এড়ায় না। সে রস করে বলে, “তোমার ত তাইলে ভালই হইব। নিজের নামে জমিজমা আছে। নতুন আরেকটা নাগর লইয়া সুখের দিন কাটাইতে পারবা।”

“আমার কথা আফনে ভাবেন? আফনের সুখ নিয়া আফনে থাকেন, আমার সুখ নিয়া অত ভাবন লাগত না।”

মতিন কিছু বলে না আর। চোখ বুজে থাকে। পুরানা অনেক কথা মনে পড়ে। বিদেশে থাকতে আগের বউটা নাগরের সাথে ভাইগা যাবার পরে ভাবছিল জীবনে আর কোনদিন বিয়া করবে না। দেশেও আর ফিরা আসবে না। অথচ মোমেনা তার সংসারে আসার পরে তার সকল সুখদুখের দায়িত্ব নিয়া নিল।

এইসব ভাবতে ভাবতে মোমেনার নরম হাতের ওম টের পায় সে। ছেলেকে বিছানার কিনারে রেখে মোমেনা তার কাছে আইসা পিছন দিকে শক্ত করে জড়ায় ধরে। আর নিজের দিকে তাকে টেনে আনে। মতিন ঘুইরা মুখোমুখি হয়। মোমেনার ঘন নিঃশ্বাস তার দেহকে গলায়ে ফেলতে চায় যেন। ছোট শিশুটির মত নরম হয়ে যায় সে। সেই শিশুকে দুইহাতে জড়ায়ে ধরে নিজের উপরে তুলে আনে মোমেনা। আরও শক্ত করে ধরে রাখে। উত্তেজনার আনন্দে বুকে ধুকপুক কাপন শুরু হয়। সেই কাপনে দুইজনে একসাথে কাপতে থাকে। মোমেনার চোখ বেয়ে পানি গড়ায় পড়ে ৷

ফসল তোলার কাজ শেষ হয়। এইদিকে গ্রামে হাড় কাপানো শীত পড়ছে। বিহানে মানুষজন তখনও ঘুমে ছিল। ছেলেকে নিয়া মতিন শহরের দিকে রওনা হয়। কয়েক মাইলের পথ হেটে স্টেশনে পৌঁছায়। স্টেশনে কোন সাড়াশব্দ নাই। একটা শহরগামী বাস দাঁড়াইয়া ছিল, কিছুক্ষণের মাঝে তা যাত্রীতে পূরণ হয়ে যায়৷ যাত্রীদের বেশিরভাগকে দেখে মনে হয় ঘুমের মাঝে হাঁটতেছে।

যাবার কালে মোমেনা ব্যাগপত্র খুলে আবার দেখে নেয়। নিশ্চিত হইতে চায় সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা৷ জরুরি কাগজপত্র কোনটা কোন কাজে লাগবে একে একে মতিনকে বুঝাইয়া দেয়। ব্যাগের ভিতর কিছু খাবারও দিতে চায়, মতিন মানা করে। মোমেনার উৎকন্ঠার কারণ মতিন বুঝতে পারে। ছেলের অনুপস্থিতিতে কাতর হয়ে থাকবে সারাদিন।

সুরা পড়ে ছেলের মাথায় ফুঁক দেয় মোমেনা। সাথে স্বামীকেও দিতে যায়। মতিন তাকে জাপটে ধরে ব্লাউজের সাথে নাক ঘষে। যেন বহুদিন পরে  দেখা হইছে এইভাবে জাপটে ধরে রাখে। মোমেনা ঢলে পড়ে স্বামীর কাধে। ভোরের শীতল হাওয়ায় সেইসব তীব্র অনুভূতি মিশে থাকে। গ্রাম ছেড়ে আসার পথে মতিন সযত্নে সেই হাওয়া গায়ে মেখে রাখে।

পথিমধ্যে আজান পড়ে। বাসের কয়েকজন যাত্রী ড্রাইভারকে বাস থামাইতে বলে। মসজিদের সামনে বাস থামলে কয়েকজন নেমে নামাজ পড়তে যায়। বাকীরা আগের মতই নিশ্চুপ বইসা ঢুলুঢুলু করে। কেউ কেউ ঘুমে নাক ডাকতে শুরু করে।

শার্টে আলতো টান পড়তেই মতিনের ঘুম ভাইঙ্গা যায়। চোখ খুলে বাইরে চাইয়া দেখে সকাল হইছে। শান্ত শহর, বড় বড় বিল্ডিংয়ে ঘেরা। তখনও দোকানপাট সব বন্ধ। দুয়েকটা রিকশায় দেখা যায় ড্রাইভার বিশেষ কায়দা করে সিটে ঘুমাইতেছে। মোড়ের এক কিনারে কয়েকজন পুলিশ জটলা বেধে দাঁড়াইয়া আছে।

বহুকাল আগে একবার গ্রামে গোষ্ঠীর  দলাদলিতে তুমুল বিবাদ ঘটেছিল। সেই বিবাদে দুই গোষ্ঠীর দুইজন মার্ডার হয়। মার্ডারের আসামি করা হয় গ্রামের যত পুরুষ আছে সবাইকে। গ্রাম ছেড়ে দূরে আত্মীয়ের বাড়িতে পলাইয়া থাকার পরে কোনমতে সুযোগ করে মতিন বিদেশ চলে যায়। তারপর থেকে সে পুলিশ দেখলে ডরায়। দশ বছর পরেও সেই ডর কাটে না তার।

মতিন জানালা থিকা মুখটা দ্রুত সরায়। তখন বাসও থেমে যায়। যাত্রীদের মাঝে কেউ কেউ ফিসফিস করে। কিছু হইছে কিনা কেউ বুঝতে পারে না। দুইজন পুলিশ বাসে ঢুকে এক এক করে যাত্রীদের মুখ দেখে। কয়েকজনের ব্যাগ চ্যাক করে।

মতিনের কাছে আইসা এক পুলিশ বলে, বাচ্চা কার?

আমার পুত স্যার।

কি নাম?

জ্বি স্যার হামজা।

ব্যাগ দেখি।

মতিন তার ব্যাগ খুলে দেখায়। অসুখের কাগজপত্র একবার দেখে তারপরে পুলিশ সদস্য পরের সিটের দিকে আগায় যায় ৷

“কিরে পুত, খিদা লাগছেনি? খাইবি কোনস্তা?” মতিন এক হাতে খাওয়ার ভঙ্গি করে আর মাথা নেড়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে। বাবার সাথে সাথে ছেলেও মাথা নাড়ায়। পাশের সিটে এক যাত্রী তখন বলে, পোলা বুঝি কথা কইতে পারে না?

পারে। কম কয়। ডাক্তার কইছে অপারেশন করলে ঠিক হইবো। হাসপাতাল লইয়া যাইতাছি।

আল্লা কতভাবে যে পরীক্কা নেয় তার বান্দারে। আফনেরে যেমুন নিতাছে, আমারেও নিতাছে। এমুন এক ফেরো ফালাইছে, দেহি মিটাইতো ফারি কিনা। বুজলেন বাই, দুনিয়াত ফেরোর অবাব নাই। সবখানো খালি গিট লাইগা থাকে। আল্লা চায় তো খুলবো, না চাইলে আরও লাগবো। তয় দুখ লাগে বাপ দাদার জমিন নিজের হাতে আরেকজনরে দিয়া আইতো যাইতাছি। তা আফনে যাইবেন কই?

ডাহার তেজগাও ইএনটি হাসপাতালে যামু। এক ভাইগ্না আছে। তার লগে দেখা করুম গিয়া। আর পোলার চিকিশশা শুরু করুম।

“আল্লার রহমতে আমার সম্পত্তি মাশাল্লা ভালই আছে। তিনডা ফুলারে বিদেশ ফাডাইছি। মাইয়া একটারে বিয়াও দিছি। অহন পড়ছি এক ঝামেলাত। জমিন কয়েকটার কাগজ আছিল না। সারাজীবন বাফ-দাদায় ফসল করছে, কাগজ মাগজ লাগছে না। অহন বলে শুনতাছি ডকুমেন লাগবো। এইতা অহন কই ফামু। এর লাইগা চেরম্যান সাবের কাছো যাইতাছি।”

তাদের কথার মাঝে গাড়ি এগিয়ে চলছে দ্রুত। মতিন চেয়ে দেখে দোকানপাট তখনও খোলা হয় নাই। সে ভাবে শহরের মানুষ হয়তো দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। গ্রামে রাসুর দোকান খুলে ফজরের নামাজ শেষ হইলে। যারা ক্ষেতে কাজ করতে যায়, রাসুর দোকান থিকা সকাল সকাল পান বিড়ি কিনা নিয়া যায়। গান শোনার জন্য অনেকে ফোনও চার্জ করে নেয়।

ভাইগ্নার কথা মনে পড়ে মতিনের। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল দেয় ভাইগ্নার নাম্বারে। দুইবার কল করেও ফোন ধরে না কেউ। মতিন ভাবে, বড়ফা মাইরা যাইবার পরে সাত বৎসর পাড় হইল। এর মাঝে ভাইগ্নারে আর দেখে নাই । নামটা মনে আছে শুধু, চেহারাও ভুলে গেছে। তাই বারেবারে কল দিতে সংকোচ লাগে তার কাছে। কিন্তু তাছাড়া আর কোন উপায় নাই। শহরের কোন কিছুই চেনে না সে। এই জন্যই মোমেনা টেনশন করেছিল আসার সময়।

আবার ভাইগ্নার নাম্বারে কল দিলে রিসিভ করে। “হ্যালো ভাইগ্না, আমি তোমার মতিন মামা। কালকা রাইতে ফোন দিছিলাম। উঠছো নি ঘুম থেইকা?”

মোবাইলে কথা হয়। কথা শেষ করে মতিনের সংকোচ কাটে কিছুটা। কিন্তু তার পর থিকা বড়ফার কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। বিদেশ যাইবার আগে বড়ফার বাড়িতে থাকতো মতিন। ভাইগ্না তখন ছোট, প্রাইমারি ইস্কুলে পড়তো। সেইখানে কত আদর যত্ন করছে বড়ফা। দুলাভাইকে না জানাইয়া আড়ালে হাত খরচা দিতো তারে। এমনকি একসাথে খাইতে বসলে পাতের মাছের বড় টুকরাটা তার প্লেইটে উঠায় দিতো। সেই বড়ফা তার বিদেশ যাইবার কথা শুনে এলাকা মাতম করে কান্নাকাটি করেছিল। বিদায়ের সময় বারেবারে বলেছিল, “আফারে ভুইল্লা যাইস না ভাই আমার।”

বড়ফার সাথে দেখা হয় নাই আর। আফার মরার খবর যেইদিন পাইলো, মতিন হাউমাউ করে কেঁদেছিল। কেউ কিচ্ছু জানতো না কি হয়েছিল তার। সহকর্মীরা বারেবারে বলতেছিল কি হইছে মতিন, কি হইছে আপনের। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলে নাই। বললেও কেউ বুঝতো না বড়ফা তার জন্য কি আছিল। কত আদর করতো তাকে। বড়ফা বেঁচে থাকতে আফার মত কেউ মতিনকে ভালবাসেনি কোনদিন। কেউ না।

গাড়ি থেকে নেমে ভাইগ্না সাইদুলকে দেখতে পায় মতিন, রাস্তার অপজিটে পায়চারি করতেছে। চশমা পড়া ভাইগ্না একেবারে ফিটফাট। দূর থিকা দেইখাই ভাল লাগতেছে। ভাইগ্নাও তাকে চিনতে পারে। দেখে একগাল হেসে কাছে আসে।

“মামা, আমারে চিনছেন? আমি সাইদুল।”

“হ ভাইগ্না, তোমার চেহারা বড়ফার মতনই। দুনিয়ার আর কাউরে না চিনলেও তোমারে ঠিকই চিনতে পারুম আমি।”

তার কথা শুনে ভাইগ্না এমন ভাবে হাসতে থাকে, অবিকল বড়ফা যেন! মতিনের অবাক লাগে। কতদিন পরে আফার মুখ দেখছে মনে হয়। কাছে গিয়া সাইদুলের কাঁধে হাত রাখে। আসার পথের সকল দুশ্চিন্তা তার কেটে যায় এক নিমিষে। নির্ভার গলায় বলে, “ভাইগ্না খাইছো না তো সকালে কিছু। মামা তোমারে ঘুম ভাঙ্গায়া নিয়া আইলাম অত সকালে। লও আগে কিছু খানাপিনা করি।”

“জ্বী। আপনেরাও তো কিছু খান নাই মনে হয়। মামী আসে নাই?”

“না তোমার মামীর একটু অসুখ করছে। তাও আইতে চাইছিল, আমি তো অতকিছু চিনি না এইখানে। আমি তোমার মামীরে কইছি, ভাইগ্না আছে টেনশন কইরো না।”

“ঠিক কথাই বলছেন আপনে।” এই বলে আবারও হাসতে থাকে সাইদুল। আবারও ঠিক আপার মতন হাসি। আজকে এত বছর পরে অতীতকাল আইসা এইভাবে তাকে বিমুগ্ধ করবে তা মতিনের ধারণা ছিল না।

হাসপাতালের যাবতীয় কাজকর্ম, ঔষধপত্রের ব্যবস্থা সবকিছু একা হাতেই করে দেয় সাইদুল। মতিন শুধু তার পিছে পিছে হাঁটে ।

সাইদুল একবার বলে, “মামা আপনে ভাইরে নিয়া ওইখানে বেঞ্চে বইসা থাকেন। আমি নিচ থিকা কিছু ওষুধ নিয়া আসি।” এই বলে এক ছুটে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে ঔষধ এনে মতিনের হাতে দেয়। আরেকবার বলে, “মামা, ডাক্তার আপনার সাথে কথা বলতে চায়। আমিও চাইছিলাম ঢুকতে কিন্তু বাপ-মা ছাড়া আর কাউরে ঢুকতে দেয় না। আপনে যা যা প্রশ্ন করে সব বুঝে বুঝে উত্তর দিবেন। পারবেন না?”

মতিন বলে, “ভাইগ্না, কি কইতে কি কইয়া দেই। তুমি সাথে থাকলে ভাল হইত। তোমার মামীও আসে নাই।”

“আরে মামা, কঠিন কিছু জিগাবে না। ধরেন, কয় বেলা খায়, ঘুমায় কেমন, এইসব জানতে চাবে। টেনশন নাই।”

এইসব প্রশ্নের উত্তর মতিনের কিছু কিছু জানা আছে। পোলা তার মায়ের কাছে অত থাকতে চায় না, সবসময় তার কাছেই থাকে। তবুও ডাক্তারের রুমে যাইবার আগে তার টেনশন লাগে।

রুমে ঢুকার পরে ডাক্তার বলে, ছেলের তো বয়স বেড়ে গেছে। এত পরে আসলেন কেন?

মতিন বুঝতে পারে না কি জবাব দিবে। তবুও উত্তর দেয়। স্যার আমি দেশে আইছি বেশিদিন হয় নাই। পোলার এই রোগ ভাল হইব কিনা তাও জানি না। হের মার চাওয়াতে আইছি।

ডাক্তার জবাব দেয়, তা নাহয় ঠিক আছে। কিন্তু এই রোগের চিকিৎসা শুরু করতে হয় ছোটকালে। এখন আমি নিশ্চিত বলতে পারবো না এই বয়সে রোগটা ভাল হবে কিনা। তবে গত কয়েক মাসে আগে এমন একটা মেয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে গেছে। তাই হয়তো কিছুটা সম্ভাবনা আছে। আপনি কষ্ট করে এত দূর থেকে আসছেন। আপনাকে আশাহত করতে চাই না। শুধুমাত্র ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে বললাম। এখন সিদ্ধান্ত আপনার চিকিৎসা করাবেন কিনা।

অসুবিধা নাই স্যার, ঠিক হইলে আল্লার হুকুম। না হইলেও তার হুকুমেই হইব না। তাও পোলার মা’র খায়েশ পুরা হোক। হের মা আমার বাড়িতে আসার পর থিকা আমার জীবনটা পালটায় গেছে। হেরে খুশি রাখতে চাই আমি। আর পোলা বড় হইলে যেন তারে কইতে পারি আমি খাটছি তার লাইগা।

বুঝতে পেরেছি। পরবর্তীতে বাচ্চার মাকেও সাথে নিয়ে আসবেন। চিকিৎসার সময় মা সাথে থাকা দরকার। অনেক ব্যাপার আছে আপনি হয়তো বুঝবেন না। মা ভাল বুঝবে।

ডাক্তারের কাছ থেকে বের হয়ে মতিন নিশ্চিত হয় যে, সে পোলার চিকিৎসা যত খরচাপাতিই হোক, করাবেই। সে আরও ভাবে, এই পুরা সময় তার সাথে বসে আছে বড়ফার রাইখা যাওয়া সন্তান। যেন বড়ফা নিজেই সন্তানের মাধ্যম হইয়া তার কাছে আসছে আবার তার উপকার করতে। বড়ফার কাছে তার দেনার শেষ নাই।

হাসপাতালের কাজ শেষ করে দুপুর হয়ে যায়। ফিরে আসার পথে রিকশা করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হয় তারা। সাইদুল তখন জিজ্ঞাসা করে, “মামা আপনে কয় বছর বিদেশে আছিলেন?”

“তা ভাইগ্না দশ বারো বৎসর ত হইবই।” বিদেশের কথা কেউ জানতে চাইলে মতিনের ভাল লাগে। এত বছর কাটায় এসে সেইখানের প্রতি মায়া লেগে গেছে। শেষটা ঠিকঠাক হইলে হয়তো আরেকটু বেশি ভাল লাগতো, তবুও ভাইগ্নার প্রশ্ন শুনে ভাল লাগে তার।

“এতো বছর কাটাইলেন, যাইতে ইচ্ছা করে আর?” সাইদুল আবার জিজ্ঞাসা করে।

“তা তো ইচ্ছা করেই। আবার করেও না। বিদেশে যেমন আরাম আছে, টেকাপইসা আছে। আবার অপমানও আছে।” মতিনের হাসিমুখ মিলিয়ে যায়।

“কেন মামা, এই কথা কইলেন কেন?”

“তোমরা মামা জানো না কিছু। দেশো আইসা কাউরে কিছু কই নাই। তোমার আব্বারেও কইছি না। দশ বারো বৎসর কাটাইছি সত্য কিন্তু ফিরা আইছি চুরের মত। ”

“কি হইছিল?”

“আওনের আগে তিন মাস ধইরা বেতন দিতাছিল না। এর লাইগা সবাই হাউকাউ শুরু কইরা দিছিলাম। আমরার কথা কেউ বাল দিয়া গনছে না। উলটা হুমকি দিছে ছাটাই কইরা দিবো।”

“তারপরে আপনারা কি করলেন? আন্দোলন করছেন হুমকি শুইনা?”

“করছিলাম ভাইগ্না। আমার তো তিন মাস। কেউর কেউর সাত মাস এমুনকি এক বছর ধইরা আনা বেতনে খাটাইছে।”

“একেবারেই কিছু দেয় নাই?”

“কিছু দিছে। এই ধরো পাঁচ মাস খাটাইয়া এক মাসের বেতন দিছে। এমুন কইরা আটকাই লাইছে আমরারে।”

রিকশা চলছিল এমন সময় দূরে ভীড় দেখা যায়। শহরে প্রতিদিন জ্যাম হয় তাই ভীড় দেখে অত মনযোগ দেয় না কেউ। গরমের মাঝে জ্যামে আটকে বসে থাকে। যাবার রাস্তা নেই জেনেও মোটরসাইকেল, সিএনজি এমনকি রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত অনবরত হর্ণ দিতে শুরু করে। হর্ণের আওয়াজে কান ফেটে যাওয়ার দশা হয় মতিনের। এইসব দেখে বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকে শিশু হামজা। কিছু শুনতে পায় না তাই এত মানুষ দেখে মজা পেয়ে হাত তালি দেয়। বাবাকে শার্টে ধরে টেনে আশাপাশের গাড়ি দেখায়। রাস্তার কিনারে এক ফেরিওয়ালা বেলুন নিয়া দাঁড়ায় ছিল, সেইদিকে চেয়ে থাকে হামজা।

এরই ফাঁকে সাইদুল আবার জিজ্ঞাসা করে, “এই কাজ ছেড়ে আরেক কাজে যাবার উপায় ছিল না?”

“না ভাইগ্না, আকামা লাগে, পারমিশন লাগে, অনেক টেকাপইসা লাগে। এক কোম্পানিতেই আমি আছিলাম দশ বৎসর। এর লাইগা আর যাইতে পারি নাই।”

“পরে কি করলেন?”

“পরে কয়েকজন মিল্লা কইছি, হইলে ফুল বেতন দিতে হইব নাইলে দেশো পাঠাইয়া দিতো। তারা কইছে তাইলে দেশো ফিরা যা। আমার খালি তিন মাসের বেতন মাইর গেছে। আমার লগে কয়েকজন আইছে, তারার ছ’ মাস, সাত মাস কইরা মাইর গেছে।”

“দেশে আসার পথেও কিছু দিয়া দেয় নাই?”

“দিছে ত না, উল্টা এক কাপড়ো ফিরত পাঠাইছে। দশ বৎসর ধইরা যেইসব জমাইছিলাম সব ওইখানে। বেইচাও আইতে পারি নাই। পরে আইসা একজনরে ফুন দিয়া কইছি রাইখ্যা দিতো।”

“তার মানে আরও অনেকে আছে সেইখানে।”

“আছে অনেক। আল্লা জানে তারার ভাইগ্যে কিতা লেখা আছে। বিদেশ ভালা না ভাইগ্না। দাম নাই কুনু। কুত্তার দামও দিত না আমরারে।”

মতিন আরও কথা বলতে চেয়েছিল। তখন বিকট শব্দ করে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি এগিয়ে যায় ভীড়ের দিকে। মানুষ ছুটাছুটি শুরু করে। জ্যামে আটকে থাকা অনেক গাড়ি পিছন দিকে ফিরে যায়। মতিন দেখে গাড়ি থেকে পুলিশ নেমে কয়েকজনকে লাঠিপেটা করছে। সেইখানে অনেক নারীও আছে। কিন্তু তারা কারা বুঝতে পারে না কিছু। সাইদুলকে জিজ্ঞাসা করবে ভাবে একবার। তার ভয়ে ভীষণ অস্থির লাগে। রিকশাওয়ালা তার অস্থিরতা দেখে বলে, “গার্মেন্টসের লোকেরা আন্দোলন করতাছে। সেইখানে পুলিশ আইসা বাঁধা দিছে। একটু পরেই থাইমা যাইবো। বইসা থাকেন।”

আধাঘণ্টা ধাওয়া পালটা ধাওয়ার পরে ভীড় কমে আসতে থাকে। ওইদিন রাতে মতিন বাড়ি ফিরে যায়।

পরের দিন সকালে মতিন কল দেয় ভাইগ্নার নাম্বারে। “হ্যালো সাইদুল, আমি তোমার মামা কইতাছি। তোমার শরিলডা ভালা নি?

সাইদুল হাসে। মতিন শুনতে পায় যেন বড়ফা হাসতেছে। সেই হাসি তাকে আবার অতীতের কোনখানে নিয়া যায়। মতিন তখন বিড়বিড় করে বলে, ভাইগ্না, তুমি একদিন মামার বাড়িতে আইসো। মামী তোমারে রাইন্দা খাওয়াইবো। এই কথা বলে সে মোমেনার দিকে চায়। দেখে পোলারে খাওয়াইয়া দিতেছে মোমেনা।

মতিন তখন মোমেনাকে বলে, আমার পয়লা বউর কথা তো শুনছিলা। কতখানি শুনছিলা?

তার কথা শুনে মোমেনা মুচকি হেসে উঠে। কিন্তু কোন কথা বলে না।

মতিন আবার বলে, এই ব্যাপারে কোন কিছু কইবার না চাইলে বাদ দেই।

মোমেনা বলে, অতদিন তো একবারও কিছু কন নাই। শহর থিকা ফিরা আইসা আজকা কি হইল আপনের? আমার কপাল পুড়বো নাতো?

মতিন বলে, তুমি রস করতে জানো মোমেনা।

তার কথা শুনে মোমেনা হিহি করে হাসতে থাকে। তারপরে বলে, কি হইছে কইন তো আমারে।

মতিন বলে, কিছু হয় নাই। কালকা থিকা বড়ফার কথা মনে পড়তাছে খালি। তুমি তো জানো, আফার কাছে আমি বড় হইছি। বিয়ার পরে আফা আমারে নিয়া গেছিল তাইনের বাড়িতে। সেইখানে আমার সমান এক তালতো ভাইও আছিল। আমরা দুইজনে আফা দুলাভাইয়ের কাছে বড় হইছি। কালকা যখন হাসপাতালো গেছি, সাইদুলরে দেইখা খালি আফার কথাই মনো পড়তাছে। কত ঘটনা যে মনো হইছে।  রাইতে বাড়িত আইসা মনো হইল, আমার পয়লা বউরে নিয়া তোমার লগে কোনদিন কোন আলাপ হয় নাই। আমি চাইও নাই তাইর কোন কথা কইতে। আমার লগে নিমকহারামি কইরা আরেক পোলারে লইয়া ভাইগা গেছে গা। এইটা যেমুন সত্য, আরেকটা সত্য হইল, তাইরে আমার লগে বিয়া দিছিল আফাই। আমি হা না কোনস্তা কই নাই। আফা আছিল আমার কাছে মা’র মতো। তাইন পছন্দ করছে মানে ভাবছিলাম ভালা হইব আমার লাইগা।

মোমেনা কোনকিছু না বলে চুপচাপ শুনতে থাকে। মতিন আরও বলে, বিয়া কইরা তিন মাস পরে আমি বিদেশ গেলাম গা। তিন বছর থাকলাম। এর মাঝে কতবার চাইছি দেশ থিকা ঘুইরা যাই। কিন্তুক আসতে পারি নাই। তাইরে ফোনে সব বুঝাইয়া কইছিলাম। এমুনকি আমার যত আয়রোজগার সব বাড়িত পাঠাইছি। তাইরে বিল্ডিং কইরা দিছি। দুই ভরি সোনাও পাঠাইছি তাইর লাইগা। তবুও আমার ঘরে থাকতে চায় নাই। কোন পোলার লগে লাইন মাইরা সোনা আর ক্যাশ টেকা লইয়া ভাগছে।

তাই যেইদিন গেল গা, আফা আমারে ফোন কইরা হাউমাউ কইরা কানতাছিল। আমার কষ্ট হইব কি, আফার কষ্ট দেইখা আমি আর কিছু কইতে পারি নাই। নিজের উফরে পুরা দুশ নিয়া বড়ফা মরছে। অথচ দেখো, বিধাতার কি খেল, তাই ভাইগা যাওয়ার পরে আমার কাছে তোমারে পাঠাইছে। তোমার ভালবাসা আমার সকল দুঃখ কষ্ট ভুলাই দিছে। তুমি আসার পর থিকা আমি সাহস পাইছি মনে। বিদেশ থিকা এক কাপড়ে আইসাও ভাইঙ্গা পড়ি নাই। গেরস্ত কামে আবার দাড়াই গেছি।

মোমেনা কি বলবে কিছু বুঝতে পারে না। তার গাল বেয়ে পানি ঝরে পড়ে। মতিনের সেদিকে কোন খেয়াল থাকে না। সে অনবরত কথা বলতে থাকে। একবার বলে আপার কথা, একবার আগের বউয়ের কথা, বাপ মা আর বন্ধুদের কথাও একে একে বলতে থাকে। আরও বলে ছোটবেলায় নৌকা নিয়া বিলে রাত কাটানোর গল্প, বিহানবেলায় বিলের ডুবা সেচে মাছ ধরার গল্প, প্রখর রোদে ছাতা মাথায় গরু রাখতে যাওয়ার গল্পও বউকে শোনায়। মোমেনা স্বামীর বুকে মাথা রেখে সেইসব কথা চুপচাপ শুনতে থাকে।

 

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত